সকাল থেকে তিনি কখনও দলীয় কার্যালয়ে। কখনও বাড়িতে। কিন্তু রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের উপরে হামলায় মূল অভিযুক্ত, উত্তর দিনাজপুর জেলা তৃণমূলের প্রাক্তন কার্যকরী সভাপতি তিলক চৌধুরীকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রেফতার করল না পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়নি আর এক অভিযুক্ত, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের জেলা পর্যবেক্ষক প্রিয়ব্রত দুবেকেও। বরং দু’জনকে ‘আত্মসমর্পণের জন্য অনুরোধ’ করে বিতর্ক বাড়িয়েছেন পুলিশ সুপার। যা জানার পরে পুলিশ মহলেই সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ উত্তরবঙ্গের আইজি।
পুলিশ সুপার দীপঙ্কর ভট্টাচার্য অবশ্য মনে করেন, তিনি নিয়মবিরুদ্ধ কিছু করেননি। তাঁর যুক্তি, “জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে অনেক সময়েই তাঁদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়ে থাকে। এটা নিছকই সৌজন্যের ব্যাপার। এর আড়ালে কোনও কারণ খোঁজা অনুচিত ও ভিত্তিহীন। আমি তিলক চৌধুরী ও প্রিয়ব্রত দুবেকে আত্মসমর্পণ করতে বলেছিলাম। ওঁরা না-করলে পুলিশ গিয়ে ওঁদের অবশ্যই গ্রেফতার করবে।”
কিন্তু পুলিশ সুপারের এই ভূমিকায় ক্ষুব্ধ উত্তরবঙ্গের আইজি সঞ্জয় সিংহ বলেন, “এসপি ঠিক করেননি। অভিযুক্তকে গ্রেফতার করাই পুলিশের কাজ। আত্মসমর্পণ করার জন্য পুলিশ বলতে যাবে কেন? আমি যাঁদের নাম রয়েছে কোনও বাছবিচার না-করে সকলকে গ্রেফতার করতে বলেছি।”
|
তিলক চৌধুরী |
এ দিন অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনায় ৯ জন তৃণমূল সমর্থককে গ্রেফতার করা হলেও সকলেই রায়গঞ্জের মুখ্য বিচারবিভাগীয় আদালত থেকে জামিন পান। অধ্যক্ষকে মারধর, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুরের মতো অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন জামিনযোগ্য ধারায় (আইপিসি ৩৪১, ৩২৩, ৩২৫ ও ৩৪ ধারা) মামলা রুজু করল পুলিশ তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
কয়েক জন প্রবীণ পুলিশ অফিসার জানান, সংবাদমাধ্যমে যে ছবি ধরা পড়েছে ও অধ্যক্ষ যা অভিযোগ করেছেন তার ভিত্তিতে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯, ৪৪৭, ৪২৭, ৩৫৩, ৩৩৩ ও ৩৩৬ ধারায় মামলা করা যেত। সঙ্গে ‘প্রিভেনশন অফ পাবলিক প্রপার্টি ড্যামেজ অ্যাক্ট (পিডিপিপি ৩/৪)’ অনুযায়ী মামলাও করতে হত। যা কি না জামিন অযোগ্য ধারা। এক প্রবীণ অফিসার বলেন, “যে সব ধারায় মামলা হয়েছে তাতে কাউকে ধরা হলে থানা থেকেও জামিন মিলতে পারে।”
জামিনযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের প্রসঙ্গে পুলিশ সুপারের দাবি, তিনি আইন মেনেই কাজ করেছেন। তাঁর যুক্তি, “যে অভিযোগ হয়েছে, সেই অনুযায়ী আইনের ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে।” তা হলে, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুরের ধারা দেওয়া হয়নি কেন, সেই প্রশ্নে অবশ্য পুলিশ সুপার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিলীপ দে সরকারকে কলার ধরে মারধরের ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যায় দিলীপবাবু তৃণমূল নেতা তিলকবাবু ও প্রিয়ব্রত দুবের নেতৃত্বে হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। ‘ভিডিও ফুটেজ’-এ দেখা যায় তিলকবাবু, তাঁর স্ত্রী কেয়াদেবী ও প্রিয়ব্রতবাবুর নেতৃত্বে হামলাকারীরা কলেজে ঢুকছেন। ছবিতে জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি খলিলুদ্দিন সরকার-সহ রায়গঞ্জ পুরসভার কাউন্সিলর রতন মজুমদার, প্রিয়তোষ মুখোপাধ্যায়কেও দেখা গিয়েছে।
শুধু তিলকবাবুই নন, অভিযুক্ত প্রিয়ব্রতবাবুকেও পুলিশ গ্রেফতার করেনি। বিধি অনুযায়ী, একই মামলায় একজনকে গ্রেফতার ও অন্য অভিযুক্তকে আত্মসমর্পণ করতে পুলিশ বলতে পারে না। স্বভাবতই জেলা পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা’র সুবাদেই তিলকবাবু ও তাঁর অনুগামীরা ছাড় পাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে কংগ্রেস-সিপিএম তো বটেই, কলেজ শিক্ষক মহলেও প্রশ্ন উঠেছে।
বস্তুত, তিলকবাবু ও প্রিয়ব্রতবাবুকে পুলিশ গ্রেফতার না-করায় তৃণমূল নেতাদের অনেকেই অস্বস্তিতে পড়ার কথা স্বীকার করেছেন। দলীয় সূত্রের খবর, সংগঠনের নেতাদের নির্দেশে প্রিয়ব্রতবাবু ঘটনার রাতেই কলকাতায় চলে যান। তবে, তিলকবাবু শহরেই ছিলেন। থানা থেকে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ের দূরত্ব বড়জোড় ৩০০ মিটার। পুলিশ-ভ্যান এ দিন ওই অফিসের পাশ দিয়ে অনেকবার যাতায়াত করেছে। কিন্তু তিলকবাবুকে ধরা হয়নি। থানার কয়েক জন অফিসার জানান, পুলিশ সুপার নির্দেশ না-দিলে তিলকবাবুকে ধরা সম্ভব নয়।
তৃণমূলের জেলা সভাপতি অসীম ঘোষ অবশ্য বলেন, “কলেজে ভাঙচুর ও অধ্যক্ষকে মারধরের মতো ঘটনাটি দল সমর্থন করে না। অভিযুক্তদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব যাই থাকুক না কেন, পুলিশকে গ্রেফতার করতে বলা হয়েছে।” পাশাপাশি, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দল পৃথক ভাবে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলেও তিনি জানান। পাশাপাশি, এ দিন বিকালেই অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনায় জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ বিশ্বাস, রায়গঞ্জ লোকসভা যুব কংগ্রেস কমিটির সহ-সভাপতি তুষারকান্তি গুহ-সহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ দায়ের করেছে তৃণমূল। কংগ্রেস ওই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। কংগ্রেসের জেলা সভাপতি তথা রায়গঞ্জের বিধায়ক মোহিত সেনগুপ্ত বলেন, “তিলকবাবু ও প্রিয়ব্রতবাবুকে ছাড় দেওয়া থেকেই পুলিশের ভূমিকা স্পষ্ট।” জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক পবিত্র চন্দ জানান, অধ্যক্ষকে মারধরের ঘটনায় যুক্ত সকলকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করা না হলে টানা আন্দোলনে নামা হবে। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অপূর্ব পাল বলেন, “তিলকবাবু ও প্রিয়ব্রতবাবু গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকসমাজ আতঙ্কে রয়েছে। আমরা তা পুলিশকে জানিয়েছি।”
তিলকবাবু অবশ্য অভিযোগ ভিত্তিহীন, এই দাবিতে অনড়। তিনি বলেন, “অধ্যক্ষ মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন। আমাদের কেউ কলেজে হামলা বা অধ্যক্ষকে মারধর করেননি। কংগ্রেস ওই কাজ করেছে। আমার বিরুদ্ধে যখন মামলা হয়েছে, তখন আইনের পথেই যাব। দলের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি।” আর প্রিয়ব্রতবাবু জানান, তিনি দলের কাজে কলকাতায় রয়েছেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, ঘটনার কিছু দিন আগে থেকেই রায়গঞ্জ থানার আইসি জ্যোতিষ রায় পারিবারিক কারণে ছুটিতে ছিলেন। কিন্তু বিকল্প হিসাবে কোনও ইন্সপেক্টরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ঘটনাটি জানতে পেরেই জ্যোতিষবাবুকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে মালদহের গোয়েন্দা বিভাগে বদলি করা হয়েছে। রায়গঞ্জে একজন নতুন ইন্সপেক্টরকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাজ্য পুলিশের এক কর্তা জানান, রায়গঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ থানার আইসি দীর্ঘদিন ছুটিতে থাকা সত্ত্বেও কোনও ইন্সপেক্টরকে সেই দায়িত্বে না-রাখাটা ভুল হয়েছে। সমালোচিত হয়েছেন পুলিশ সুপার। এদিন সকালে যে ৯ জনকে ধরা হয়, তাঁরা তাপস চোঙদার, আলিফ হোসেন, বাবলু সাহা, কিষাণ কামাত, পাঁজা মহম্মদ, পুনু চৌধুরী, সঞ্জয় দাস, শিব দাস এবং সঞ্জয় বিশ্বাস। তাঁদের বাড়ি রায়গঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। তৃণমূলের কয়েকজন নেতা হামলাকারীদের ‘বহিরাগত’ ও ‘কংগ্রেসের মদতপুষ্ট’ বলেছেন। সাংবাদিকরা এ কথা জানালে ধৃতদের কয়েক জন লকআপ থেকে চেঁচিয়ে বলেন, “আমরা আইএনটিটিইউসি করি। তিলকদার নির্দেশে কলেজে গিয়েছিলাম।” |