শিল্প সম্মেলনের নাম ‘বেঙ্গল লিডস।’ কিন্তু সে নামের তাৎপর্য কোনও ভাবেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আমন্ত্রিত-তালিকা বা অনুষ্ঠানসূচিতে। বরং শিল্পমহলের মনে ধন্দ, এই মুহূর্তে শিল্পক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এমন কোন ক্ষেত্রে এগিয়ে, যা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরে লগ্নি টানার দৌড়ে নামতে পারে এ রাজ্য?
রাজ্য সরকারের উদ্যোগে আজ সোমবার মিলনমেলা প্রাঙ্গণে শুরু হচ্ছে এই শিল্প সম্মেলন। এটিকে আন্তর্জাতিক স্তরের শীর্ষ শিল্প সম্মেলন (গ্লোবাল সামিট) বলে রাজ্য সরকার দাবি করলেও তা কার্যত আঞ্চলিক সম্মেলনে পর্যবসিত হবে বলে শিল্পমহলে আশঙ্কা রয়েছে। অনুষ্ঠানসূচিও বলছে, তাঁদের আশঙ্কার ভিত্তি রয়েছে। কারণ, সেই সূচিতে গুটিকয়েক আমলা ছাড়া বিশ্ব বাজারের প্রতিনিধি বলতে আছেন শুধু গাড়ি সংস্থা জেনারেল মোটরসের কর্তা ক্রিস্টোফার বার্ড।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অবশ্য আসছেন সজ্জন জিন্দল। রাজ্যের দাবি, ছ’দিনের এই শিল্প সম্মেলনে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিট্জ ছাড়াও থাকবেন শিল্পপতি এস কে বিড়লা, যোগী দেবেশ্বর, বেণু শ্রীনিবাসন ও তাঁর স্ত্রী মল্লিকা শ্রীনিবাসন, পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়, প্রসূন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। অন্য দিকে শিল্পমহলের বক্তব্য, এই সব শিল্পোদ্যোগীর প্রায় সকলেরই পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ রয়েছে। ‘কিন্তু তথাকথিত গ্লোবাল সামিটে রাজ্যকে তুলে ধরার মতো উদ্যোগ কোথায়?’ প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। শিল্পমহলের এই অংশের আক্ষেপ: গুজরাতে শিল্প-সম্মেলনের কথা উঠলেই যেখানে তাবড় শিল্পপতিদের লম্বা তালিকা নিমেষে চোখের সামনে ভেসে ওঠে, এখানে তা নজরে পড়ছে না। উপরন্তু রাজ্য সরকার অম্বানী ভাইদের আমন্ত্রণ জানানোর কথা বললেও অনুষ্ঠানসূচি কিংবা সম্মেলনের ওয়েবসাইট কোথাও তাঁদের আসার কথা নেই!
এই অনাগ্রহের কারণ কী হতে পারে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু শিল্প-কর্তার ব্যাখ্যা: জমি-নীতি সহ স্বচ্ছ শিল্পনীতির অভাবই লগ্নিকারীদের কাছে পশ্চিমবঙ্গকে কিছুটা ব্রাত্য করে তুলছে। তা ছাড়া রাজ্যের কোষাগারে টানাটানি। বিকল্প আয়ের দিশাও অমিল। ফলে পরিকাঠামো নির্মাণেও অর্থাভাবের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যেমন, মাসুল না-বাড়লে ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির মোকাবিলা কী ভাবে করা হবে, তা স্পষ্ট নয়। এঁদের প্রশ্ন, “গ্রীষ্মে লোডশেডিং হলে গৃহস্থেরই যেখানে চরম সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা, সেখানে কোন ভরসায় লগ্নিকারীরা বিদ্যুৎ পাওয়ার আশা করবেন? আর বিদ্যুৎ না পাওয়া গেলে উৎপাদন হবে কী করে?”
এর সঙ্গে জুড়েছে সংস্কার নিয়ে বারবার কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের বিরোধ। শিল্প-কর্তাদের একাংশের অভিযোগ: সংস্কার-বিরোধী রাজ্য সরকার লগ্নি-সহায়ক পরিবেশ কী ভাবে তৈরি করবে, এখনও তার স্পষ্ট দিশা নেই।
বরং লগ্নির প্রতি রাজনৈতিক মনোভাব ‘অন্য রকম’ হওয়ায় এ রাজ্যে টাকা ঢালতে দু’বার ভাবছেন উদ্যোগীরা। তাই শিল্প সম্মেলনে যোগদানেও ভাটার টান বলে ওঁরা মনে করছেন। এক শিল্প-কর্তা এ-ও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “গত জুনে শিল্পমহলের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম বৈঠকে বিশিষ্ট শিল্পপতি আদি গোদরেজ, শিবেন্দ্র সিংহ-সহ জাতীয় স্তরের বণিকমহলের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। তার প্রেক্ষিতে এখনকার পরিস্থিতি কিছুটা হতাশাব্যঞ্জক বই কি!” আর এক শিল্প-কর্তার কথায়, “আগে ক্ষমতাসীন বামেদের অভিযোগ ছিল, কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নে টাকা দেয় না। সহযোগিতা করে না। সেই ছবিটা বদলে দেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ ছিল নতুন সরকারের। কিন্তু বারবার কেন্দ্রের বিরোধিতা করে সে সুযোগ হারানোর মুখে রাজ্য।”
পশ্চিমবঙ্গে নতুন জমানায় কোন শিল্পে কত লগ্নি এল, ধোঁয়াশা তা নিয়েও। শিল্পমহল চাইছে, রাজ্য যে ৬৫ হাজার কোটি টাকা ‘লগ্নিলাভের’ দাবি করছে, তার পূর্ণাঙ্গ খতিয়ান দিয়ে সেই ধোঁয়াশা দূর করুক সরকারই। না-হলে লগ্নিকারীদের আস্থা আরও কিছুটা ধাক্কা খেতে বাধ্য।
আর যে ভাবে অল্প সময়ের মধ্যে ‘বেঙ্গল লিডস’-এর আয়োজন করা হল, তাতেও অনেক ফাঁকফোঁকর রয়ে গিয়েছে বলে শিল্পমহলের একাংশের দাবি। দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে এক শিল্পসংস্থার এক কর্তা বলেন, “টিআইএলের প্রকল্পকে শো-কেস শিল্প হিসেবে বর্তমান সরকার তুলে ধরছে। বেঙ্গল লিডসের প্রচারে বলা হয়েছে, টিআইএল ট্র্যাক্টর তৈরি করে! অথচ শুধু এ রাজ্য নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্পমহলের সবাই জানে, সংস্থাটি ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্র বানায়। শো-কেস প্রকল্পের প্রচারেই যদি এমন অজ্ঞতা ফুটে ওঠে, তা হলে লগ্নিকারীরা সরকারের উপরে কতটা আস্থা রাখতে পারবেন?”
সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর: ব্যবসা বাড়াতে যে কোনও শিল্প-সম্মেলনের মতো এখানে শিল্পমহলের নিজেদের মধ্যে যে আলোচনাচক্র হবে, তাতে কার্যত স্থানীয়রাই সামিল হবেন। ফলে এখানে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যবসা বাড়ানোর সুযোগ নিতান্তই কম থাকবে বলে শিল্পমহলের একাংশের ধারণা। এই মহলের আরও অভিযোগ, বেঙ্গল লিডসের ওয়েবসাইটের ‘এক্সিবিটর’ সূচিতে জাতীয় স্তরে শুধুমাত্র কেন্দ্র ও রাজ্যের ন’টি দফতরের নাম রয়েছে। অর্থাৎ, সেখানেও আন্তর্জাতিকতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
পাশাপাশি আসছে শিল্পোপযোগী পরিবেশের প্রশ্ন। বিনিয়োগের জন্য যে সৌহার্দ্যমূলক ও সহায়ক পরিবেশ প্রয়োজন, সম্প্রতি রতন টাটা তা স্পষ্ট করে
বলেছেন। উপযুক্ত পরিবেশ না-পেলে শিল্পোদ্যোগীরা কোন ভরসায় এখানে বিনিয়োগ করবেন, সেই প্রশ্নও এখন তুলছেন অনেকে। |