খুশিতে বাঁচুন
বাতের সঙ্গে পাঞ্জা
শীত পড়লে অনেকের হাঁটু বা কোমরের পুরনো বাতের ব্যথা চাগিয়ে ওঠে। কারণ, ঠান্ডায় মাংসপেশি সঙ্কুচিত হয়। এমনকী টেন্ডন আর লিগামেন্ট-ও সঙ্কুচিত হয়। নরম কোষগুলির এই যৌথ সঙ্কোচনে বিগড়ে যায় বন্ধনীর বিন্যাস। এতে বেশি করে বন্ধনী আক্রান্ত হয়। তা ছাড়া শীতে আমরা কম নড়াচড়া করি। এতেও মাংসপেশি কুঁকড়ে গিয়ে পসচার বিগড়ে যায়। এতেও হাঁটু আর কোমরের বাতের ব্যথা বাড়ে। তবে সাধারণ বাত হোক বা অস্টিও আর্থ্রাইটিসশীতে কষ্ট কমবে যদি আপনারা নীচের পদ্ধতিগুলি অনুসরণ করেন:
১) দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য হাঁটু ও কোমরের শক্তি বাড়ান।
২) ওজন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পছন্দমাফিক কোনও ওয়ার্কআউট করুন।
৩) খাওয়ার নিয়ন্ত্রণ করুন। মুড নিয়ন্ত্রণ করুন।
ক্ল্যামশেল
শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম অথবা ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য ওয়ার্কআউটযেটাই করুন, শুরুতেই অল্প করে শরীর গরম করে নিন। যেমন, সিঁড়ি বেয়ে দু’চার বার ওঠানামা করুন। ঘরে দ্রুত পাঁচ মিনিট হাঁটুন। অথবা গানের তালে পা মেলান। এর ফলে মাংসপেশিতে রক্তের সঞ্চালন বেড়ে শরীরের কোর তাপমাত্রা বাড়ে। এ বার শুরু করুন কয়েকটি স্ট্রেচিং, যা মাংসপেশির স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য ফিরিয়ে দেবে।
ক) কোয়াড্রিসেপ মাংসপেশির স্ট্রেচ: পাশাপাশি শুয়ে একটা হাঁটু ভাজ করুন। ভাঁজ করা পায়ের চেটো হাত দিয়ে কোমরের দিকে টানুন। যত নমনীয়তা, ততই বল প্রয়োগ করুন। ১০-৩৫ সেকেন্ড ধরে থাকুন। তার পরে অন্য পায়ে করুন। প্রত্যেক পা তিন বার করে স্ট্রেচ করুন।
খ) হ্যামস্ট্রিং স্ট্রেচ: একটা দড়ি নিন। চিত হয়ে শুয়ে এক পায়ে দড়িটিকে আটকে নিন। অন্য পা’টি ভাঁজ করে রাখুন। এ বার দড়ি ধরে টেনে পা’টিকে সোজা করে নিজের শরীরের দিকে নিয়ে আসুন। এখানেও নিজের নমনীয়তা অনুযায়ী টানুন। শেষ যেখানে পৌঁছতে পারবেন সেখানে ১০-১৫ সেকেন্ড ধরে রাখুন। এ বার পা বদলান। প্রত্যেক পায়ে তিন বার করে স্ট্রেচ করুন। অনেকে হাত দিয়ে পায়ের নাগাল পান না তাই দড়ির ব্যবহার।
ওয়াল স্কোয়াট
গ) কোবরা স্ট্রেচ: ভুজঙ্গাসনের কথা মনে করুন। উপুড় হয়ে শুয়ে হাত দু’টি বুকের পাশে রেখে, বুক ও মাথা আপনার সাধ্যমতো উপরের দিকে তুলুন। ২০-৩০ সেকেন্ড এ ভাবে ধরে থাকুন। এর ফলে পেটের রেক্টাস অ্যাবডোমিনিস পেশি দীর্ঘায়িত হয়, যাতে কোমরের ব্যথা থেকে ভাল থাকা যায়। এ ছাড়াও মেরুদণ্ডটি অনেক নমনীয় হয়। মোট তিন বার করুন।
প্রথম দু’টি স্ট্রেচ হাঁটুর বাতের জন্য উপকারী। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্ট্রেচটি কোমরের জন্য। শুধু খেয়াল রাখবেন, ব্যথা খুব বেশি থাকলে স্ট্রেচ করবেন না। শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম সপ্তাহখানেক করে তার পরে স্ট্রেচ করুন। তবে এগুলির সঙ্গে গ্লুটিয়াস, আই টি বি ইত্যাদি আরও কয়েকটি স্ট্রেচ যোগ করে নেবেন।
(১) শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম: হাঁটুর বাতের থেকে ভাল থাকতে সপ্তাহে তিন-চার দিন (এক দিন অন্তর এক দিন) নীচের তিনটি ব্যায়াম অবশ্যই করবেন।
ক) ওয়াল স্কোয়াট: এ জন্য আপনাকে শুধু একটি ফুটবল বা ফুটবলের মাপের বল জোগাড় করতে হবে। না পেলে একটি বালিশ দিয়েই কাজ চালাবেন। বলটি পিঠের দু’টি স্ক্যাপুলার-এর ঠিক তলায় রেখে দেওয়ালে হেলান দিন। এ বার আপনার হাঁটুর ক্ষমতা অনুযায়ী ভাঁজ করে বসার চেষ্টা করুন। ব্যথা থাকলে ৩০ ডিগ্রি থেকে শুরু হোক। অর্থাৎ সামান্য বসেই উঠে দাঁড়ান। ক্রমে ৯০ ডিগ্রি অর্থাৎ হাঁটুটি মাটির সমান্তরাল করার চেষ্টা করুন। দৈনন্দিন জীবনে ওঠা-বসার ক্ষমতা বজায় রাখতে এই স্কোয়াটের মতো ব্যায়ামের জুড়ি মেলা ভার। ওঠা-বসার সময়ে বলটাও দেওয়ালে ওঠা-নামা করবে। সপ্তাহ দুয়েক বাদে দু’হাতে দু’টি এক বা দু’লিটারের জলের বোতল নিয়ে নিন। দশ বার ওঠা-বসা। তিন বার রিপিট করবেন, একটু বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে।
খ) এক পায়ে হিপ এক্সটেনশন: মাটিতে শুয়ে পড়ুন। সামনে রাখুন ১২-১৪ ইঞ্চি একটা টুল অথবা ও রকমই উঁচু শক্ত কোনও জিনিস। এ বার ছবির মতো একটা পা ৯০ ডিগ্রি ভাঁজ করে টুলে রাখুন। ৯০ ডিগ্রি কোণটি নিতম্বের সাপেক্ষে হবে। অন্য পা থাকবে শূন্যে। এ বার কোমরটি এক পায়ের জোরে মাটি থেকে বুকসমান উচ্চতায় তুলুন। উপরে তোলার পরে নামিয়ে এনে ঠিক মাটি স্পর্শ করেই আবার একই ভাবে তুলুন। এ ভাবে দশ বার করা পরে পা বদলে অন্য পায়েও করুন। দু’পা হয়ে গেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে মোট তিন বার রিপিট করুন। এই ব্যায়ামে আমাদের হ্যামস্ট্রিং আর গ্লুটিয়াস মাংসপেশির শক্তি বাড়ে। হাঁটুর সুস্বাস্থ্যের জন্য পিছনের দিকের হ্যামস্ট্রিং-এর সঙ্গে কখনও বিমাতৃসুলভ আচরণ করবেন না।
ডেড বাগ
গ) ক্ল্যামশেল: পাশাপাশি ছবির মতো কাত হয়ে থাকুন। একটি রাবারের ব্যান্ড ঠিক হাঁটু বরাবর জড়িয়ে নিন। রাবারের ব্যান্ড না পেলে কোমরের জন্য যে-ইলাস্টিক কিনতে পাওয়া যায় তাই কিনুন। দু’টি হাঁটুই ৪৫ ডিগ্রি ভাঁজ করা থাকবে। একটি হাঁটু রাবার ব্যান্ডের বিপক্ষে উপরের দিকে তুলুন, আবার নামান। মোট ১০ বার করার পরে অন্য পাশে কাত হয়ে যান। এ বার অন্য হাঁটুটিও ১০ বার ওঠান-নামান। একটু বিশ্রাম নিয়ে তিন বার রিপিট করুন। এই ব্যায়ামে গ্লুটিয়াস মিডিয়াস মাংসপেশি শক্তিশালী হয়। হাঁটুর স্টেবিলিটি-র জন্য এই মাংসপেশির এই মাংসপেশির কার্যক্ষম থাকা আবশ্যক।
এ বার কোমরের শক্তি বাড়ানোর দু’টি ব্যায়াম। সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন অবশ্যই করবেন।
ক) অল্টারনেটিং সুপারম্যান: কোমরের বাতে দু’টি কশেরুকা-র মধ্যের দূরত্ব কমে যায়, লিগামেন্ট আক্রান্ত হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথম কাজ হল, পেটের আর কোমরের গভীরের মাংসপেশিগুলিকে ‘সুইচ অন’ করা। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন। এ বারে বাঁ হাতটিকে মাটি থেকে উপরে তুলুন, একই সঙ্গে ডান পা’টিকেও। মাথাও থাকবে মাটি থেকে উপরে। কোনও রকম ঝাঁকা দেবেন না। আপনার ক্ষমতা অনুযায়ী উপরে তুলুন। এই ভাবে ২০-৩০ সেকেন্ড ধরে থাকুন। তার পর করুন ডান হাত
হ্যামস্ট্রিং স্ট্রেচ
আর বাঁ পা। একটু বিশ্রাম নিয়ে এ ভাবে ৩-৪ বার রিপিট করুন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ব্যায়ামটা করার সময় অনুভব করুন যেন আপনি প্রস্রাব করার ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখছেন। এটি করতে হলে পেটকে মেরুদণ্ডের দিকে ঠেলতে হয়। আর তা হলেই ‘সুইচ অন’ অথবা অ্যাক্টিভেটেড হয় পেটের গভীরের ট্রান্স-ভার্সেস অ্যাবডমিনিস। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সড়গড় হয়ে যাবেন। নিশ্বাস-প্রশ্বাস থাকবে একদম স্বাভাবিক। দম বন্ধ করবেন না।
খ) ডেড বাগ: চিত হয়ে শুয়ে পড়ুন। শুরুতে দু’টি হাঁটুই থাকবে শূন্যে ৯০ ডিগ্রি ভাঁজ হয়ে। একটি হাত থাকবে মাটিতে মাথার পিছনে। অন্য হাতটি হাঁটুর কাছে রাখুন। এ বার একটি হাঁটু সোজা করুন মাটির দিকে। এর পরে পর্যায়ক্রমে এক একটি হাঁটু ভাঁজ আর সোজা করুন। ঠিক একই ভাবে পর্যায়ক্রমে এক একটি হাত মাথার পিছন থেকে হাঁটুর কাছে আনুন। এই ব্যায়ামেও আগের মতো পেটের গভীরের মাংসপেশিকে অ্যাক্টিভেট করতে প্রস্রাবের ইচ্ছা দমনের ভাব করুন। এই ব্যায়ামে পেলভিক ফ্লোর, লাম্বার মাল্টিফিডাস, ট্রান্সভার্সাস অ্যাবডমিনিস ইত্যাদি মাংসপেশি কার্যক্ষম হয়। কোমরের বাত থেকে ভাল থাকবেন এই ব্যায়ামটি করলে। প্রত্যেকটি হাঁটু ১০ বার পর্যায়ক্রমে ভাঁজ আর সোজা করুন। একটু বিশ্রাম নিয়ে তিন বার রিপিট করুন।
(২) ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন মানে হাঁটুকে বেশি চাপ সহ্য করতে হচ্ছে। ভুঁড়ি থাকলে কোমরের ব্যথা বাড়তে পারে। অতএব ওজন কমাতে নিজের ইচ্ছেমতো মিনিট দশেক দ্রুত হাঁটুন। পছন্দের খেলা বেছে অংশ নিন। অথবা টিভি চালিয়ে ‘স্পট জগিং’ করুন। সব কিছুই করুন ১০-১৫ মিনিটের মতো।
(৩) খাওয়া নিয়ন্ত্রণ: রেড মিট, টক জাতীয় খাবার, বড় মাছ, মাখন, চিজ, মিষ্টি এড়িয়ে চলুন। এতে ব্যথা কম থাকবে। ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। হাসিখুশি থাকার জন্য গান শুনুন, ওয়ার্কআউট করুন, নিজের বাচ্চার সঙ্গে খেলুন। এতে শরীর থেকে ‘ফিল গুড হর্মোন’ এন্ডোরফিন নিঃসৃত হবেযাকে বলে ‘শরীরের সহজাত ব্যথা নিয়ন্ত্রক’।
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য

 



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.