গরু পাচারের জন্য গ্রামবাসীদের কাছ থেকে পথ কিনে নিচ্ছে পাচারকারীরা। আর রাতের অন্ধকারে সে পথের দায়িত্ব বর্তায় ‘কমিশনার’-এর হাতে!
সীমান্তের সেই পথ, আসুন চিনে নিই —
পাচারের নিজস্ব ‘পথ’ রয়েছে। কেমন সেই রাস্তা? আর পাঁচটা গ্রামীণ রাস্তার মতোই। কোতাও খেতি জমির মাঝ বরাবর। কোথাও বা কলা বা পেয়ারা গাছের আড়ালে মেঠো পথ। পাচারের জন্য নির্দিষ্ট সেই পথে দিনে হাঁটে গ্রামবাসীরা। রাতে সে পথের দখল নেয় হাজার হাজার গরু। মাঠের পর মাঠ, জমির ফসল পা দলে তারা এগুয়ি যায় ‘বর্ডারের’ দিকে। তারপর কমিশনারের হাত ধরে নদী কিংবা নো-ম্যানস ল্যান্ডের সীমানা উজিয়ে হারয়ে যায় বাংলাদেশে। সারা রাত সেই পথ পাহারা দেয় কমিশনারের লোকজন। পুলিশ সব জানে। জানে বিএ,এফ-ও। কিন্তু কত আর সামাল দেওয়া যায়!
পথ বিক্রি হয় কখনও এক মাসের জন্য, কখনও আবার সারা বছরে জন্য। চাষিদের কাছ থেকে পথ কিনে নেয় ‘লাইনম্যান’। সেই চেনা পথেই বাংলাদেশে গবাদি পশু নিরাপদে পাচার করে থাকে চোরাকারবারীরা। পথ কেনার সঙ্গে ওই পথের ট্র্যাফিকের দায়িত্ব সামলায় তাঁরাই। বিনিময়ে পাচারকারীদের কাছ থেকে লাইনম্যানরা জোনা গরু প্রতি পেয়ে থাকে মোটা অঙ্কের টাকা। |
কেন তাদের ধানি জমিতে ‘পাচারের পথ’ করার অনুমতি দেন কৃষকেরা? ব্যাখ্যা এই রকম--সীমান্তের চরের জমিতে চাষ করার জন্য নানা ঝক্কি। তার মধ্যে রয়েছে বিএসএফের বিভিন্ন ফতোয়া। সম্ভবনা থাকে পাচারকারীদের গরুর খুরে জমির ফসল মাঠেই নষ্ট হয়ে যাওয়ার। তাই খানিক কাঁচা টাকার বিনিময়ে পথ বেচে দিলে ঝাড়া হাত-পা। ফসল ঘরে তোলার অনিশ্চয়তা নেই। ঘরে বসেই টাকা রোজগার।
রানিনগর সীমান্ত এলাকায় হারুডাঙা থেকে মোহনগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। ওই দূরত্বে মোট চারটি চোরাই পথ রয়েছে। সীমান্তের বাসিন্দা নায়েব শেখ বলেন, “ওই পথগুলির নাম এক নম্বর লাইন, ব্রীজের লাইন, দরগা লাইন ও কারগিল লাইন। বর্তমানে ওই লাইনের বাজার দর চলছে এক বছরের জন্য বিঘা প্রতি সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। তবে পাট বা কলা চাষ করলে ওই লাইনেরই দাম চড়ে যায় কয়েকগুণ বেশি।” সীমান্তের ওই জমিতে চাষ করলেও বিঘা প্রতি বাড়তি কোনও লাভ হয় না। নায়েব বলেন, “চরের মাঠে চাষ করতে গেলে বিএসএফের হয়রানি, গরুর খুরে ফসল নষ্টের ভয় রয়েছে। তার চেয়ে পথ বেচলে আর্থিক ক্ষতির কোনও ঝুঁকি থাকে না। বাড়িতে বসেই রোজগার করা যায়।”
সীমান্তের মাঠে দেখা যায় জমির ভেতর দিয়ে সরু চলার পথ, যার দু-ধারে জমি বা পাটের গাছ দেখতে পাওয়া যায়। পাচারকারী নইরুদ্দিন মোল্লা (নাম পরিবর্তিত) বলেন, “পাট বা কলার জমি হলে অনেকটাই নিরাপদে পাচার করা যায়। কারণ ওই পথে বিএসএফ এবং পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব। তবে ওই লাইন বেশি দিন ধরে রাখা যায় না। পাচারকারীদের গোপন ওই লাইনের কথা লোকমুখে গ্রামে চাউর হয়ে যায়।”
প্রায় বছর কুড়ি আগে পাচারে হাতেখড়ি হয়েছিল সাগরের। পরে লাইনম্যান হিসেবে পাচার লাইনে দ্রুত নাম ছড়ায় তাঁর। পাচারের টাকায় বাজারে এক ছেলেকে মুদির দোকান তৈরি করে দিলেও চোরাই পথের ব্যবসা থেকে হাত গুটিয়ে নিতে পারেননি। তাঁর কথায়, “নিজে হাতে পাচার করার চেয়ে পথ কিনে লাইনের ব্যবসায়ী অনেক কম ঝুঁকি। কারণ এলাকার চাষিরা যেমন পরিচত, তেমনি হাতের তালুর মত চেনা জমির ভূগোল। জমি অনুযায়ী দরদাম করে চাষিদের পাওনাগণ্ডা বুঝিয়ে দিতে পারলেই কাজ হালকা হয়ে যায়। এর পরে লোক রেখে বছর ভর চাঁদা তোলা।”
জলঙ্গির বাসিন্দা কবির খান বলেন, “লাইন দিয়ে রাতে নয়, দিনেও পাচার চলত। গবাদি পশু ছাড়াও চাল, ডাল, চিনি, কাপড় পাচার হত ওই পথ ধরে।” এক দশক আগেও ওই পথের চড়া দাম ছিল। জমির মালিককে বিঘা প্রতি বছরে ৪ হাজার টাকা দেওয়া হত বলে এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়।
রাতের অন্ধকারেও কার্গিল লাইনে তাই ধুলো উড়েই চলেছে। |