পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’র ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’-এর ওই দৃশ্যটা মনে পড়ে? জিপচালক তাপস পাল অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে হন্যে হয়ে হাসপাতালে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আঁকাবাঁকা মেঠো পথে গাড়ি থামিয়েছেন চালক। লোকজনকে জিজ্ঞেস করছেন। গাড়ি ঘিরে স্থানীয় মানুষজন। ফ্রেমে ধরা পড়েছে দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ।
এই শীতে চেনাছকের বাইরে প্রকৃতির এমন অপার সৌন্দর্য দেখা যাবে হুড়া ব্লকের পুটিয়ারি জলাধারে। পুরুলিয়ায় এসে পুটিয়ারির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন বিভিন্ন চিত্রপরিচালক। পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁর মন্দ মেয়ের উপাখ্যানের পরে সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের ‘ক্যামেলিয়া’কেও এখানকার লোকেশনে সেলুলয়েডে ধরেছেন। শুধু বুদ্ধদেববাবুই নন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে পরিচালক অঞ্জন দাশগুপ্তের ‘বেদেনী’ ছবিরও অন্যতম লোকেশন ছিল এই পুটিয়ারি জলাধার। আরও নানান পরিচালক সাম্প্রতিক অতীতে পুটিয়ারিকে ধরেছেন তাঁদের মতো করে। বুদ্ধদেববাবুর কথায়, “শুরু থেকে পুরুলিয়াকে রুক্ষ বলে ভাবা হয়। কিন্তু পুরুলিয়ার একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। কাছে এলে তা বোঝা যায়। এই জলাধারটিরও একটা অন্য সৌন্দর্য রয়েছে।” |
ছবির নির্মাতারা যখন পুটিয়ারির এমন রূপে মজেছেন সাধারণ মানুষ তো তাঁর প্রেমে পড়তেই পারেন। বাঁকুড়ার বাসিন্দা বিজয় দে’র কথায়, “সেখানে আমি দু’বার গিয়েছি। শুধু জলাধারই নয়, সেখানে গেলে আকাশটাও অন্যরকম মনে হয়। তবে চড়ুইভাতি করতে দূরদূরান্ত থেকে যাঁরা আসছেন তাঁদের জন্য কিছু পরিকাঠামো গড়া দরকার।” তাঁর মতে, পুরুলিয়া বা আদ্রা স্টেশন কিংবা রঘুনাথপুরে পুটিয়ারি জলাধারের পথনির্দেশের বিষয়টি থাকলে পর্যটকদের সুবিধা হয়। কলকাতার গিরীশ পার্ক এলাকার বাসিন্দা সুজাতা কর সাহার কথায়, “আমার পুটিয়ারি খুবই ভাল লেগেছে। তবে এখানে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা থাকলে ভাল হত।” স্থানীয় বিধায়ক স্বপন বেলথরিয়া বলেন, “পুটিয়ারি জলাধারে ইদানীং প্রচুর মানুষ আসছেন। এই ধরনের অনালোকিত জায়গাগুলিতে পর্যটকদের সুবিধার জন্য কী কী করা দরকার তার বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী আমাদের রিপোর্ট দিতে বলেছেন। শীঘ্রই আমরা এলাকার বাসিন্দা ও পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে পর্যটন মন্ত্রীকে জানাব।”
চারপাশের উঁচু এলাকা থেকে বৃষ্টির জল পুটিয়ারি জোড়ে নেমে আসত। অনেক জল পাশের অন্য এলাকায় বেরিয়ে যেত। সেচ দফতর বেশ কয়েক বছর আগে পুটিয়ারিতে আরও বেশি জল জমার ব্যবস্থা করে। জলধারণ ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় পুটিয়ারি এখন জলাধারে পরিণত হয়েছে। ২২৫ একর জায়গা জুড়ে এই জলাধার। চারপাশে সবুজ গাছগাছালি। জলাধারের পাড়ে বসে দেখা যায়, খানিক দূরের তিলবনি পাহাড়। সেই পাহাড়ের নীচে বিরাট জঙ্গল। লোকমুখে প্রচার পেয়ে পুরুলিয়ার পাশাপাশি অন্য জেলা থেকেও শীতে পর্যটকেরা এখানে বেড়াতে আসছেন। পুরুলিয়া-বাঁকুড়া ৬০এ জাতীয় সড়কের উপরে লধুড়কামোড় থেকে প্রায় সাত কিমি দূরে এই জলাধার। আবার আদ্রা কিংবা আনাড়া স্টেশনে নেমেও সড়ক পথে এখানে আসা যায়।
পর্যটকদের আসতে দেখে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতির সম্ভাবনা দেখছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বাসিন্দারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে জলাধারে পর্যটকদের জন্য নৌকা বিহারের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁদের কথায়, “শীতের সময় লোকজন আসছে। যাত্রীদের নৌকায় চাপিয়ে আমাদের কিছু বাড়তি রোজগার হচ্ছে।” তাঁরা জানান, প্রশাসন এখানকার বিষয়ে প্রচার করলে বা এখানে রাত্রিবাসের জন্য হোটেল, লজ তৈরি করলে প্রচুর মানুষ আসবেন। যাঁরা আসেন তাঁরা এখানে রাত্রিবাস করতে চান। সেই সুযোগ নেই বলে ফিরে যান। পর্যটক বাড়লে এলাকার অর্থনীতির বিকাশ হবে। |