সিন্ডিকেট শব্দটির মূল অর্থ: স্বগঠিত গোষ্ঠী, বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যাহার সদস্যরা সংগঠিত হন। কালক্রমে শব্দটিতে নূতন মাত্রা সংযোজিত হইয়াছে। উনিশ শতকের শেষপর্বে ইউরোপের সিন্ডিকালিস্ট আন্দোলনের প্রধান ধারাটির মূল আদর্শ ছিল রাষ্ট্রের বিলোপ শিল্পের বিভিন্ন পরিসরে গড়িয়া ওঠা সিন্ডিকেটগুলিই শিল্প নিয়ন্ত্রণ করিবে, অর্থনীতি তথা সমাজের রশিও তাহাদের হাতেই চলিয়া যাইবে, রাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমে লুপ্ত হইবে। সাধারণ ভাবে এই তত্ত্ব সত্য হয় নাই, রাষ্ট্র আজও প্রবল ও দুর্মর। কিন্তু পাশাপাশি সিন্ডিকেটও বিলুপ্ত হয় নাই। অন্তত এই পশ্চিমবঙ্গে তাহা কেবল জীবিত নহে, তাহারাই ‘জাগ্রত দেবতা’স্বরূপ তাহাদের তুষ্ট রাখিলে অভীষ্ট ফল লাভ হয়, তাহারা কুপিত হইলে ধনেপ্রাণে মারা পড়িতে হয়। প্রোমোটার, ইমারত নির্মাণের উপকরণের জোগানদার, জমি ও বাড়ির ব্যবসায়ে মধ্যস্থতাকারী এবং অন্য নানা বর্গের উদ্যোগে স্থানীয় গোষ্ঠীগুলি তৈয়ারি হয়, তাহাতে যোগ দেয় স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি, নানা নামের আড়ালে যাহারা প্রকৃতপক্ষে গুণ্ডা বা মস্তান। বাড়ি করিতে চাহিলে ইহাদের খুশি করিতে হয়, ইহাদেরই নির্দেশিত জোগানদারের নিকট উপকরণ কিনিতে হয়। কারখানা গড়িতে চাহিলে দাবি আড়ে এবং বহরে বাড়িয়া যায়, ‘আমাদের লোক’কে চাকুরি দিবার দাবিও যুক্ত হয়। অর্থাৎ, নিজস্ব উদ্দেশ্য সাধনে নিজেদের দ্বারা গঠিত গোষ্ঠীই নিজ নিজ অঞ্চল শাসন করে। ধ্রুপদী অর্থে সিন্ডিকেট রাজ!
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করিয়াছিলেন, স্থানীয় স্বার্থচক্রের এই দাপট ভাঙিবেন। এই ঘোষণার রাজনৈতিক মাত্রা অবশ্যই ছিল। বামফ্রন্ট আমলে পাড়ায় পাড়ায় সিন্ডিকেটের উত্থান ও প্রসারের কাহিনি সুবিদিত। ‘বেদিক ভিলেজ’ কাণ্ড বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। দীর্ঘ শাসন ও সর্বগ্রাসী দলতন্ত্রের কল্যাণে বহু সিন্ডিকেটই সি পি আই এমের করায়ত্ত হইয়াছিল। স্বগঠিত গোষ্ঠীগুলি দলকে ব্যবহার করিয়াছিল, দলও তাহাদের কাজে লাগাইয়াছিল। কিন্তু ইহা কেবল সি পি আই এমের ব্যাপার ছিল না। থাকিবার কথাও নয়। যেখানে যে দল প্রবল, সেখানকার সিন্ডিকেট তাহার সহিত গাঁটছড়া বাঁধিবে, এই মডেলে ইহাই প্রত্যাশিত। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সহিত তাহার ‘সিন্ডিকেট-সম্পদ’ও সমৃদ্ধ হইবে, ইহাই প্রত্যাশিত। অবশেষে মহাকরণে পালাবদলের অভিঘাতে স্থানীয় রাজনীতির পুরানো ভারসাম্য বিপর্যস্ত হয়, এলাকা দখলের অনিবার্য লড়াইয়ে সিন্ডিকেটগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এই প্রেক্ষিতেই সিন্ডিকেট ভাঙিবার প্রতিশ্রুতি। ইহা প্রশাসনের, অর্থাৎ প্রকৃষ্ট শাসনের প্রতিশ্রুতি। রাজধর্ম পালনে তিনি দল বিচার করিবেন না, এই আশ্বাসও মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় নিহিত ছিল। সিন্ডিকেট ভাঙিবার সেই আহ্বানের প্রতিধ্বনি শোনা গেল সম্প্রতি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কণ্ঠে। ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী দলীয় সম্মেলনের মঞ্চে জানাইলেন, দলের কর্মীরা বিভিন্ন স্বার্থচক্রে জড়াইয়া পড়িয়াছে, তাহা ভাঙিতে হইবে। দলের ‘শুদ্ধিকরণ’-এর আহ্বান সি পি আই এমের নেতাদের কণ্ঠে প্রথম শোনা গেল তাহা নহে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে, বুদ্ধদেববাবু যখন উচ্চকণ্ঠে এই প্রচার করেন, তাহা শুনিয়া বলিতে হয়, তবে আর বিলম্ব কীসের? মুখ্যমন্ত্রী এবং ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী, প্রধান শাসক দল এবং প্রধান বিরোধী দল যখন সমস্বরে সিন্ডিকেট ভাঙিবার ডাক দিয়াছেন, তখন সিন্ডিকেটগুলি ভাঙিয়া দিলেই হয়! পশ্চিমবঙ্গে সচরাচর সব বিষয়েই দুই দলের মত আড়াআড়ি দুই ভাগে বিভক্ত, এ দল সূর্যকে পূর্ব দিকে উঠিতে দেখিলে ও দল পশ্চিমে সূর্যোদয় দেখে। এই দল-দ্বন্দ্বের তাড়নায় পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ আসিতে চাহিয়াও ভয়ে পিছাইয়া যায়। এ হেন রাজ্যে যদি দুই প্রধান দল একটি বিষয়ে একমত হয়, অবিলম্বে শুভকর্ম সম্পাদন করিয়া ফেলা উচিত। তবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভরসা করিতে ভরসা পাইবেন কি? মমতাদেবী এবং বুদ্ধদেববাবু, উভয়েরই সদিচ্ছা হয়তো সংশয়াতীত, কিন্তু তাঁহাদের দলের বিবিধ স্তরে যে সব ‘স্বগঠিত স্বার্থগোষ্ঠী’ সক্রিয়, তাহারা সেই সদিচ্ছা পূর্ণ হইতে দিবে কি? সিন্ডিকেট অতি বিষম বস্তু। |