তিস্তা জট কাটেনি। এর মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আগামী ১১ জানুয়ারি ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ অনুষ্ঠানে আসছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার ঠিক আগে রেল মন্ত্রক আগরতলা-আখাউড়া প্রকল্পে অর্থ মঞ্জুরি করল, মমতারই উদ্যোগে। রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, ত্রিপুরায় যাওয়া ঠিক থাকলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে অবশ্য সেখানে যাচ্ছেন না শেখ হাসিনা। কিন্তু এই ঘটনাকে বড় করে দেখতে চাননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। ত্রিপুরা সিপিএম শাসিত বলে অথবা তাঁর নিজের রাজ্যে হাসিনা না আসায় কোনও ক্ষোভও রাখতে চাননি। বরং এ ক্ষেত্রে সার্বিক ভাবে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। মনে করা হচ্ছে, মমতার এই পদক্ষেপে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আখেরে লাভবান হবে। এমনকী এর ফলে তিস্তার জট খোলার পথও সুগম হবে।
গতকাল রেল ভবনে দু’দেশের রেল প্রকল্পগুলো নিয়ে বৈঠকে বসেন বিদেশ মন্ত্রক এবং রেলের কর্তারা। বৈঠকে আগরতলা থেকে বাংলাদেশের আখাউড়া পর্যন্ত রেল প্রকল্পে আর্থিক মঞ্জুরি দেওয়ার বিষয়টি ছাড়াও, দু’দেশের মধ্যে একটি কন্টেনারবাহী ট্রেন, মৈত্রী এক্সপ্রেসের যাত্রার সময় কমানোর বিষয়েও আলোচনা হয়। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টি নিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিলেন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর সঙ্গে। রেলমন্ত্রীর প্রতি তাঁর নির্দেশ ছিল, যে ভাবে হোক হাসিনা ত্রিপুরা যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে আর্থিক ছাড়পত্র দিতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ত্রিপুরা যাওয়ার বিশেষ কোনও রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকবে না। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী দীপু মণির কলকাতা সফরের সময়েও মমতা জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের প্রতি তাঁর যথেষ্ট ভালবাসা রয়েছে। তিনি চান, তিস্তা-সহ সমস্ত দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলিতেই যাতে অগ্রগতি ঘটে। তবে তা অবশ্যই রাজ্যের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে।
রেল মন্ত্রক জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহেই দীনেশ ত্রিবেদী আখাউড়া থেকে আগরতলার মধ্যে রেল প্রকল্পে ২৬০ কোটি টাকা মঞ্জুর করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন। গতকাল বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে রেল কর্তাদের বৈঠকে সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত হয়। আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে রেল আনুষ্ঠানিক ভাবে সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দেবে বলে কথা আছে। |
আগরতলা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রেল প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশের তরফে দাবি দীর্ঘদিনের। তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, এর ফলে ভারতের ব্যবসায়ীদেরও উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য পৌঁছে দিতে সুবিধা হবে। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে অবিভক্ত ভারতে আখাউড়া ছিল রেলের অন্যতম মুখ্য দফতর। সে সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ত্রিপুরায় পণ্য পৌঁছতে ওই লাইনটি ব্যবহার করা হত। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে আখাউড়া থেকে আগ রতলার মধ্যে ওই রুটটি বাঁচিয়ে তুলতে মাত্র ১৫ কিলোমিটার লাইন পাতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যার মধ্যে ভারতে থাকবে ৫ কিলোমিটার, বাকি অংশ থাকবে বাংলাদেশে। রেল মন্ত্রক জানিয়েছে, লাইন কোথা দিয়ে পাতা হবে সেই সমীক্ষার কাজ মোটামুটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তা শেষ হয়ে গেলেই কোথায়, কী ভাবে লাইন পাতার জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ ছাড়া দু’দেশের মধ্যে পণ্য পরিবহণে একটি কন্টেনারবাহী ট্রেন চালানোর প্রস্তাব রয়েছে ভারতের। পাশাপাশি, বাংলাদেশের দাবি, সপ্তাহে আরও বেশি দিন মৈত্রী এক্সপ্রেস চালানো হোক। সীমান্তে খোলা হোক শুল্ক দফতরের আরও একটি কাউন্টার। এই শুল্কসংক্রান্ত কারণে মৈত্রী এক্সপ্রেসের যাতায়াতে অতিরিক্ত সময় লাগে। এই সময় কমানোর অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। এ সব নিয়েও আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। এর মধ্যে বিষয়গুলো নিয়ে অগ্রগতি হলে ত্রিপুরা সফরে শেখ হাসিনা সুস্পষ্ট ঘোষণাও করতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে প্রশ্ন, কলকাতা না গিয়ে কেন আগরতলা যাচ্ছেন শেখ হাসিনা? বাংলাদেশ সরকার বলছে, ত্রিপুরার পক্ষ থেকে প্রায় দেড় বছর আগেই শেখ হাসিনাকে ওই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তুলনায় কলকাতা অনেক পরে আমন্ত্রণ জানায়। ফলে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশ সরকার দুই রাজ্যের মধ্যে আগরতলা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। দুই রাজ্যের সরকারের রাজনৈতিক পরিচয় ভিন্ন হলেও বাংলাদেশের কাছে মর্যাদার প্রশ্নে দুই রাজ্যই সমান। তবে বাণিজ্যিক কারণ বিচার করতে গেলে আগরতলার গুরুত্ব অনেক বেশি বাংলাদেশের কাছে। আগরতলার মাধ্যমে ত্রিপুরা-সহ গোটা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে নিজেদের বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়াতেও তৎপর ঢাকা। ফলে স্বভাবতই আগরতলা বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশের কাছে।
গত সেপ্টেম্বর মাসে মনমোহন সিংহের ঢাকা সফরের ঠিক আগে যে ভাবে মমতার আপত্তিতে তিস্তা চুক্তি ভেস্তে যায়, তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছিল হাসিনা সরকার। কার্যত হতাশ হয়েই ফিরতে হয় উত্তর-পূর্ব ভারতের চার মুখ্যমন্ত্রীকেও। তিস্তা জল বণ্টন নিয়ে কোনও সমাধান না হওয়ায় আটকে যায় ফেনি চুক্তিও। তার থেকেও বেশি সমস্যা দেখা দেয় পণ্য চলাচলের জন্য ভিন দেশের রাস্তা বা বন্দর ব্যবহার (ট্রানজিট) নিয়ে। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে সে সময়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তিস্তা চুক্তি না হলে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। এমনকী ছিটমহল হস্তান্তর চুক্তিও করতে বহু কষ্টে রাজি করানো হয় হাসিনা সরকারকে। এই পরিস্থিতিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ গড়ে তোলার বিষয়ে অগ্রগতিকে শুভ ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিদেশ মন্ত্রকের কর্তারা। |