প্রিয়ঙ্কা বঢরা উত্তরপ্রদেশে ভোট প্রচারে যাবেন। তাতে নতুন কী! গত সাত বছর ধরে উত্তরপ্রদেশে সব ক’টি বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনেই অমেঠি, রায়বরেলীতে প্রচারে গিয়েছেন সনিয়া-কন্যা। কিন্তু প্রশ্ন হল, রাহুল-সনিয়ার নির্বাচন কেন্দ্রের বাইরেও কি এ বার প্রচারে পা রাখবেন প্রিয়ঙ্কা? উত্তরপ্রদেশের জমিতে, দলের নিচুস্তরে সেই দাবি থাকলেও এ ব্যাপারে সাত-পাঁচ দ্বন্দ্বে ভুগছেন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার
ভার তাই রাহুল-প্রিয়ঙ্কার উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশ ভোটের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরের কংগ্রেস নেতারা।
প্রিয়ঙ্কার প্রচারকে কেন্দ্র করে দলীয় নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা আজ বলেন, সনিয়া-কন্যার জনপ্রিয়তা সন্দেহাতীত। সক্রিয় রাজনীতিতে তিনি থাকুন বা না-ই থাকুন, এখনও বিপুল সংখ্যক মানুষ তাঁর মধ্যে ইন্দিরা গাঁধীর ছায়া দেখতে পান। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রত্যয়, আত্মবিশ্বাস ও বুদ্ধিমত্তার ঝলক খুঁজে পান প্রিয়ঙ্কার মধ্যে। আর সমস্যাটা সেখানেই। কেন না, তখনই রাহুলের সঙ্গে তাঁর তুলনা চলে আসে। অমেঠি, রায়বরেলীর বাইরে প্রিয়ঙ্কার প্রচারে যাওয়ার প্রশ্নে দলের মধ্যে দ্বন্দ্বও এই বিষয়েই কেন্দ্রিভূত। কারণ, উত্তরপ্রদেশে রাহুলের সাম্প্রতিক সব সমাবেশের থেকে যদি প্রিয়ঙ্কার সভায় বেশি ভিড় হয়, তখন ভাইবোনের মধ্যে পুরোদস্তুর তুলনা শুরু হয়ে যাবে। অতীতে অমেঠি-রায়বরেলীতে রাহুল-প্রিয়ঙ্কার পৃথক সভা নিয়ে এই ধরনের তুলনা হয়েছে। তা মোটেও কাম্য নয় কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে। আবার বিরোধীরা এই প্রচার করতে পারেন যে, রাহুল একা পারলেন না। তাই প্রিয়ঙ্কাকে নিয়ে এলেন। তা ছাড়া একই সঙ্গে দু’জনকে প্রচারে নামানোর পরেও যদি উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের ফল ভাল না হয়! সেই ঝুঁকিটা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না দলের ওই শীর্ষস্থানীয় নেতা। তাই তাঁর মত, অমেঠি-রায়বরেলীর মধ্যেই প্রিয়ঙ্কার প্রচার সীমাবদ্ধ রাখা ভাল।
তবে এটাই কংগ্রেসের মধ্যে একমাত্র মত নয়। দলে ভিন্ন মতও রয়েছে। উত্তরপ্রদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, এখানে কংগ্রেসের ভাল ফল করা জরুরি। তার জন্য যা যা করার,
সবই করতে হবে। ভোটের ফল প্রকাশের পর সেটাই বিবেচিত হবে। অন্য কিছু নয়। তা ছাড়া ভাইয়ের লড়াইয়ে বোন শরিক হবে, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই।
মা-ভাইয়ের এলাকার বাইরে এক বারই প্রচারে গিয়েছিলেন প্রিয়ঙ্কা। সে বার গাঁধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ ক্যাপ্টেন সতীশ শর্মা প্রার্থী হয়েছিলেন সুলতানপুরে। তাঁর বিরুদ্ধে লড়ছিলেন অরুণ নেহরু। বাপ-কাকার বন্ধুর প্রচারে গিয়ে অরুণকে তুলোধোনা করেছিলেন প্রিয়ঙ্কা। বলেছিলেন, “এই অরুণ নেহরু আমার বাবাকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছে। তাকে সুলতানপুরে ঢুকতে কে দিয়েছে?” স্থানীয় কংগ্রেস কর্মীদের বক্তব্য, প্রিয়ঙ্কার ওই জনসভা ক’টির পরেই হাওয়া ঘুরে যায়। নিশ্চিত হেরে যাওয়া কেন্দ্রে জিতে যান সতীশ শর্মা। এ বার যেখানে উত্তরপ্রদেশে নিজেদের হারানো জমি ফিরে পেতে চাইছে কংগ্রেস, সেখানে কি এই প্রিয়ঙ্কা-ম্যাজিক কাজে লাগানো হবে না? এই প্রশ্ন বহু কংগ্রেস কর্মীরই।
রাহুলের প্রতিটি পদক্ষেপে পিছনে প্রিয়ঙ্কার পরামর্শের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তা গাঁধী পরিবারের ঘনিষ্ঠরাই স্বীকার করেন। সাম্প্রতিক কালে রাজনীতির অলিন্দে প্রিয়ঙ্কা বঢরাকে শেষ দেখা গিয়েছিল লোকসভার দর্শক গ্যালারিতে। অস্ত্রোপচারের পর মার্কিন মুলুকে এক হাসপাতালে তখনও ভর্তি ছিলেন সনিয়া গাঁধী। কিন্তু লোকসভায় লোকপাল বিল নিয়ে বিতর্কের সময় রাহুল গাঁধীর বক্তব্য শুনতে মাকে সে দেশে রেখেই এক দিনের জন্য দিল্লি চলে আসেন প্রিয়ঙ্কা। যে বক্তৃতায় লোকপালকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন রাহুল। তাঁর বক্তৃতাকে কেন্দ্র করে যখন বিরোধীরা উত্তাল, তখন দর্শক গ্যালারিতে বসে সে দিন ইশারায় ভাইকে ক্রমাগত উৎসাহ জুগিয়ে চলেন প্রিয়ঙ্কা। ভাইবোনের সেই রসায়ন ছিল নজরকাড়া ঘটনা!
সেই রাহুলই যখন উত্তরপ্রদেশে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন, তখন কি অমেঠি-রায়বরেলীর বাইরে প্রচারে যাবেন না প্রিয়ঙ্কা? দলের মধ্যে একটি মত হচ্ছে, রাহুল-প্রিয়ঙ্কাকে যৌথ সভায় আনো। তা হলে তো কোনও সমস্যা থাকবে না। আর উত্তরপ্রদেশে দলের প্রচার কমিটির চেয়ারম্যান তথা কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রী শ্রীপ্রকাশ জয়সওয়াল এই প্রশ্ন শুনে বলছেন, “উত্তরপ্রদেশে অবশ্যই প্রচারে যাবেন প্রিয়ঙ্কা গাঁধী। হতে পারে এ বার তিনি অমেঠি, রায়বরেলীর বাইরেও প্রচারে যেতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি কোথায় কোথায় প্রচার করবেন, সে ব্যাপারে রাহুল-প্রিয়ঙ্কাই সিদ্ধান্ত নেবেন।” উত্তরপ্রদেশ বা অন্য কোনও রাজ্যে সনিয়া গাঁধী যখন প্রচারে যান, তখন স্থান-কাল দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা বিবেচনা করে স্থির করেন। তবে এ বার প্রিয়ঙ্কার ক্ষেত্রে যে ব্যতিক্রম ঘটতে চলেছে, তা এখনই স্পষ্ট। কংগ্রেস শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, আপাতত স্থির হয়েছে, ১৩ থেকে ১৫ জানুয়ারি উত্তরপ্রদেশ সফরে যাবেন প্রিয়ঙ্কা। অমেঠি, রায়বরেলীর পাশাপাশি লখনউ, ইলাহাবাদ, বরাবাঁকি ও ফারুকাবাদে একটি করে সভা করার জন্য তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত প্রচারসূচি তৈরি না হলেও, প্রিয়ঙ্কার প্রচারের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য একটি তথ্যচিত্রের সিডি-ও তৈরি হয়েছে। ১২ জানুয়ারি প্রিয়ঙ্কার জন্মদিন। সে দিন থেকেই ওই সিডি উত্তরপ্রদেশে ভোট ময়দানে চলে আসবে। তবে মূল প্রশ্নটা রয়েই যাচ্ছে। ভাইয়ের লড়াইয়ে শরিক হতে কি এ বার শেষ পর্যন্ত অমেঠি-রায়বরেলীর বাইরে প্রচারে পা রাখবেন প্রিয়ঙ্কা? |