তদন্তের কিনারায় এবং দোষীদের শাস্তি দিতে ‘ফরেন্সিক’ বিভাগ বিনা গতি নেই পুলিশের। কিন্তু কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে রয়েছে সেই বিভাগটিই। ফলে দু’মাসে যে রিপোর্ট পাওয়ার কথা, তা পেতে বেশির ভাগ সময়েই গড়িয়ে যাচ্ছে প্রায় দু’বছর।
যেমন, বাঁকুড়া বা কেতুগ্রামের ধর্ষণের মামলাই ধরা যাক। বাঁকুড়ায় এক ‘মূক ও বধির’ তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল সেখানকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক হাউসস্টাফের বিরুদ্ধে। আর কেতুগ্রামে কাটোয়াগামী ছোট রেলে মেয়ের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে মাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে ধর্ষণ করার অভিযোগ ওঠে। দু’টি ঘটনাই শোরগোল ফেলে দিয়েছিল রাজ্যে। অথচ, তার পরে প্রায় দু’মাস কেটে গিয়েছে। ওই দুই ঘটনার তদন্তে ফরেন্সিক রিপোর্টই এখনও জমা পড়েনি। এ নিয়ে পুলিশের অবশ্য হেলদোল নেই। তদন্তকারী অফিসারদের বক্তব্য, “এ আর নতুন কী! এমনিই রিপোর্ট জমা পড়তে বছর ঘুরে যায়।”
পুলিশের পোড়খাওয়া এক অফিসারের কথায়, “এ রাজ্যে এমনটাই দস্তুর। ফরেন্সিক রিপোর্ট ঠিক সময়ে পেলে দু’তিন মাসের মধ্যেই চার্জশিট পেশ করা যায়। কিন্তু সদিচ্ছা থাকলেও তা সম্ভব হয় না। বছর ঘুরে যাওয়ার পরেও রিপোর্ট না মেলায় অনেক ক্ষেত্রে মামলাই লঘু হয়ে যায়।”
খালি চোখে দেখা যায় না, এমন অনেক সূত্র থেকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে অপরাধীকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি। আদালতে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময়ই অকাট্য প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয় তাদের রিপোর্টকে। কিন্তু রাজ্যের ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির বিষয়টি নজরে এসেছে খোদ কলকাতা হাইকোর্টেরও। |
গত বছরই মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির একটি মামলায় অনেক দিন কেটে যাওয়ার পরেও রিপোর্ট জমা না-পড়ায় কলকাতার ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির ডিরেক্টরকে ডেকে পাঠায় হাইকোর্ট। তদানীন্তন ডিরেক্টর ধুর্জটি সেনগুপ্ত আদালতকে জানান, পর্যাপ্ত কর্মী না-থাকাতেই সময় মতো রিপোর্ট তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না।
এই তথ্য জানার পরে হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে এক বছরের মধ্যে ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির শূন্য পদ পূরণের নির্দেশ দেয়। কিন্তু বছর ঘুরে যাওয়ার পরেও ল্যাবরেটরির হাল রয়ে গিয়েছে সেই তিমিরেই। কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ অফিসারের কথায়, “ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির এই অবস্থা হওয়ায় আমাদের যেখানে সুযোগ থাকে সেখানে আমরা কলকাতার সেন্ট্রাল ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির শরণ নিই।”
রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে বিভাগ রয়েছে মূলত আটটি। বায়োলজি, ব্যালিস্টিক, টক্সিকোলজি, কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, ফুটপ্রিন্ট, কোয়েশ্চেন ডকুমেন্ট ও ফটো সেকশন। এর বেশির ভাগই কর্মীর অভাবে ধুঁকছে। সব মিলিয়ে কর্মী থাকার কথা ২০১ জন। রয়েছেন মাত্র ১০৮ জন। ফরেন্সিক রিপোর্ট তৈরিতে যে দু’ধরনের কর্মীর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি তাঁরা হলেন, ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং টাইপিস্ট। ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্টের অনুমোদিত পদ ২২টি। রয়েছেন তিন জন। অন্য দিকে, প্রায় সারা রাজ্যের রিপোর্ট লেখার জন্য টাইপিস্টের অনুমোদিত সংখ্যা চার। তার মধ্যেও এখন একটি পদ খালি।
রাজ্যে কলকাতা ছাড়া ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি রয়েছে একমাত্র জলপাইগুড়িতে। আধুনিক তদন্তে ফরেন্সিকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে কয়েক বছর আগে দুর্গাপুর, মেদিনীপুর, মালদার মতো রাজ্যের আরও কয়েকটি শহরে ফরেন্সিক তদন্ত কেন্দ্র খোলার কথা হয়। কিন্তু কর্মীর অভাবে পুরনো কেন্দ্রগুলি ধুঁকতে থাকায় নতুন কেন্দ্র খোলাই যায়নি।
এক পদস্থ পুলিশ অফিসারের কথায়, “যে সব মামলা নিয়ে হইচই হয়, সে সব ক্ষেত্রে ‘বিশেষ নোট’ পাঠানো হয়। সে ক্ষেত্রে একটু দ্রুত রিপোর্ট আসে। অথচ, ফরেন্সিক রিপোর্ট না এলে চার্জশিটও পেশ করা যায় না।”
কর্মীর অভাব কেন?
স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার কথায়, “আগে ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে সরাসরি নিয়োগ হত। পিএসসি-র মাধ্যমে নিয়োগ চালু হওয়ার পর থেকে পুরো প্রক্রিয়াটাই অনেক সময়সাপেক্ষ হয়ে গিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সংরক্ষিত পদে প্রার্থীই মিলছে না। সে ক্ষেত্রে সেই পদটিকে অসংরক্ষিত করা আরও সময়সাপেক্ষ। এ সব কারণেই ধীরে ধীরে খালি পদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন তা বিরাট হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
সরকারি ফাইলের ফাঁস থেকে বেরিয়ে এই বিরাট সংখ্যক কর্মীর অভাব কী ভাবে মিটবে, তার সদুত্তর দিতে পারছেন না কেউই। |