অ-পার বাংলা
এ পারে মুখর...

কে বলল, বাংলা গানে নাচা যায় না!
এই শীতে আমেরিকার বোস্টন শহর থেকে এসে বঙ্গসন্তান পৃথ্বীরাজ চৌধুরী, দেবদীপ ভট্টাচার্যরা এ রকমই সুরেলা আওয়াজ তুলে দিলেন। কলকাতার আইসিসিআর, অ্যান্ডারসন ক্লাব থেকে দিঘার নন্দিনী উৎসবে গান গেয়ে গেল পৃথ্বীরাজদের ব্যান্ড ‘অপার বাংলা’। ইউ টিউবে আগেই এসে গিয়েছিল তাঁদের গান। এ বার বেরোল সিডি।
ফের নতুন গজানো একটা ব্যান্ড? কিন্তু সেই ব্যান্ডের জন্ম যদি হয় বোস্টন শহরে মাত্র বছর দুয়েক আগে? সীমান্তের কাঁটাতার ভেঙে যদি সেই ব্যান্ডে লিড গিটারিস্ট হয়ে ওঠেন বাংলাদেশী সানিন বা ফাওয়াদ? এবং শুধু বাংলা ভাষার ভৌগোলিক সীমাতেই আটকে না থেকে যদি সেই ব্যান্ডে ‘বেস গিটার’ বাজান ভিয়েতনামের পল? ড্রাম বাজান ইতালীয়-মার্কিন কন্যা লরা বোরেলি?
ভূমি, চন্দ্রবিন্দু, ক্যাকটাস, ফসিল বা মাইলস-অধ্যুষিত শহরেও তখন নতুন চোখে দেখতে হয় সেই ব্যান্ডকে। মাত্র বছর দুয়েক আগে বোস্টন শহরে ব্যান্ডের জন্ম, আমেরিকার পূর্ব তটের বিভিন্ন শহরে ইতিমধ্যে ৩০টি অনুষ্ঠান করে ফেলেছে তারা। “ওয়েস্ট কোস্টে আমরা সে ভাবে যেতে পারিনি,” বলছিলেন ব্যান্ড-ম্যানেজার কিশোর সিংহ। তিনিও বোস্টনবাসী কলকাতাসন্তান।
এমনিতে মঞ্চে এই ব্যান্ড নিজেদের গানের পাশাপাশি সলিল চৌধুরীর ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ বা মহীনের ঘোড়াগুলির ‘ও বধূ হে/মন আমার কেমন কেমন করে’ অনেক কিছুই গায়। আর সেই সব গানে যখন ইতালীয় কন্যা লরা ড্রাম বাজাতে এগিয়ে আসেন, বাংলা গান তার ধরাবাঁধা মানচিত্র ভেঙে পৌঁছে যায় অন্য ছায়াপথে। এই ব্যান্ডের সঙ্গে জুটি বাঁধার আগে লরা জীবনেও বাংলা গান শোনেননি। শোনেননি ভিয়েতনামের ছেলে পল নগুয়েনও। ব্যান্ডের অন্য সতীর্থরা গানগুলির ইংরেজি ভাবানুবাদ দেন তাঁদের, তার পরে সুরের খেলা। “ভিয়েতনামে মেকং নদীর মাঝিদের গানের সঙ্গে দেখবেন, অনেক বাংলা গানের রিদম-এর মিল আছে,” বলছিলেন পল।
ছয় ব্যান্ডসদস্যের গড়পড়তা বয়স ৩২ থেকে ৩৪। কেউ হার্ভার্ড থেকে ‘স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট’ নিয়ে গবেষণা করে এখন হোয়ার্টন বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক, কেউ বা বায়ো-টেকনোলজি নিয়ে গবেষণায়।
পল হিপ্নোটিজমের সাহায্যে চিকিৎসা করেন। ভিয়েতনামি এবং ইতালীয় দুই সদস্যের কথা ছাড়ুন। এই ব্যান্ডের পৃথ্বীরাজ বা দেবদীপ যখন মঞ্চ থেকে দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেন, পুরোটাই বাংলায়। এ শহরের পাড়ায় পাড়ায় ইংরেজি-বাংলা মেশানো জগাখিচুড়ি সঞ্চালনা নয়। সাধে নীললোহিত এক বার লিখেছিল, ‘মাতৃভাষা যে ভুলতে চায়, তিন মাসে পারে। আর যে ভুলতে চায় না, তিরিশ বছরেও পারে না।’
এই নতুন ব্যান্ডের গানে নাচার কথা আছে, আছে কর্পোরেট জীবনের কথা। আমেরিকার অভিবাসী জীবনে দ্বিতীয় প্রজন্মকে জোর করে যে ভাবে বাংলা সংস্কৃতির বড়ি গেলানো হয়, তার বিরুদ্ধে আপত্তি আছে। “ওখানে রবিবার বাঙালিরা বাচ্চাদের জোর করে বাংলা গান শেখাতে কোনও আন্টির কাছে নিয়ে যান। মা-বাবাদের নস্টালজিয়া থাকতে পারে, কিন্তু ওরা ওই সব গানকে স্লো ভাবে, হাই তোলে। ওদের জন্যই এই সব গান,” বলছিলেন পৃথ্বীরাজ।
শুধু শিশুরা? শীতের কোহলপ্রাণিত সন্ধ্যায়, দক্ষিণ কলকাতার এক ক্লাবে এই ব্যান্ডের গানে পুরুষেরা দেখলাম, নির্জীব হয়ে বসে আছেন। মেয়েরা কেউ কেউ গানের তালে সাড়া দিয়ে উঠে গেলেন নাচতে। ভারতীয় পুরুষ এ রকমই। প্রকাশ্যে নাক খোঁটে, কান চুলকায়। অথচ, নাচের সাহসটুকু নেই। সমাজবিজ্ঞানী মুকুল কেশবন এটাকেই ‘আগলিনেস অব ইন্ডিয়ান মেল’ বলেছিলেন।
সেই সন্ধ্যায় মেয়েরা অনেকেই নাচলেন। পুরুষেরা বসেই রইলেন।
কে বলল, বাংলা গানে নাচা যায় না!




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.