রায়গঞ্জের পরে এ বার গঙ্গারামপুর। ফের কলেজে রাজনীতির ‘দাপাদাপি’। ফের অভিযুক্ত রাজ্যের প্রধান শাসক দলের ছাত্র সংগঠন।
বৃহস্পতিবার রায়গঞ্জ কলেজে অধ্যক্ষকে মারধরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শুক্রবার দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর কলেজে তাণ্ডবের অভিযোগ উঠল তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) বিরুদ্ধে। অধ্যক্ষ-সহ ১৫ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীকে প্রায় দিনভর তালাবন্দি করে রাখে টিএমসিপি সমর্থকেরা। কলেজের অফিসঘরে ভাঙচুরও চালানো হয়। সন্ধ্যায় জেলা তৃণমূল সভাপতি বিপ্লব মিত্রের হস্তক্ষেপে তালা খুললেও অধ্যক্ষ-শিক্ষকদের আতঙ্ক কাটেনি। একের পর এক ঘটনার জেরে স্বাভাবিক ভাবেই উত্তরবঙ্গের একাধিক কলেজের অধ্যক্ষ-শিক্ষকরা আতঙ্কিত। তাঁদের আশঙ্কা, এ বার কার পালা? |
আতঙ্ক এতটাই ছড়িয়েছে যে নিরাপত্তার অভাব বোধ করে এ দিনই ডালখোলার শ্রীঅগ্রসেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জয়শ্রী দাস ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জয়শ্রীদেবী ওয়েবকুটার সদস্য। সংগঠন তাঁকে পড়ুয়া-স্বার্থে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছে। রায়গঞ্জ কলেজের নিগৃহীত অধ্যক্ষ দিলীপ দে সরকার ইতিমধ্যেই ইস্তফা দিয়েছেন। ওই কলেজ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেছেন কর্তৃপক্ষ। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু অবশ্য রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজ দ্রুত খোলার জন্য উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অরুণাভ বসু মজুমদারকে পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে দিলীপবাবুর পদত্যাগ প্রসঙ্গে বলেছেন, “টিচার-ইন-চার্জ যদি পদত্যাগ করতে চান, তা হলে তাঁর ইস্তফাপত্র গ্রহণ করে কলেজে আপাতত প্রশাসক বসানো হতে পারে।”
এমনিতেই কলেজে কলেজে গোলমাল, তাণ্ডব। তার মধ্যে ’৭০-এর দশকের স্মৃতি উস্কে দিলীপবাবুর ইস্তফা গ্রহণ করে সরকারি তরফে রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে প্রশাসক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় উদ্বেগ বেড়েছে শিক্ষা মহলে। কিছু শিক্ষাবিদ ঘরোয়া আলাপচারিতায় ’৭০-এর দশকে কী ভাবে প্রশাসক দিয়ে কলেজ চালানো হত, সে প্রসঙ্গও তুলছেন। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু অবশ্য সব পক্ষকেই আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন। কলেজের অধ্যক্ষদের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, রাজনীতি এড়িয়ে পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে রাজ্য বদ্ধপরিকর। আবার ছাত্রদের কথা মাথায় রেখে বলেছেন, “উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেও বলা হবে। ছাত্র-স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতেই হবে। পড়াশোনার পরিবেশ যাতে নষ্ট না-হয়, সে জন্য যা করণীয় করতে হবে।” |
রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “প্রশাসন তার কাজ করছে। দোষীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। কিন্তু কলেজের ক্লাস বন্ধ রাখা যাবে না। সামনেই পরীক্ষা।” একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “অরুণাভবাবু ওই কলেজের পরিচালন সমিতির চেয়ারম্যান। ওঁকে বলেছি দ্রুত বৈঠক ডাকতে।” তিনি আরও বলেন, “যত দ্রুত সম্ভব ক্লাস চালু করে তার পরে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করার কথা বলেছি অরুণাভবাবুকে। অধ্যক্ষের দায়িত্ব যাতে দ্রুত কাউকে দেওয়া যায়, সেটাও দেখতে বলেছি।”
শিক্ষামন্ত্রীর আজকের আশ্বাসের পরেও রায়গঞ্জের এক দিনের মধ্যেই গঙ্গারামপুর কলেজে যা ঘটল, তাতে সাধারণ পড়ুয়া ও অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন। এসএফআই-এর অভিযোগ, ছাত্র সংসদের ভোটের আগে কলেজে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করতেই অধ্যক্ষ এবং শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের তালা বন্ধ করার ছক কষা হয়। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের অবশ্য দাবি, অধ্যক্ষ কলেজের সম্পূর্ণ ভোটার তালিকা দিতে না চাওয়ায় তাঁকে ঘেরাও করে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির গেটে তালা দিয়ে দেওয়া হয়। অধ্যক্ষ-সহ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা দোতলাতেই আটকে পড়েন। রায়গঞ্জ কলেজেও ছাত্র সংসদের ভোটকে ঘিরেই অধ্যক্ষ এবং তৃণমূল সংঘাতের সূচনা।
গঙ্গারামপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তৌহিদ-ই-আলম বলেন, “প্রথম বর্যের ২৫০০ ছাত্রছাত্রীর ভোটার তালিকা প্রথমে দিয়েছি। বাকি পড়ুয়াদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা এ দিনই সব ছাত্রছাত্রীর নাম সম্বলিত তালিকা দাবি করে। বিক্ষোভ দেখায়। তার পরে গেলে তালা ঝুলিয়ে আমাদের আটকে রাখে।” এসএফআই নেতা অচিন্ত্য চক্রবর্তীর অভিযোগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘নৈরাজ্য’ তৈরির জন্যই টিএমসিপি জেলায় জেলায় ‘তাণ্ডব’ শুরু করেছে। |
টিএমসিপি-র কলেজ ইউনিট সভাপতি চন্দন বসাকের অবশ্য দাবি, “কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার চেয়েও সম্পূর্ণ ভোটার তালিকা মেলেনি। গত ২২ ডিসেম্বর স্মারকলিপি দেওয়ার পরে অধ্যক্ষ ৪ জানুয়ারি তালিকা বিলির আশ্বাস দিয়েছিলেন। তা না হওয়ায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের আশ্বাসে আন্দোলন তুলে নেওয়া হয়।” বিপ্লব মিত্র বলেন, “ঘটনা শোনার পরেই ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিদের সংযত হতে নির্দেশ দিই। তবে সব ছাত্রছাত্রীর ভোটার তালিকা দিতে কলেজ কর্তৃপক্ষ গড়িমসি করেও ঠিক করেননি।” গঙ্গারামপুর থানার আইসি সত্যব্রত বাগচী বলেন, “কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনও খবর দেননি। খবর পেয়ে নিজেই কলেজে যাই। সে সময় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের আলোচনা চলছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। তার পরে আমরা চলে এসেছি।”
এই ‘নৈরাজ্যে’ উদ্বিগ্ন ডালখোলা কলেজের অধ্যক্ষা জয়শ্রীদেবী বলেন, “ছ’মাস ধরেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্তদের নানা ভাবে হেনস্থার ঘটনা ঘটছে। আমাকেও নানা ভাবে সমস্যা পোহাতে হয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার রায়গঞ্জে যা হয়েছে, তাতে ধৈর্যের সব বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। তা ছাড়া এ রকম ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদ জানানোও জরুরি মনে করছি। সে জন্যই শনিবার গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” ইসলামপুরের পুরপ্রধান তথা কংগ্রেস নেতা কানাইয়ালাল অগ্রবাল মনে করেন, রায়গঞ্জ কলেজে যা ঘটেছে, তাতে জেলার আরও অনেক কলেজের অধ্যক্ষ পদ ছাড়তে চাইবেন। স্থানীয় তৃণমূল নেতা গৌতম গুপ্ত অবশ্য রায়গঞ্জ কলেজের ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক চক্রান্ত’ বলে দাবি করেছেন। |