রাজ্যের ঋণের বোঝা নিয়ে কী করা যায় তা খতিয়ে দেখতে তিনি আগেই উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছেন বলে জানিয়ে দিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। এই ঋণের জন্য দেয় সুদ তিন বছর মকুবের দাবি জানিয়ে আসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত কালই কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়ে বলেছেন, ১৫ দিনের মধ্যে দাবি মানা না-হলে এটা ‘বড় ইস্যু’ হয়ে যাবে। মমতার এই হুঁশিয়ারি ঘিরে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। রাজ্যের কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, রাজ্য সরকার কাচের ঘরে বসে ঢিল ছুড়ছে। এ সব করে লাভ হবে না। অন্য দিকে প্রণববাবুও প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই ‘হুঁশিয়ারির’ প্রয়োজন ছিল না। কারণ, কেন্দ্র ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ করেছে।
বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের বৈঠকে যোগ দিতে প্রণববাবু এখন ওয়াশিংটনে। সেখানেই এক সাংবাদিক বৈঠকে মমতার হুঁশিয়ারি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি যা রিপোর্ট পেয়েছি, তাতে উনি (মমতা) ৪ মে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন। তার পরেই বোঝা যাবে উনি কী করতে চান। কিন্তু আমি ইতিমধ্যেই ব্যয়সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে সমস্যাটা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছি।”
ক্ষমতায় আসার প্রথম দিন থেকেই রাজ্যের ঘাড়ে চেপে থাকা ঋণ নিয়ে অসন্তোষের কথা ব্যক্ত করছেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, বাম আমলের এই ‘পাপের বোঝা’ তিনি বহন করবেন কেন! প্রায় দু’লক্ষ কোটি টাকা ঋণের জন্য সুদ ও আসল মিলিয়ে রাজ্যকে প্রতি বছর ২২ হাজার কোটি টাকা দিতে হয় বলে তাঁর দাবি। যার মধ্যে সুদের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা তিন বছরের জন্য মকুব করার দাবি নিয়ে গত এগারো মাসে দফায় দফায় প্রণববাবু ও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কাছে দরবার করেছেন মমতা। কিন্তু কেন্দ্র এখনও সাড়া না দেওয়ায় গত কাল ডব্লিউবিসিএস অফিসারদের এক অনুষ্ঠানে চরমসীমা দিয়েছেন তিনি।
সমস্যা খতিয়ে দেখার কথা বললেও কেন্দ্র এ ব্যাপারে কী করতে পারে তা নিয়ে আজ স্পষ্ট করে কিছু জানাননি প্রণববাবু। তাঁর কথায়, “সেটা এখনই বলা মুশকিল। তবে সংসদে কেন্দ্রীয় বাজেট নিয়ে বিতর্কের জবাবি বক্তৃতায় আমি বলেছি, ঋণ নিয়ে কয়েকটি রাজ্যের সমস্যা রয়েছে। ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে সব চেয়ে অসুবিধায় থাকা রাজ্যগুলি হল, কেরল, পঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গ। সেই সমস্যা কী ভাবে কাটানো যায় তা খতিয়ে দেখতেই ব্যয়সচিবের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা
হয়েছে।” পাশাপাশি রাজ্যের ঋণ সংক্রান্ত সমস্যা সাধারণ ভাবে যে অর্থ কমিশনই দেখে থাকে, সে কথাও জানিয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
মমতার ‘হুঁশিয়ারি’ নিয়ে প্রণববাবু সতর্ক প্রতিক্রিয়া দিলেও, (গত কাল কংগ্রেস মুখপাত্রও সাবধানী সুরে বলেছিলেন, একে হুঁশিয়ারি হিসেবে না-দেখে রাজ্যের স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি হিসেবেই দেখা উচিত) কড়া মন্তব্য করেছেন বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী। কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে অধীরবাবু অতীতে বহু বারই প্রকাশ্যে মমতার বিরোধিতা করেছেন। আজ শিলিগুড়ি মহকুমার বাতাসিতে ব্লক কংগ্রেস সম্মেলনে তিনি বলেন, প্রকাশ কারাটরা কংগ্রসকে হুমকি দেওয়ায় কী ফল হয়েছে তা থেকে তৃণমূল তথা রাজ্য সরকার শিক্ষা নিক। কারাটদের মতো যাঁরা চলে যাবেন তাঁরা ফিরবেন না।
অধীরবাবুর কথায়, “প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রশংসা করছে গোটা বিশ্ব। রাজ্যের উন্নতির জন্য অর্থের প্রয়োজনে তাঁর কাছে গিয়ে বলুন। আলোচনা করুন। তা না করে ধমকি দেওয়া হচ্ছে। আমাদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ তোলা হবে জানি। বলা হবে কেন্দ্র রাজ্যকে দেখছে না। রাজ্যের উন্নতি না-হওয়ায় বামেরাও কেন্দ্রের উপর দোষারোপ করেছে। একই ভাবে এই সরকার বলতে চাইছে, কেন্দ্র সাহায্য করছে না তাই পারছি না।”
অধীরবাবুর যুক্তি, এ ভাবে টাকা চাইলেই পাওয়া যায় না। দেশের সংবিধান আছে। ইচ্ছে করলেই প্রণববাবু টাকা দিতে পারেন না। তিনি বলেন, “সেই সংবিধান মুখ্যমন্ত্রীর জানা দরকার। একটা রাজ্যকে এ ভাবে টাকা দিলে অন্য রাজ্যও চাইবে।”
প্রকাশ্যে না বললেও কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের কর্তারাও এই একই যুক্তি দিচ্ছেন। উদাহরণ দিয়ে তাঁরা বলছেন, জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে মমতা এই দাবি তোলামাত্র তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা তার প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ইউপিএ সরকার শরিক দলকে বাড়তি সুবিধা দিলে তিনি সেটা ভাল ভাবে নেবেন না।
কিন্তু আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব মমতাকে চটাতে চান না বলেই দলীয় সূত্রের মত। বলা হচ্ছে, সেই কারণেই কংগ্রেস মুখপাত্র থেকে প্রণববাবু মমতার হুঁশিয়ারি নিয়ে সাবধানী মন্তব্য করেছেন। কিন্তু রাজ্য-রাজনীতির নিরিখে অধীরবাবুর সেই দায় নেই। তাই তিনি এই যুক্তিটা সরাসরি বলার ব্যাপারে সরব। |