|
এ বার শহরে |
জল-জঙ্গলের গল্প
সংবিদা লাহিড়ী |
|
হেলিকপ্টারে বসে আছি। নীচে দেখা যাচ্ছে ঘন জঙ্গল। দূরে একটা নদী। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে হঠাৎ হেলিকপ্টারটা নেমে এল একদম নদীর কাছাকাছি। মনে হচ্ছিল বোধ হয় ছিটকে পড়ে যাব নীচে।
নীচের জঙ্গলটার নাম আমাজন। অ্যানাকোন্ডার দেশ আমাজন। চারিদিকে গভীর জঙ্গল। সেই জঙ্গলের সবুজ ভেদ করে মাঝেমধ্যে চলেছে রুপোলি জলধারা। এক একটা নদী। হেলিকপ্টার নীচে নামলে বোঝা যায় নদীর বিস্তার। জলের মধ্যে পড়েছে জঙ্গলের ছায়া। এই জঙ্গলের মাটি কোনওদিন সূযের্র আলো পায় না, সবসময় ভিজে থাকে জল-কাদায়। অনেকটা আমাদের দেশের সুন্দরবনের মতো। হেলিকপ্টারে বসে ভয়ে যখন বুক কাঁপছে তখন দেখি একটা কুমির দিব্যি সাঁতরে পার হচ্ছে। জলের উপরে চোখ আর একটু ঘোরাতেই দেখলাম একটা নয়। ওরা সংখ্যায় অনেক। জল-জঙ্গল-বৃষ্টি এই তিনটিই হল ক্রান্তীয় আমাজনের মূল সম্পদ। আর এই তিন প্রাকৃতিক অবস্থার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে এখানকার কুমির। সেই ডাইনোসরের যুগ থেকে। |
|
আমাজনের জঙ্গলে সম্পূর্ণ অভিযান এখনও হয়নি। অভিযান হয়েছে খেপে খেপে নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে। তাই এই জলা-জঙ্গলে মোট ক’রকমের প্রাণী আছে তার ঠিক তথ্য এখনও বিজ্ঞানীকুলের অজানা। নদীর চার পাশে প্রায় কুড়ি লক্ষ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে আছে এই জঙ্গল। স্থানীয় আদিবাসীদের ছোট ডোঙায় এই জঙ্গলে ঘুরলে দেখা যাবে জলে কত রকমের মাছ খেলে বেড়ায়, কত রকমের সাপ চারিদিকে ঘুরছে। জলজ গুল্মের গায়ে ফুটে আছে কত রঙবেরঙের ফুল। উপরে হেলিকপ্টার আর জলে ডোঙা ছাড়া ওই জঙ্গলে ঘোরার আর একটা মাধ্যম রয়েছে। সেটা পুরোপুরি আমাজন স্টাইল।
কী সেটা? এখানকার আদিবাসীরা এক গাছের সঙ্গে অন্য গাছের মাথা দড়ি দিয়ে বেঁধে তৈরি করেছে ছোট ছোট সেতু। তার উপর দিয়ে হাঁটলে সেতুর সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীর দুলবে। ভয়ে চোখ বন্ধ করলাম। আদিবাসী সঙ্গীটি পিঠে হাত দিয়ে সাহস যোগাল। চোখ খুলতেই দেখলাম গাছের ডালে বাঁদরদের সংসার। বিভিন্ন পাখির বাসা। তা ছাড়াও কত ছোট বড় পোকামাকড়। |
|
আমাজনের সঙ্গে সুন্দরবনের মিল রয়েছে আরও একটা জায়গায়। সুন্দরবনের মতো এখানেও জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। তবে সুন্দরবনে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। আর আমাজনে জাগুয়ার। অনায়াসে তারা উঁচু গাছের মাথায় উঠতে পারে। আবার নদী সাঁতরে পারাপার করতে পারে। জঙ্গলে বহু ক্ষণ অপেক্ষা করে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে শিকারের উপরে। শিকারের প্রয়োজনে প্রায় কিছুই অসাধ্য নয় তাদের।
নদীর মাঝ বরাবর একটু মোহনার দিকে গেলে দেখা যায় বড় বড় ডলফিনের খেলা। আকারে বেশ বড়, চ্যাপ্টা এক প্রকারের মাছ আছে নদীর জলে। যারা জল থেকে লাফ দিয়ে পাড়ে উঠে শিকার করে আবার জলে ডুব দেয়। |
|
আমাজনের জঙ্গল যেন ভেষজ গাছের প্রদর্শনী। ওই গাছ-গাছড়া কাজে লাগিয়েই স্থানীয় আদিবাসীরা তৈরি করেছে নানান আয়ুর্বেদীয় ওষুধ। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যাকে পরোয়া না করে বংশ পরম্পরায় শেখা এই ওষুধের গুণেই রোগ সারে তাদের। পাশাপাশি রয়েছে বেশ কয়েক প্রকারের বিষাক্ত গাছও। যাদের বিষ প্রাণী শরীরে মিশলে মুহূর্তের মৃত্যু নিশ্চিত। এই সব গাছ স্থানীয় আদিবাসীদের নখদর্পণে। যেন জন্মের পর থেকেই এই শিক্ষাগুলিই পায় তারা। তাই এই সব বিষ তিরের ফলার মুখে লাগিয়ে রাখে। তাতে তাদের আত্মরক্ষা অথবা শিকার এই দু’য়েরই কাজে লাগে। |
|
এখানকার আদিবাসীদের গায়ে এখনও স্বল্পবাস। পাট-জাতীয় দড়ির স্কার্ট জাতীয় পোশাক মহিলা সকলেই পরে। ঊর্ধ্বাঙ্গ সকলেরই উন্মুক্ত। গলায় মালা, কানে দুল এ সবেও মহিলা-পুরুষে ভেদাভেদ নেই। সবচেয়ে অবাক হতে হয় এই আদিবাসীদের মধ্যে যে সব ছেলেমেয়ে যৌবনে পা দিল তাদের নিয়ে সারা গ্রাম উৎসবে মেতে ওঠে। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কিশোর-কিশোরীদের নীচের ঠোঁটের ভেতরে একটা অংশ গোল করে কেটে ফুটো করা হয়। তাতে একটা করে পশুর হাড় গুঁজে রাখা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার চিহ্ন হিসেবে এই নিয়মটাই চলে আসছে যুগযুগান্ত ধরে। |
|
আমাজন নামের এই তথ্যচিত্রটি দেখা গেল সায়েন্স সিটির স্পেস থিয়েটারে। পরিচালক কিথ মারিল দিনের পর দিন ওই জঙ্গলে গিয়ে পড়ে থেকেছেন। কথা বলেছেন স্থানীয় উপজাতিদের সঙ্গে। দেখেছেন স্থানীয় প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। দেখেছেন সেখানকার মানুষ কী ভাবে জল-জঙ্গলকে বুকে আঁকড়ে বেঁচে আছে। আধুনিকতার সংস্পর্শ থেকে বহু দূরে থেকেও মানুষ কী ভাবে ভেষজ উপায় কাজে লাগিয়ে রোগ সারায়।
সায়েন্ট সিটি কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, ছ’মাস এই ছবি চলবে। নতুন বছরে এটাই কলকাতাবাসীকে উপহার তাঁদের। |
|