অনুষ্ঠান জুড়ে রইল কলকাতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খিদিরপুর ডকের উল্লেখ হল বারবার। শুধু পশ্চিমবঙ্গই অনুপস্থিত রইল প্রবাসী ভারতীয় দিবসে।
অথচ রাজস্থান-রাজধানীতে কেন্দ্রীয় সরকার আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়ে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং এসেছেন। এসেছেন ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন মুণ্ডা। বিহার-গোয়া-কেরল নিয়ে অধিবেশন হচ্ছে। কিন্তু সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের কোনও স্টল তো নেই-ই, অনাবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে আসেননি রাজ্যের কোনও সরকারি প্রতিনিধি। কাজেই উৎসাহী প্রবাসীরা পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে খবরাখবর জানতে চেয়েও হতোদ্যম। কার কাছে জানবেন?
আর তিন দিন পর ১১ জানুয়ারি। ঠিক এক বছর আগে খিদিরপুর বন্দরে একটি ফলক বসানো হয়েছিল। বহু যুগ আগে যেখান থেকে জাহাজের খোলে চেপে লক্ষাধিক মানুষের বিদেশপাড়ির স্মারক হিসেবে। শ্রমিকের কাজ করতে যাওয়া সেই সব মানুষগুলির উত্তরসূরিদের অনেকে আজ স্বনামধন্য। কেউ নামী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাথা। এমনকী, কেউ কোনও দেশের প্রধানমন্ত্রীও!
ত্রিনিদাদ-টোব্যাগোর প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী কমলাপ্রসাদ বিশেসার এঁদেরই এক জন। আজ সকালে এ শহরের বিড়লা অডিটোরিয়ামে প্রবাসী ভারতীয় দিবসের উদ্বোধনে যিনি ছিলেন প্রধান অতিথি।
দেশি-বিদেশি হাজার দেড়েক অভ্যাগতের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িতে সজ্জিতা কমলাদেবীর মন্তব্য, “রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তুমি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকলে নদী পার হতে পারবে না। তোমাকে চেষ্টা করতে হবে নদী পেরনোর। সেই চেষ্টার ফসল বিশ্বময় ভারতীয় বংশোদ্ভূতেরা দেখিয়ে আসছে।” বললেন, “আমাদের পূর্বপুরুষ এ দেশ থেকে চলে গিয়েছিলেন। আমরা এখন বংশ পরম্পরায় অন্য দেশের নাগরিক। কিন্তু ত্রিনিদাদ-টোব্যাগো হোক, বা আমেরিকা, আমরা এখন সর্বত্র ভারতেরই ঠাকুমা-দিদিমা, ঠাকুর্দা-দাদু।” সারা প্রেক্ষাগৃহ তখন উচ্ছ্বসিত। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও করতালি দিয়ে চলেছেন।
কমলাদেবীর বক্তব্যে যেমন রবীন্দ্রনাথ, তেমন এর আগে কেন্দ্রের অনাবাসী ভারতীয় সংক্রান্ত বিষয়ক মন্ত্রী ভায়লার রবির বক্তৃতায় বারবার উঠে এসেছে কলকাতা ও খিদিরপুর। ১৮৩৪ থেকে ১৯২০-র মধ্যে মূলত উত্তরপ্রদেশ, বিহারের প্রায় দেড় লক্ষ মানুষকে খিদিরপুর ডকে নোঙর করা জাহাজের খোলে পুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মরিশাস, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিজি, গায়ানা, সুরিনাম ইত্যাদি দেশে। যাঁদের স্মরণে গত বছর ১১ জানুয়ারি খিদিরপুরে ভায়লারই বসিয়ে গিয়েছিলেন ওই স্মৃতিফলক। এবং যার সূত্রে দশম বার্ষিক প্রবাসী ভারতীয় দিবসে কলকাতার নাম এখন অতিথিদের মুখে মুখে ফিরেছে।
শুধু অনাবাসীরাই বা কেন? এখানে আগত মিত্তল, বিড়লা, বাঙুর, খেতান বা গোয়েন্কার মতো বহু শিল্পপতি পরিবারেরই আদি উত্থান পশ্চিমবঙ্গ। উদ্বোধনের পরে মধ্যাহ্নভোজের আসরে যখন অনেক ‘বিদেশি’ ভারতীয় কলকাতায় অন্তত এক বার পা রাখার ইচ্ছে প্রকাশ করছেন, দেখা গেল, এ দেশের ওই সব শিল্পপতি পরিবারের কয়েক জনও তাঁদের উৎসাহ দিচ্ছেন। ‘উৎসাহিত’ অনেকে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে নানা খোঁজ-খবর নিতে দৌড়লেন। কেউ কেউ জানতে চাইলেন, পশ্চিমবঙ্গের কোনও স্টল আছে কি না। অন্তত রাজ্যের কোনও পদাধিকারী কোনও সেমিনারে দু’কথা বলবেন কি না।
ওঁদের কোনও উদ্দেশ্যই সফল হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত, রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী এখানে এসেছেন বলে জানালেন কলকাতায় রাজস্থান ফাউন্ডেশনের সন্দীপ ভুতুরিয়া। কিন্তু রাজ্য সরকারের তরফে পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বের খোঁজ মেলেনি কোথাও। অথচ এই সম্মেলন উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের অর্থানুকূল্যে জয়পুর শহরের আপাদমস্তক ঝকঝকে করে তোলার পাশাপাশি আগত অনাবাসীদের সঙ্গে প্রায় ৯৪ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ-চুক্তি সেরে ফেলেছে রাজস্থান সরকার। মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত নিজেই সগর্বে তা জানিয়েছেন। লগ্নির সন্ধানে গুজরাত-ঝাড়খণ্ড-বিহার-কেরলও হাজির।
কিন্তু কেন্দ্রীয় উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রণ তো সব রাজ্যই পেয়েছে! পশ্চিমবঙ্গ সরকারকেও যথাসময়ে পাঠানো হয়েছে বলে কেন্দ্রীয়-সূত্রের দাবি। তাতে সাড়া দিয়ে সুইৎজারল্যান্ডের মঙ্গত শর্মা, বা দক্ষিণ আফ্রিকার রমেশ গাঁধীদের আগ্রহ কি মেটাতে পারত না রাজ্য? লগ্নি আকর্ষণের সুযোগ এতে কিছুটা হাতাছাড়া হল না কি?
রাজ্য সরকারের অনাবাসী সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত যিনি, সেই অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে চাননি। তবে এ দিন কলকাতায় তিনি বলেন, গত ক’মাসে যত জন অনাবাসী নিজেদের প্রশ্ন নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সকলকে সদুত্তর দেওয়া হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্য বা গবেষণার মতো ক্ষেত্রে রাজ্যের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে যাঁরা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও তাঁর দাবি। “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চান, অনাবাসীরা আসুন। আমরা সব রকম সহযোগিতায় তৈরি।” বলেন অমিতবাবু। |