রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’ এখনও তৈরি হয়নি বলে দলের নেতা-কর্মীদের ‘সতর্ক’ করে দিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার পাশে থেকে, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ আরও মজবুত করেই দলকে ভবিষ্যতের জন্য ‘প্রস্তুত’ হওয়ার দাওয়াই দিয়েছেন সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য বুদ্ধবাবু। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তির মুখে বুদ্ধবাবুর এই বক্তব্য থেকেই ইঙ্গিত মিলছে, রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর আন্দোলনের পথে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে প্রধান বিরোধী দল সিপিএম আরও ‘সময়’ নিতে চায়।
বস্তুত, মমতার নেতৃত্বাধীন সরকারকে ‘সময়’ দেওয়ার পক্ষে গোড়া থেকেই সওয়াল করে আসছেন সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু কোঝিকোড়ের পার্টি কংগ্রেস শেষ হওয়ার পরেও বুদ্ধবাবুর সেই ‘ধীরে চলো’ নীতিরই পুনরুচ্চারণ বাম রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তি তাৎপর্যপূর্ণ। স্বয়ং বুদ্ধবাবুই এখনও রাজ্য সিপিএমের ‘মুখ’ এবং বিবিধ জল্পনা সত্ত্বেও সদ্যসমাপ্ত পার্টি কংগ্রেসে দলের পলিটব্যুরোর নিয়মিত সদস্য হিসেবেই থেকে গিয়েছেন তিনি। তার পরে রবিবারই প্রথম দলের নেতা-কর্মীদের মুখোমুখি হয়ে ভবিষ্যতের জন্য আরও নিবিড় ‘প্রস্তুতি’ চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। একই দিনে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও ফের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘দায়িত্বশীল’ বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করাই তাঁদের লক্ষ্য। |
প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে। রবিবার। নিজস্ব চিত্র |
লেনিনের ১৪৩তম জন্মদিবসে প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে ‘লেনিন ও একবিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্র’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় এ দিন বুদ্ধবাবু বলেছেন, “রাজ্যে একটা পট পরিবর্তনের ১১ মাস হয়েছে। ভবিষ্যৎ আমরা বুঝতে পারছি। মানুষের মনে কিছু প্রশ্ন, কিছু ক্ষোভ দেখা দিচ্ছে। কিন্তু তার স্বতঃস্ফূর্ততা এখনও নেই। পার্টিকে আরও প্রস্তুত হতে হবে।” প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “পার্টির সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন সম্পর্ককে মজবুত করা, তাঁদের প্রতিদিনের সমস্যাকে বোঝার চেষ্টা, মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবির আন্দোলনের সঙ্গে পার্টিকে যুক্ত করা লেনিনের জন্মদিবসে এই শপথই আমাদের নিতে হবে।” সামগ্রিক ভাবে গোটা পৃথিবীতে পুঁজিবাদের সঙ্কট, ‘অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিটে’র ‘স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ’কে বামপন্থী আন্দোলনে সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়েই নিজের রাজ্যের পরিস্থিতির যোগসূত্র টেনেছেন বুদ্ধবাবু।
কাঁচরাপাড়ায় এ দিনই সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক জগদীশ দাসের স্মরণসভায় গিয়ে দলের রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবু বলেছেন, “আমরা সরকারে থাকাকালীন যত বার সর্বদল বৈঠক হয়েছে, মূল বিরোধী দল বয়কট করেছে। কিন্তু আমরা দায়িত্বশীল বিরোধীর ভূমিকা পালন করব। শুধু বিরোধিতাই আমাদের উদ্দেশ্য নয়।” বিমানবাবুর প্রশ্ন, “সরকার গড়ে ওঠার আগে বিভিন্ন সময়ে ওরা বলেছিল, মানুষকে খাবার, কাজ দেবে। কিন্তু এখন রাজ্য সরকার মানুষকে খাবার, কাজ দিতে কর্মসূচি নিচ্ছে? না দান-ধ্যান করে হাততালি কুড়োনোর প্রয়াস চালাচ্ছে?” এই সূত্রেই পাহাড়-প্রসঙ্গ তুলে বিমানবাবুর বক্তব্য, “সরকারে আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, তুড়ি মেরে কয়েক মিনিটে পাহাড় সমস্যার সমাধান করেছেন! এখন কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে! তরাই-ডুয়ার্স পর্যন্ত সমস্যা বেড়েছে।” বিমানবাবুও বুঝিয়েছেন, রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আন্দোলন বা প্রতিবাদের নামে ‘হঠকারিতা’র পথে যেতে চাইছেন না তাঁরা।
বিশ্ব জুড়ে আর্থিক সঙ্কটের কথা বলতে গিয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে এ দিন এক হাত নিয়েছেন বুদ্ধবাবু। বলেছেন, “আমাদের দেশে মনমোহন সিংহ অন্য পথে যেতে রাজি নন! ওঁর রাতে ঘুম হচ্ছে না খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না বলে! কংগ্রেস অন্য পথে যেতে পারবে না!” আর তার আগে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন থেকে কমিউনিস্টরা কী ভাবে শিক্ষা নিয়েছেন এবং জোরালো সওয়াল করেছেন চিনের ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’র পরীক্ষার দিকে নজর রাখার পক্ষে। তাঁর বক্তব্য, “সামাজিক মালিকানা মানে শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানা নয়। সোভিয়েতের ভুল চিন করেনি। সমবায়, যৌথ মালিকানা চিন মেনে নিয়েছে। বাজারের একটা ভূমিকা থাকবে কিন্তু রাষ্ট্র তাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখবে, এটা চিন বুঝেছে। রেস্তোরাঁ পরিচালনাও যদি রাষ্ট্র হাতে রাখে, তা হলে মুশকিলে পড়তে হবে!” বুদ্ধবাবুর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, প্রাথমিক সমাজতন্ত্র থেকে আরও ‘উন্নত স্তরে’ যেতে হবে এই যুক্তিতেই চিন পুঁজিবাদ নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। ‘ব্যক্তি পুঁজি’কে কিছুটা অনুমোদন করার ফলে তার সঙ্গে দুর্নীতি, স্বজনপোষণের মতো ‘বিপদ’ও ডেকে এনেছে। কিন্তু ‘আত্মবিশ্বাসে’র সঙ্গেই সেই বিপদের মোকাবিলা তারা করছে। বুদ্ধবাবুর কথায়, “চিনে যা হচ্ছে, সেটা শুধু তাদের নয়, গোটা পৃথিবীর সমাজতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা!” |