সময়টা পাঁচের দশকের মাঝামাঝি। নবদ্বীপ থেকে বর্ধমানের কাঁইগ্রামে ভাড়া করা খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে গিয়েছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। খেলার শর্ত ছিল পেটভরা মাংস ভাত। পাঁচ গোলে জিতেছিলেন তাঁরা। যার তিনটেই ছিল অনিলবাবুর। আর তাতে বেজায় খুশি হয়ে কাঁইগ্রামের ক্লাবকর্তারা তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন তিনটে জ্যান্ত খাসি। পরের দিন সেই নধর তিন খাসি নিয়েই বাড়ি ফিরেছিলেন কর্নার কিকের জন্য বিখ্যাত অনিলবাবু। পরে তিনি কলকাতাতেও বহু দিন খেলেছেন।
এ গল্প এখন মুখেমুখেই ঘোরে। মফস্সলের ফুটবলে ভরপেট খাওয়ার বিনিময়ে খেলার চল আজ অতীত। এখন বরং বুট জার্সি বা অন্য খেলার সরঞ্জামের বিনিময়ে স্থানীয় ক্লাবগুলিতে খেলেন ফুটবলারেরা। তবে সেখানেও এখন পরিবর্তনের হাওয়া। বছর কয়েক ধরেই মফস্সলের ফুটবলে টাকার প্রভাব বাড়ছে। জেলার বিভিন্ন ক্লাবে সরাসরি টাকার বিনিময়ে চুক্তি করছেন ফুটবলারেরা। দর ওঠানামা করছে ২০০ থেকে ৫০০০ পর্যন্ত। আবার বাইরে থেকে খেলোয়াড় আনতে গেলে তা মাথা পিছু ৭-৮ হাজারেও পৌঁছচ্ছে। ফলে ৩৫-৪০ হাজারের কমে কোনও ক্লাবের বাজেট তৈরি করা সম্ভবই হচ্ছে না। জেলার অন্যতম বড় ক্লাব নদিয়া ক্লাবের ক্রীড়াকর্তা গোবিন্দ বাগ বলেন, “খেলার সাজ-সরঞ্জাম, বুট, জার্সি দিয়ে ফুটবল খেলানোর দিন শেষ। প্রথমে কিছু কিছু ভাল খেলোয়াড়কে একটা মরসুমের জন্য দু-পাঁচশো টাকা দেওয়া হত। এখন প্রতিটি খেলোয়াড় প্রত্যেক ম্যাচ পিছু একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নেয়। সেটা ২০০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত হতে পারে। আমরা এবার পুরো মরসুমের জন্য ৫০ হাজার টাকা রেখেছি।” এবার নদিয়া ক্লাব সিনিয়র, জুনিয়র এবং সাব জুনিয়র তিনটে দল গড়ছে। অনূর্ধ্ব ১৯ দলের খেলোয়াড়দের টাকা না দিলেও বড়দের ম্যাচ পিছু পাঁচশো টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। প্রায় আট বছর পরে নতুন করে ফুটবল দল গড়ছে নবদ্বীপের আজাদ হিন্দ ক্লাব। ক্লাবের সম্পাদক সুব্রত দত্ত বলেন, “আট বছর আগে আমরা খেলা ছেড়েছি। এই ক’বছরে পুরোটাই বদলে গিয়েছে। আগে সবসময় বুট, জার্সিও ক্লাব দিত না। টুনার্মেন্ট জিতলে বা লিগ চ্যাম্পিয়ন হলে একটা বড় খাওয়াদাওয়া, ব্যাস। অথচ এবারে বি ডিভিশনের টিমের জন্য ২০ জনকে নথিভুক্ত করেছি। ন্যুনতম ব্যায় ৪০ হাজার টাকা। প্রত্যেককে বুট, জার্সি-সহ সমস্ত সরঞ্জাম দিতে হবে। তিনজন অন্য ক্লাবের খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা দু’হাজার টাকা করে চেয়েছে। ক্লাব অনুমোদন দিলে তাদের নেওয়া হবে।”
বড়ালঘাট স্পোর্টিংয়ের লালটু ভুঁইয়া বলেন, “ম্যাচ পিছু টাকার অঙ্ক ঠিক করে নিয়ে চুক্তি করা সর্বত্রই চালু হয়ে গিয়েছে। আমাদের ক্লাবের প্রথম আর জুনিয়ার ডিভিশনের জন্য ৩৪ জন খেলোয়াড়ের নাম নথিভুক্ত করানো হয়েছে। তাদের ম্যাচ পিছু ৩০০-৩৫০ টাকা দিতে হবে।” তবে তিনি জানান, সমস্যাটা টাকার থেকেও বেশি খেলোয়াড় নিয়ে। দু’একটা ক্লাব ছাড়া কেউ নতুন খেলোয়াড় তৈরি করতে পারছে না। তাঁর কথায়, “ফলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই মুখ বিভিন্ন ক্লাবে খেলছে। চাহিদা থাকায় তাদের দর বাড়ছে খুবই তাড়াতাড়ি। আবার নতুন খেলোয়াড় না থাকায় খেলার মানও পড়ছে। বহু ক্লাব আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় দল তৈরিই করতে পারছে না।” নবদ্বীপ জোনের রেফারি বোর্ডের সম্পাদক জয়ন্ত গোস্বামী বলেন, “মফস্সলের ফুটবলে টাকা বাড়ছে। এটা একদিকে ভাল। তবে খারাপ দিক হল কোনও ক্লাব আর খেটে খেলোয়াড় তৈরি করতে চাইবে না। প্রয়োজনে অন্য দল থেকে খেলোয়াড় ভাড়া করে কাজ চালাবে। তাতে স্থানীয় ফুটবল দেউলিয়া হয়ে যাবে।” |