জেলাশাসক অপহরণ-কাণ্ডে টানা দশ দিনের চরম অনিশ্চয়তার নাটকীয় পট পরিবর্তন হল সোমবার রাতে।
এ দিন রাতে ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ সাংবাদিক সম্মেলন করে জানালেন, সুকমার অপহৃত জেলাশাসক অ্যালেক্স পল মেনন আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি পেতে চলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “মাওবাদী সন্দেহে জেলবন্দিদের মুক্তির ব্যাপারে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলাশাসকের মুক্তির এক ঘণ্টার মধ্যেই ওই কমিটি কাজ শুরু করবে।”
গত ২১ এপ্রিল সুকমার মাঝিপাড়া গ্রাম থেকে মাওবাদীরা অপহরণ করে নিয়ে যায় মেননকে। গুলি করে মারা হয় তাঁর দুই দেহরক্ষীকে। এই ঘটনার পর থেকে স্বাভাবিক ভাবেই চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে ৩২ বছরের জেলাশাসকের স্ত্রী আশা মেননের। স্বামী মুক্তি পেতে চলেছে, এই খবর পাওয়ার পর সোমবার রাতেই সন্তনসম্ভবা আশা আনন্দবাজারকে ফোনে বলেন, “আশা করব তিনি নিরাপদে ও সুস্থ অবস্থায় ফিরবেন। এত দিন অপেক্ষা করলাম, আরও দু’দিন না হয় অপেক্ষা করব।
এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠকের ঠিক আগেই সরকার এবং মাওবাদীদের তরফের চার মধ্যস্থতাকারী রায়পুর সার্কিট হাউসে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। সেখানে মধ্যস্থরা জানান, তাঁরা একটি দু’পৃষ্ঠার চুক্তিপত্র তৈরি করেছেন। চুক্তিপত্রে সরকারের তরফে সই করেছেন স্বরাষ্ট্র সচিব এন কে অসোয়াল। তাই আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জেলাশাসকের মুক্তির ব্যাপারে তাঁরাও আশাবাদী।
সোমবার দিনভর চার মধ্যস্থতাকারীর মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হয়। এর মধ্যেই নতুন করে চরমপত্র দেয় মাওবাদীরা। তারা জানিয়ে দেয়, বুধবার, ২ মে পর্যন্ত চূড়ান্ত সময়সীমা বাড়ানো হল। এর মধ্যে তাদের আট সহযোগীকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে মধ্যস্থকারীদের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে হবে। তা না হলে ‘জন-আদালত’ বসিয়ে মেননের ভাগ্য নির্ধারণ করা হবে। এই নিয়ে মাওবাদীরা চতুর্থ বার তাদের দাবি পাল্টাল। প্রথমে তারা আট জনকে মুক্তি দেওয়ার কথা বলেছিল। দ্বিতীয় দফায় তা হয় ১৭। তৃতীয় বার তারা ৭৫ জনকে ছাড়ার দাবি তুললেও সোমবার ফের আট জনের মুক্তির দাবি জানায়। পাশাপাশি রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ আনে মাওবাদীরা। এক বার্তায় সিপিআই (মাওবাদী)-র দণ্ডকারণ্য দক্ষিণ রিজিওনাল কমিটির অভিযোগ, সরকার তাদের দাবি মেটানোর বদলে চুপচাপ রয়েছে। সমস্যার সমাধানের বদলে চালকবিহীন নজরদারি বিমান পাঠিয়ে তাদের গতিপ্রকৃতি জানতে চাইছে। তারা ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। তাতেও পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি।
এর পরই পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নিতে থাকে। রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের তৎপরতা দেখে বোঝা যায়, এ দিন রাতেই কোনও একটা ঘোষণা হতে পারে। চার মধ্যস্থতাকারীর মধ্যে পঞ্চম দফার বৈঠক দুপুর সাড়ে তিনটেয় শুরু হয়ে দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টাতেও শেষ না হওয়ায় কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা চরমে ওঠে। রাত সাড়ে আটটার কিছু পরে জানানো হয়, মধ্যস্থতাকারীরা সাংবাদিক বৈঠক করবেন। এই সাংবাদিক বৈঠকের পরেই মুখ্যমন্ত্রী নিজের বাসভবনে সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন। সেখানে তিনি কমিটি গঠনের কথা জানান। তিনি আরও জানান, উচ্চপর্যায়ের কমিটির নেতৃত্বে থাকবেন সরকারের তরফের মধ্যস্থতাকারী নির্মলা বুচ। এ ছাড়াও থাকছেন রাজ্যের মুখ্য সচিব সুনীল কুমার ও পুলিশের ডিজি অনিল এম নাওয়ানে।
চার মধ্যস্থতাকারীর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্রে বলা হয়েছে, রাজ্যে জেলবন্দি প্রচুর আদিবাসী ও অন্যদের মুক্তির বিষয়টি দেখার জন্য গঠিত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি জেলবন্দিদের বিরুদ্ধে রুজু করা মামলার কাজ খতিয়ে দেখবে। এর মধ্যে মাওবাদীদের মামলাগুলিও রয়েছে। এ ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বস্তার এবং তার আশপাশের এলাকার আদিবাসীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলির উপর। কমিটি তাদের সুপারিশ রাজ্য সরকারকে জানাবে। চুক্তিপত্রে সিপিআই (মাওবাদী)-র দণ্ডকারণ্য দক্ষিণ রিজিওনাল কমিটির কাছে আহ্বান জানানো হয়, তারা যেন মেননের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন সুনিশ্চিত করে।
এ দিন রাতে মাওবাদীদের তরফে মধ্যস্থতাকারী বি ডি শর্মা আনন্দবাজারকে ফোনে বলেন, “দু’দিনের মধ্যেই মুক্তি পাচ্ছেন জেলাশাসক। তাঁকে জঙ্গল থেকে নিয়ে আসা ইত্যাদি কারণে মাঝে এক দিন রাখা হচ্ছে।” কিন্তু এই চুক্তিপত্র মাওবাদীরা মানবে তো? এ দিনের বৈঠকের ফাঁকে মাওবাদীদের সঙ্গে তাদের কি কথা হয়নি? শর্মার জবাব, “আমরা জঙ্গলে গিয়েছিলাম কথা বলতেই। তা হলে আর নতুন করে কথা হবে কেন?” তিনি আরও জানান, শুধু জেলবন্দিদের ব্যাপারেই নয়, সালওয়া জুড়ুমের জন্য হওয়া ক্ষতি, মেয়েদের উপর অত্যাচার, ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া ইত্যাদি অভিযোগ নিয়েও কথা হয়েছে। শর্মার সাফ কথা, “মেনন না ফেরা পর্যন্ত ছত্তীসগঢ় ছাড়ছি না।” |