স্টিমার বা মার-বোট থেকে তখন পাড় নজরে আসছে। কিন্তু কালো আকাশ দেখে প্রমাদ গুনছেন যাত্রীরা। দাঁতে-দাঁত চেপে কোনও মতে পাড় ছোঁয়ার অপেক্ষা। হঠাৎই মোক্ষম আঘাত! ঝড়ের আচমকা ঝাপটা, বিশাল লঞ্চটাকে কার্যত আছড়ে ফেলল বুড়াবুড়ি এলাকার পাথুরে চড়ায়। মুহূর্তে দু’টুকরো হয়ে গেল মার-বোট। যাত্রীরা তখন আসন বা রেলিং ধরে প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করছেন। ফের ঝাপটা। দু’টুকরো হয়ে যাওয়া লঞ্চকে উল্টেপাল্টে ব্রহ্মপুত্রে ডুবিয়ে দিল রাক্ষুসে ঝড়। রাত অবধি সরকারি মতে নিখোঁজের সংখ্যা দু’শো। বেসরকারি মতে সংখ্যাটি দু’শো ছাড়াতে পারে। স্থানীয় মানুষজনের সাহায্য নিয়ে সেনাবাহিনী-পুলিশ-বিএসএফ ও ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসকিউ ফোর্স এ পর্যন্ত ১০০টি নিথর দেহ উদ্ধার করেছে।
আজ বিকেল পৌনে ৫টা নাগাদ অসমের ধুবুরি জেলায় মেদেরটাড়ি লঞ্চ ঘাটের কাছে এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে পুলিশ-প্রশাসন জানতে পেরেছে, ওই লঞ্চে প্রচুর মালপত্র ছাড়াও অন্তত ৪০০ জন যাত্রী ছিলেন। লঞ্চ ভেঙে পড়ার পরে বেশ কিছু যাত্রী সাঁতারে পাড়ে উঠেছেন। তবে এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় তাঁদের সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত নয় প্রশাসন।
ধুবুরির পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে বিশেষ বোট, সার্চলাইট ইত্যাদি নিয়ে নদীতে প্রাথমিক তল্লাশি শুরু হয়। পরে নামানো হয় এনডিআরএফ, সেনাবাহিনী ও বিএসএফকে। ধুবুরির পুলিশ সুপার প্রদীপ সালৈ বলেন, “পৌনে ৫টা নাগাদ প্রবল ঝড়বৃষ্টির সময়ে লঞ্চটি পাড়ের কাছেই ভেঙে যায়। প্রায় ২০০ জন যাত্রী নিখোঁজ। যাত্রীদের খোঁজে তল্লাশি চালাতে সরকার সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে।”
ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত মেদেরটাড়ির সঙ্গে উত্তর পাড়ের ধুবুরির সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই। সড়ক পথে যেতে হলে গোয়ালপাড়া, মেঘালয়ের ফুলবাড়ি হয়ে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পেরোতে হয়। সময় লেগে যায় ৭ ঘণ্টা। লঞ্চে লাগে বড় জোর দু’ঘণ্টা। স্বভাবতই ধুবুরি-মেদেরটাড়ি এলাকার মানুষজন ফেরিঘাটের লঞ্চের উপরেই বেশি নির্ভরশীল।
সোমবার ছিল ধুবুরির সাপ্তাহিক হাট বার। সাধারণত, লঞ্চে যা যাত্রী হয় (২০০-২৫০ জন), তার তুলনায় অনেক বেশি যাত্রী ও মালপত্র লঞ্চে তোলা হয়েছিল এ দিন। বেলা আড়াইটে নাগাদ, ধুবুরির পোয়াভিটা ঘাট থেকে ফকিরগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয় লঞ্চটি। গন্তব্য মেদারটারি ঘাট। সাড়ে ৪টে নাগাদ প্রবল ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে। শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। ততক্ষণে প্রায় মেদেরটাড়ি ঘাটের কাছে পৌঁছে যায় লঞ্চটি। চালক তা ঘাটে দাঁড় করানোর জন্য ঘোরানোর চেষ্টা করছিলেন। সেই সময়েই ঝোড়ো হাওয়ার এক ঝাপটায় লঞ্চটি দু’ভাগ হয়ে যায়। যাত্রীদের অনেকে ঝাঁপিয়ে, সাঁতরে পাড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু শিশু ও মহিলা-সহ অনেক যাত্রী নদীতে তলিয়ে যান বলে আশঙ্কা প্রশাসনের। খবর পেয়ে পুলিশের তরফে বেশ কয়েকটি বোট নিয়ে বিশেষ উদ্ধারকারী দল রওনা হয়। তবে তল্লাশির পথে প্রধান অন্তরায় অন্ধকার ও খারাপ আবহাওয়া।
মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের নির্দেশে পরিবহণমন্ত্রী চন্দন ব্রহ্ম রাতেই ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা দেন। আর এক মন্ত্রী নজরুল ইসলাম, রাজ্যের মুখ্যসচিব ও রাজস্ব সচিবকেও অবিলম্বে ঘটনাস্থলে গিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পার্শ্ববর্তী জেলা প্রশাসনগুলিকেও উদ্ধারকাজে সর্বতো ভাবে সাহায্য করার নির্দেশ দিয়েছেন গগৈ।
এ দিকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁকে ফোন করে পরিস্থিতির খোঁজ নিয়েছেন। প্রয়োজনীয় সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন গগৈকে। |