পাঁচটি ডাকাতির ঘটনা ঘটায় ২০১১ সাল যদি নদিয়ায় ব্যাঙ্ক ডাকাতি-বর্ষ হয়, ২০১০ সাল তাহলে নিঃসন্দেহে পেট্রল-পাম্প ডাকাতির বছর ছিল।
২০০৯-এর শেষ থেকে ২০১০ সাল জুড়ে জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে নদিয়ায় প্রায় ১৯টি পেট্রল পাম্প ডাকাতি হয়েছে। কল্যাণী, বিরহী, শিমুরালি, বাহাদুরপুর, শান্তিপুর, বাদ যায়নি কোনও এলাকাই। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দু-একটি ক্ষেত্রে কয়েক জনকে গ্রেফতার করা ছাড়া কোনও ডাকাতিরই কিনারা হয়নি।
নদিয়া জেলা পেট্রোলিয়াম ডিলার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অংশুমান দে বলেন, “১৯টি পাম্পে ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও কোনও ক্ষেত্রেই পুলিশ কিনারা করতে পারেনি। পুলিশ প্রশাসনকে জানিয়েও কোনও ফল হয়নি। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে এক সময়ে আমরা জেলা জুড়ে পেট্রল পাম্প বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম। কিন্তু তৎকালীন পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য আমাদের কাছে রীতিমতো হাতজোড় করে অনুরোধ করেছিলেন ‘পনেরো দিন সময় দিন সব কিনারা হয়ে যাবে।’ সেই মত আমরা ধর্মঘটের পথ থেকে সরে আসি। তবে সামান্য ধড়পাকর ছানা কিনারা কিছু হয়নি।”
জেলার যে সমস্ত পাম্প হাইওয়েতে। যেখানে লোকজন কম। মালিকপক্ষ হয়ে সেই সমস্ত পেট্রল পাম্প এখন সন্ধ্যার পরে বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। ডাকাতির ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত মালিক ও কর্মচারি কেউই আর সন্ধ্যার পরে পেট্রল পাম্প খোলা রাখার ঝুঁকি নিতে চাইছেন না
তৎকালীন পুলিস সুপার চম্পক ভট্টাচার্য এখন উত্তর ২৪ পরগনার দায়িত্বে। তিনি বলেন, “সেই সময়ে বেশ কয়েকটি পেট্রল পাম্পে যেমন ডাকাতির ঘটনা ঘটে, তেমনি কয়েকটি ক্ষেত্রে অপরাধী ধরাও পড়েছে। যেমন বাহাদুরপুরের ঘটনায় পুলিশ বেশ কয়েক জন দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করে। তবে নদিয়ায় আমরা দু-বছরের কার্যকালে সবথেকে বড় সাফল্য করিমপুর ব্যাঙ্ক ডাকাতির ঘটনার সমাধান।”
তবে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে বাদকুল্লার বঙ্গীয় গ্রামীণ ব্যাঙ্ক থেকে ২৬ লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা লুঠের ঘটনায় ডাকাত দল ধরা পড়েনি এবং অর্থও যে উদ্ধারও হয়নি, তা স্বীকার করেন প্রাক্তন এসপি চম্পকবাবু। তিনি বলেন, “ওই ঘটনাটি ডাকাতি কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে পুলিশ সঠিক ভাবে তদন্ত করেছে।” আর বর্তমান নদিয়ার পুলিশ সুপার সব্যসাচী রমণ মিশ্র বলেন, “নবদ্বীপ আর শান্তিপুরের ব্যাঙ্ক ডাকাতির মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, এটি জেলার বাইরের কোনও দলের কাজ। পুলিশের তদন্ত চলছে। সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” তবে জেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে, এমনটা মানতে চাননি তিনি।
এ ছাড়া কল্যাণী থেকে কৃষ্ণনগর কিংবা রানাঘাট থেকে রাধানগর, জেলা জুড়ে একের পর এক দোকান ও গৃহস্থ বাড়িতে চুরি-ডাকাতি প্রায় নিত্য ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। চুরি হচ্ছে নবদ্বীপের মন্দিরেও। রয়েছে মায়াপুরে পর্যটক বোঝাই বাসে এবং কৃষ্ণগঞ্জে বরযাত্রীদের গাড়ি থামিয়ে লুঠপাটের ঘটনাও।
তালিকা দীর্ঘ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই সব অপরাধের কোনও কিনারা হয়নি। ধরা পড়েনি অপরাধী। উদ্ধার হয়নি খোয়া যাওয়া সামগ্রী বা লুঠ হওয়া অর্থ। ফলে নদিয়া জেলা দৃষ্কৃতীদের নিরাপদ মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী থেকে বাসিন্দা সকলেই।
প্রহরাহীন ব্যাঙ্ক, টহলদারবিহীন রাজ্য বা জাতীয় সড়ক, ঢিলেঢালা পুলিশি ব্যবস্থা সম্পন্ন শহর বা গ্রামাঞ্চলে অবাধে দুষ্কর্ম করে পালাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। মুর্শিদাবাদ, হুগলি, বর্ধমান, উত্তর-২৪ পরগনা দিয়ে ঘেরা নদিয়ায় অপরাধ করে অন্য জেলায় পালিয়ে যাওয়া সহজ। সেই সঙ্গে পুলিশের ‘ভূমিকা’ দুষ্কৃতীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ।
নদিয়ায় পর পর ডাকাতির ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত জেলার ব্যবসায়ী মহল। নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাংগঠনিক সম্পাদক উত্তম সাহা বলেন, “ডাকাতির ঘটনায় সত্যি কথা বলতে জেলার ব্যবসায়ী মহল অত্যন্ত আতঙ্কিত। ভরসা করার মত কোনও পুলিশি ব্যবস্থা নেই। দোকান-বাজার, পেট্রল পাম্প সবই অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। ব্যাঙ্কের মত জায়গায় যদি মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা ডাকাতি হতে পারে। তাহলে কোন ভরসায় ব্যবসা করবেন জেলার ব্যবসায়ীরা!” |