রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে ভাঙচুর ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে মারধরের ঘটনার তিন দিনের মাথায় উত্তর দিনাজপুরের জেলা তৃণমূল সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল অসীম ঘোষকে। কলেজের গোলমালের ঘটনায় তিনি অভিযুক্তদের পাশে দাঁড়াননি এবং সেই কারণেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল বলে তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর। দলের এই সিদ্ধান্তে অসীমবাবু ‘হতাশ’ এবং ‘অপমানিত’। এর পিছনে ‘চক্রান্ত’ও দেখছেন তিনি। তবে, সে দিনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত, জেলা তৃণমূলের প্রাক্তন কার্যকরী সভাপতি তিলক চৌধুরীর বিরুদ্ধে এখনই কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না দল।
রবিবার রায়গঞ্জে নয়া জেলা সভাপতি হিসাবে ইটাহারের তৃণমূল বিধায়ক অমল আচার্যের নাম ঘোষণা করে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র অবশ্য দাবি করেন, কলেজের গোলমালের ঘটনার সঙ্গে অসীমবাবুকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, “অসীমবাবু দলের দুঃসময়ের সাথী ও সর্বক্ষণের নেতা। দল তাঁকে যোগ্য সম্মান দেবে। অমলবাবু বিধায়ক হিসাবে সরকারের প্রতিনিধি। যে কোনও ঘটনায় তিনি সরকারের সঙ্গে সরাসরি সমন্বয় রাখতে পারবেন। সংগঠক হিসাবেও তাঁর দক্ষতা রয়েছে। সব কিছু বিচার করেই অমলবাবুকে জেলা সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হল। তাঁকে দলের জেলা, ব্লক ও শহরের বিভিন্ন কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”
কিন্তু তৃণমূলের অন্দরের খবর, কলেজ-কাণ্ডে অসীমবাবুর ভূমিকা ভাল ভাবে নেননি দলের জেলা নেতাদের একাংশ। ‘দল ওই ধরনের কাজ সমর্থন করে না’ বা ‘আইন আইনের পথে চলবে’ বলে সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করে অসীমবাবু জেলা নেতাদের একাংশের রোষের মুখে পড়েন। নিজের ভাবমূর্তির স্বার্থে অসীমবাবু অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা-কর্মীদের পাশে দাঁড়াননি বলেও সম্প্রতি জেলা নেতাদের একাংশ রাজ্য নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ করেন। এমনকী, অভিযুক্ত তিলক চৌধুরী আদালতে আত্মসমর্পণ করার সময়েও অসীমবাবু আদালতে যাননি বলে অভিযোগ। তা ছাড়া, কলেজের গোলমালের ঘটনাও তিনি নির্দিষ্ট সময়ে দলের রাজ্য নেতাদের জানাননি বলে অভিযোগ রয়েছে জেলা নেতাদের। এ সবের জেরেই তাঁকে সরে যেতে হল। |
এ দিন ক্রীড়ামন্ত্রীর পাশেই বসেছিলেন অসীমবাবু। ওই বৈঠকে তিনি বলেন, “দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলব।” কিন্তু পরে ঘনিষ্ট মহলে দলীয় সিদ্ধান্তকে ঘিরে হতাশা চেপে রাখতে পারেননি। রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “আমি সব সময় দলকে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত রাখার চেষ্টা করেছি। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিইনি। তার পরেও কেন এ রকম সিদ্ধান্ত তা বুঝতে পারছি না। দুঃসময়ে দলের
সাথী ছিলাম। ভবিষ্যতেও দলের কর্মী হয়ে থাকব। এ রকম সিদ্ধান্তে অপমানিত এবং হতাশ বোধ করছি। আমি চক্রান্তের শিকার।” গত বৃহস্পতিবার যখন ওই কলেজে গোলমাল শুরু হয়, তখন তিনি ইটাহারে এক নিহত কর্মীর বাড়িতে গিয়েছিলেন বলে জানান অসীমবাবু। স্বীকার করেন, গোলমালের খবর পেতে দেরি হয়েছিল। তবে, পরে সব খবরই জানান রাজ্য নেতৃত্বকে।
তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৯ সালে অসীমবাবু দলের জেলা সভাপতির দায়িত্ব পান। দলে ‘নিরীহ’ বলে পরিচিত অসীমবাবুর বাড়ি রায়গঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে কালিয়াগঞ্জ শহরে। অন্য দিকে, গত বছর বিধানসভা নির্বাচনের সময় অমলবাবু কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়ে ইটাহার থেকে বিধায়ক হন। তাঁর প্রার্থী হওয়া নিয়ে তৃণমূলে দ্বন্দ্ব থাকলেও সম্প্রতি তাঁর নেতৃত্বেই তৃণমূল ইটাহারের একাধিক পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় আসে। কয়েক হাজার কংগ্রেস কর্মী-সমর্থক তৃণমূলে যোগ দেন।
তিলকবাবু এ দিন ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। কলেজে কী হয়েছিল, সেই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট তিলকবাবুর কাছ থেকে চেয়ে নেন ক্রীড়ামন্ত্রী। তিনি জানান, তিলকবাবুর বিরুদ্ধে এখনই রাজ্য নেতৃত্ব কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। রিপোর্ট খতিয়ে দেখার পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিলকবাবু-সহ অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনায় অভিযুক্তদের পাশেই দাঁড়িয়েছেন মদনবাবু। তিনি বলেন, “পুলিশ আইন অনুযায়ী কাজ করেছে। ভিডিও ফুটেজে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগের সত্যতা মেলেনি বলেই তাঁদের জামিনযোগ্য ধারায় মামলা দেওয়া হয়েছে বলে খবর পেয়েছি।”
তবে, কলেজে গোলমালের পিছনে কংগ্রেস ও সিপিএমের ‘ষড়যন্ত্র’ রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন মদনবাবু। তিনি বলেন, “কংগ্রেস ও সিপিএম আতাঁত করে রায়গঞ্জে দু’টি কলেজ পরিচালনা করছে। এসএফআইয়ের জেলা সম্পাদক প্রাণেশ সরকারের বিরুদ্ধে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে জামিন অযোগ্য মামলা রয়েছে। তাঁকে কংগ্রেস বাঁচাচ্ছে। সিপিএমের সাহায্য নিয়ে ইটাহারের মারনাইয়ে আমাদের দলের এক কর্মীকে খুন করা হয়েছে।”
একই সঙ্গে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার জেরে কলেজে গোলামাল হয় বলে অভিযোগ তুলে মদনবাবু বলেন, “কংগ্রেস ও সিপিএমের গুণ্ডামি আর বরদাস্ত করব না। জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলছি। প্রয়োজনে রায়গঞ্জে ক্যাম্প করে কংগ্রেস ও সিপিএমের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হবে।”
প্রত্যাশিত ভাবেই এই অভিযোগের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রায়গঞ্জের কংগ্রেস সাংসদ দীপা দাশমুন্সি। তিনি বলেন, “অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনায় তৃণমূল নেতারা এখন অভিযুক্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দলের নির্দেশে পুলিশ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে লঘু ধারায় মামলা করে জামিন পাইয়ে দিল। এসব ঘটনা জলের মতো পরিষ্কার। সত্য ঘটনা সামনে চলে আসায় এখন আমাদের বিরুদ্ধে তৃণমূল ইচ্ছেমতো অভিযোগ তুলে অপপ্রচারে নেমেছে। মানুষই সময়মতো সব বিচার করবেন।” প্রাণেশবাবু বলেন, “তৃণমূলের পুলিশ বাহিনী আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক স্বার্থে জামিন অযোগ্য ধারায় মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমাকে কেউ বাঁচাচ্ছে না। মদনবাবুরা যা ইচ্ছে বলতে পারেন।” |