রাত ৩টে। বিকট শব্দে কাঠের দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকল জনা ছয়েক দুষ্কৃতী। সকলের সামনে এক তরুণী। সকলেরই মুখ কাপড়ে ঢাকা। তরুণীর পরনে চুড়িদার, হাতে লোহার রড। অন্যদের হাতে রিভলভার ও চপার। আতঙ্কে কাঁপতে থাকা বাসিন্দাদের ধমকে তরুণীটি বলল, “রুপিয়া, জেবর জো হ্যায়, সব নিকালো। ওয়রনা জান সে জাওগে।”
ঘটনাস্থল সল্টলেক, এডি ব্লকের ১২৫ নম্বর বাড়ি। রবিবার রাতে হঠাৎ ওই দৃশ্য দেখার পরে তখন আতঙ্কে কাঁদতে শুরু করেছে অক্ষিতা (১০), শাহিস্তা (৮) ও আড়াই বছরের সক্ষম। বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঁপছেন মা সুধা (৪২)। স্ত্রী ও সন্তানদের ওই অবস্থা দেখে গৃহকর্তা, ৫১ বছরের সুরিন্দর সিংহ ডাবলা বাধা দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ডাকাতদের চপারের কোপ এসে পড়ে তাঁর ডান হাতে। রক্তাক্ত অবস্থায় বসে পড়েন তিনি।
ইলাহাবাদ ব্যাঙ্কের সল্টলেক শাখার ম্যানেজার সুরিন্দর ২০১১ সালে হরিয়ানা থেকে কর্মসূত্রে এসে সল্টলেকের ওই বাড়িটি ভাড়া নেন। সোমবার সকালে তিনি বলেন, “ওই দলে মেয়েটির বয়স বছর পঁচিশেক। উচ্চতা পাঁচ ফুটের মতো। ওরা হিন্দিতে কথা বলছিল। টাকা-গয়না কোথায় রয়েছে, বারবার জানতে চাইছিল মেয়েটি। বলছিল, না বললে মেরে ফেলা হবে। বাধা দিতে গিয়ে মার খেয়েছেন আমার স্ত্রী-ও। আমার বড় মেয়েকেও মারে ডাকাতেরা। একটা সময়ে ভয় লাগছিল, বাচ্চাদের ওরা কোনও ক্ষতি না করে দেয়।” |
সুরিন্দর জানান, বিছানার চাদর ছিঁড়ে এবং আলমারি থেকে ‘টাই’ বার করে তাঁর ও সুধার হাত-পা বাঁধে ডাকাতেরা। দু’জনেরই মুখে গুঁজে দেওয়া হয় বিছানার চাদর। তরুণীটি ইতিমধ্যে সুধার হার, হাতের বালা খুলে নেয়। সঙ্গে চলে গুলি করে খুনের হুমকি।
সুধাদেবী জানান, তাঁদের ওই অবস্থায় দেখে অক্ষিতা ডাকাতদের বলে দেয়, কোন আলমারিতে কী আছে। সল্টলেকেরই একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী অক্ষিতা বলে, “ওরা বলছিল, বাবা-মাকে গুলি করে মেরে দেবে। তাই আমি সব বলে দিই। আমাকেও মেরেছে ডাকাতেরা।” যে ঘরে পরিবারটি ঘুমোচ্ছিল, সেই ঘরেই রয়েছে একটি কাঠের আলমারি। পাশের ঘরে ছিল লোহার আলমারি। সুধাদেবী জানান, কাঠের আলমারিটি তালাবন্ধ ছিল না। লোহার আলমারির চাবিও বাইরে ঝোলানো ছিল। মেয়ের মুখে তা জানতে পেরে দুষ্কৃতীরা আর সময় নষ্ট করেনি। সোজা গিয়ে আলমারি খুলে প্রায় ৪ লক্ষ টাকার গয়না, নগদ ৩৫ হাজার টাকা এবং দু’টি মোবাইল হাতিয়ে নেয়। সুরিন্দরের বক্তব্য, প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে ডাকাতি চালিয়ে চম্পট দেয় ওই তরুণী ও তার সঙ্গীরা।
কী করে বাড়িতে ঢুকল ডাকাতেরা? সুরিন্দর জানান, বাড়ির বাইরে লোহার গেটে তালা লাগানো ছিল। তালা ভেঙে বারান্দায় উঠে ঘরে ঢোকার পথে রয়েছে একটি কাঠের দরজা। ভিতর থেকে সেটিতে লাগানো ছিল শক্তপোক্ত ছিটকিনি। সেটি ভেঙে ডাকাতেরা ঢুকেছে বসার ঘরে। তার পরে আরও কাঠের দরজা কুড়ুল দিয়ে ভেঙে তবেই শোয়ার ঘরে ঢুকেছে ডাকাতেরা।
পাশের বাড়িতে যখন এই ডাকাতির ঘটনা ঘটছে, তখন পুলিশে খবর দেন সুরিন্দরের প্রতিবেশী স্নিগ্ধা দে। তিনি বলেন, “শেষ রাতে হঠাৎ পাখির ডাক শুনে ঘুম ভেঙে যায়। প্রায় ২৫ বছর সল্টলেকে রয়েছি। এত জোরে পাখির ডাক কখনও শুনিনি। ভোর হয়েছে ভেবে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখি ঘন অন্ধকার। তখনই পাশের বাড়ি থেকে চিৎকার ও কিছু ভাঙার শব্দ শুনতে পাই।” স্নিগ্ধাদেবীর বক্তব্য, তিনি জানলা দিয়ে দেখতে পান সুরিন্দরদের ঘরে কয়েক জন মুখ-ঢাকা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি বলেন, “ওদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে আন্দাজ করে আমার স্বামী বিবেককে ডেকে ১০০ নম্বরে ফোন করি। পুলিশ জানায়, আমরা এখনই আসছি। কিন্তু তার পরেও অনেকক্ষণ কেটে যায়।” স্নিগ্ধাদেবী জানান, পুলিশ আসছে না দেখে তিনি ফোন করেন এলাকার কাউন্সিলারকে। কিন্তু তাঁর ফোন বন্ধ ছিল। অগত্যা তিনি এলাকার অন্যদের ফোন করে ঘটনাটি জানান। নিজেরাও চিৎকার করতে থাকেন। এর মধ্যেই ডাকাতেরা পালায়।
স্নিগ্ধাদেবী বলেন, “পালানোর সময়ে ডাকাতেরা আমাদেরও রিভলভার দেখিয়ে ভয় দেখায়। ওই সময়ে জোরে কুকুরের ডাকও শুনতে পাই। মনে হয়, ওই পাখি আর কুকুরের ডাক সঙ্কেত হিসেবে ব্যবহার করছিল ডাকাতেরা।”
সময়ে না পৌঁছনোর অভিযোগ অস্বীকার করে বিধাননগরের পুলিশ সুপার রাজীব কুমার বলেন, “৩টে ১৬ মিনিটে পুলিশকে ফোন করা হয়। সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ঘটনাস্থলে রওনা হয়। রাস্তায় একটি মোটরবাইক ও একটি গাড়ি দেখে সেগুলি ডাকাতদের ভেবে তাড়া করেন পুলিশ অফিসার। গাড়ি ও বাইকটিকে আটকানো হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেগুলি বিয়েবাড়ির গাড়ি। ভুল বুঝতে পেরে পুলিশ ফের গাড়ি ঘুরিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। সে কারণেই কিছুটা দেরি হয়েছে।” প্রাথমিক ভাবে পুলিশের ধারণা, দুষ্কৃতীরা সল্টলেকের পিএনবি এলাকা হয়ে দু’নম্বর গেটের কাছ দিয়ে পালিয়ে যায়।
অন্য দিকে, চপারের আঘাতে জখম সুরিন্দর এ দিন প্রাথমিক চিকিৎসার পরে জানান, মাস ছ’য়েক আগেও দু’জন যুবককে রাতে গ্যারাজের ছাদে বসে থাকতে দেখে তিনি পুলিশে খবর দিয়েছিলেন। পুলিশ এসে রাতে তাঁদের ঘরের দরজা ভাল করে বন্ধ করে রাখতে পরামর্শ দেয়। সুরিন্দর বলেন, “তিন-তিনটে দরজা বন্ধ করে রেখেছিলাম। তাতেও তো ডাকাতদের আটকানো গেল না!” |