সিগন্যালে গণ্ডগোল নয়। ফুলিয়া স্টেশনে দু’টি ট্রেনে মুখোমুখি সংঘর্ষের জন্য প্রাথমিক তদন্তে মানুষের ভুলকেই দায়ী করছেন রেলকর্তারা। প্রাথমিক ভাবে তদন্তকারীদের মনে হয়েছে, ফুলিয়া স্টেশনে ঢোকার মুখে শনিবার রাতে সিগন্যাল লাল করা ছিল। তা সত্ত্বেও ডাউন শান্তিপুর লোকাল ঢুকে পড়েছিল স্টেশনে। সেখানে একই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল আপ শান্তিপুর লোকাল। এবং তাতেই বিপত্তি।
তদন্তে নেমে রেল বোর্ডের কর্তারা দেখেছেন, দেশের প্রায় সর্বত্র রেলে প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হলেও পূর্ব রেলের রানাঘাট-শান্তিপুর শাখায় স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থা এখনও চালু হয়নি। ওই ব্যবস্থা চালু হলে এবং ফুলিয়া স্টেশনের আগে সিগন্যাল লাল থাকলে ডাউন শান্তিপুর লোকাল কোনও ভাবেই ওই লাইন দিয়ে ঢুকতে পারত না।
সে-ক্ষেত্রে সংঘর্ষ এড়ানো যেত কী ভাবে? |
রেলকর্তারা বলছেন, স্বয়ংক্রিয় ‘রুট রিলে ইন্টারলক সিস্টেম’ থাকলে এ ভাবে দু’টি ট্রেনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটতে পারে না। কারণ, সিগন্যাল অগ্রাহ্য করলেও ডাউন ট্রেনটি তখন অন্য লাইনে ঢুকে যেত। যে-লাইনে আপ ট্রেনটি ছিল, সেখানে সে যেতেই পারত না। “কিন্তু ফুলিয়ায় ওই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা নেই। এখানে পুরনো পদ্ধতিতে কাজ চলে,” জানালেন পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার জি এস অগ্রবাল। এখনও ওই শাখায় স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থা চালু হয়নি কেন, তা নিয়ে রেলকর্তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
প্রাথমিক তদন্তে শনিবার রাতের দুর্ঘটনার জন্য ডাউন শান্তিপুর লোকালের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকেই মূলত দায়ী করতে চেয়েছেন রেলকর্তারা। কিন্তু যাঁকে ঘিরে এই অভিযোগ, সেই ডাউন শান্তিপুর লোকালের চালক এস আর যাদব এখনও কথা বলার মতো অবস্থায় নেই বলে পূর্ব রেলের কর্তা জানান। রবিবার তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে কলকাতার বি আর সিংহ হাসপাতালে। রেল সূত্রের খবর, রাতে তাঁর হুঁশ ফিরেছে। রেল নিরাপত্তা বিভাগের তদন্তকারীরা আজ, সোমবার তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। দু’টি ট্রেনের দুই গার্ড এবং অন্য চালকও ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
রেল যে ঘটনাটিকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে, তা বোঝাতে এ দিন রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান বিনয় মিত্তলকে পাঠনো হয় ঘটনাস্থলে। তিনি দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন, কথা বলেন স্টেশনমাস্টার ও কেবিনম্যানের সঙ্গে। তবে দু’টি ট্রেনের চালক ও গার্ডদের সঙ্গে তিনি কথা বলতে পারেননি। প্রাথমিক তদন্তের পরে মিত্তল বলেন, “দু’টি ট্রেনের চালক ও গার্ডেরা ওই ঘটনার পর থেকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। তাই এখনই তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যাচ্ছে না। ঠিক কী ঘটেছিল, যত দ্রুত সম্ভব তাঁদের সঙ্গে কথা বলে তা জানার চেষ্টা করছি আমরা।”
রেল বোর্ডের সদস্য কুলভূষণকে নিয়ে ফুলিয়া স্টেশনের সিগন্যাল ব্যবস্থা খুঁটিয়ে দেখেন রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান। পরে তিনি মন্তব্য করেন, “প্রাথমিক ভাবে আমাদের মনে হচ্ছে, সিগন্যাল ব্যবস্থায় কোনও গণ্ডগোল নেই। স্টেশনমাস্টারেরও কোনও দোষ নেই।”
ডাউন শান্তিপুর লোকালের চালকই কি লাল সিগন্যাল অগ্রাহ্য করে স্টেশনে ঢুকে পড়েছিলেন?
মিত্তল বলেন, “সেটা তদন্ত করে দেখতে হবে।” শিয়ালদহের ডিআরএম সুচিত্র দাস বলেন, “ডাউন ট্রেনটির সিগন্যালে দাঁড়ানোর কথা। সিগন্যাল সবুজ হলে তার ছাড়ার কথা। কারণ, সিগন্যাল দেওয়া হলেই লাইন ভাগ হয়ে ওই ট্রেনটি অন্য প্ল্যাটফর্মে চলে যেত। এ ক্ষেত্রে তা হল না কেন, সেটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।” ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে এক রেলকর্তা বলেন, “ওই ট্রেনের চালকের সঙ্গে কথা না-বলা পর্যন্ত পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে না। চালককে কেউ ইচ্ছে করে ফাঁসাতে চাইছে কি না, সেটা দেখাও কর্তব্য।”
রেলকর্তাদের প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, ওই রাতে স্টেশনের দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে নির্দিষ্ট সময়েই এসে দাঁড়িয়ে ছিল আপ ট্রেনটি। ফুলিয়া থেকে শান্তিপুর পর্যন্ত রেলের এই শাখায় একটি লাইন দিয়েই ট্রেন চলাচল করে। সে-ক্ষেত্রে একটি ট্রেন স্টেশনে চলে এলে উল্টো দিক থেকে আসা ট্রেনটিকে স্টেশনের আগেই লাল সিগন্যাল দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। তার পরে তাকে অন্য লাইনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করানো হয় অন্য প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ডাউন ট্রেনটি লাল সিগন্যাল অগ্রাহ্য করায় তাকে অন্য লাইনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি বলে কর্তাদের প্রাথমিক ধারণা।
স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য চালকের ভুলের বিষয়টি মানতে চাইছেন না। সম্রাট পোদ্দার নামে এলাকার এক বাসিন্দার কথায়, “কোনও চালকই নিজের জীবন বিপন্ন করে সিগন্যাল অগ্রাহ্য করবেন না।”
স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করেন, ডাউন ট্রেনের চালক তো বুঝতেই পারছিলেন যে, একই লাইনে অন্য ট্রেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তখন তিনি ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবন বাঁচাতে পারতেন। তিনি তা না-করে শেষ পর্যন্ত ট্রেনের গতি রোধের চেষ্টা করেছিলেন। তাতে তিনি অনেকটা সফলও হন। সঞ্জয় সরকার নামে অন্য এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “ট্রেনটি পূর্ণ গতিতে থাকলে অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। চালকই বরং গতি কমিয়ে দুর্ঘটনা এড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন।”
স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, কেবিনের রেলকর্মীরাই ভুল সিগন্যাল দেখিয়ে চালককে বিভ্রান্ত করেছেন। ক্ষিপ্ত জনতা শনিবার রাতে প্রথমে কেবিনের দিকে ঢিল ছোড়ে। তার পরে দোতলা কেবিনে উঠে পড়ে। সেই সময় ডেপুটি স্টেশন ম্যানেজার প্রদীপ দে পিছনের একটি জানলা থেকে ঝাঁপ মেরে নীচে পড়ে গুরুতর জখম হন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিরঞ্জন ঘোষকে মারধর করে উত্তেজিত জনতা। প্রদীপবাবু ও নিরঞ্জনবাবুকেও কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শনিবারের দুর্ঘটনার পরে রবিবার সকাল পৌনে ৮টা নাগাদ ওই শাখায় ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
দু’টি ট্রেনের ওই সংঘর্ষে এক গেটম্যানের মৃত্যু হয়েছে। তবে আহতের সংখ্যা কত, তা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, “আহত হয়েছেন ২৭ জন। তাঁদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হবে।” তবে নদিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক শ্রীকুমার চক্রবর্তী বলেন, “আহতের সংখ্যা ৭৩। প্রয়োজনমতো তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আহতদের ছ’জন এখনও রানাঘাট ও শান্তিপুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।” |