ভারতের তথ্যপ্রযুক্তির রাজধানী বেঙ্গালুরু হইতে ৩৮০ কিলোমিটার শারীরিক দূরত্বে এমন কিছু নয়। কিন্তু মানসিক দূরত্ব? সেখানকার একটি হিন্দু মন্দিরে আজও স্বর্গলাভের প্রত্যক্ষ তাড়নায় দলিতরা ব্রাহ্মণদের আহারের পর ফেলিয়া যাওয়া কলাপাতার উপর নারীপুরুষ নির্বিশেষে সাষ্টাঙ্গে গড়াগড়ি দেয়। পুণ্যার্জনের এই রোমহর্ষক দৃশ্য সচিত্র প্রতিবেদনে গণমাধ্যমে প্রকাশিত। বিগত সাতশো বছর ধরিয়া নাকি এই প্রথা চলিয়া আসিতেছে। বেঙ্গালুরু সাইবার-রাজধানীতে রূপান্তরিত হইলেও তাহার অদূরে সেই রূপান্তরের দীপশিখা পৌঁছায় নাই। সেখানে এখনও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্রাহ্মণ্য ভারতবর্ষের তমসাবৃত অমাবস্যা। ইহাই সনাতন ভারত এবং এই সনাতনত্বকে জিয়াইয়া রাখিতে যে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলি তৎপর, হিন্দুত্ববাদী বিজেপি তাহাদের অগ্রগামী। কর্নাটকে এই বিজেপিরই সরকার ক্ষমতাসীন এবং গণ-প্রতিবাদে নিষিদ্ধ হইয়া যাওয়া এই বর্বর প্রথাটি সেই সরকারের মন্দির বিষয়ক মন্ত্রী ভি এস আচার্যই পুনরুজ্জীবিত করার কৃতিত্ব দাবি করিতেছেন।
যাহা দীর্ঘ কাল চলিয়া আসিতেছে, তাহাই সনাতন। এবং যাহা সনাতন, তাহাই প্রশ্নাতীত, অভ্রান্ত। এই যুক্তিতে সতীদাহ হইতে বাল্যবিবাহ সকলই আধুনিক জনসমাজে অনুশীলন করিতে হয়। তখন আর সভ্য, শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, রুচিবান বা বিবেকবান হওয়ারও দরকার পড়ে না। মনু-পরাশরের সংহিতা শিরোধার্য করিয়া শূদ্র ও নারীকে পদতলে রাখিয়া উচ্চবর্ণীয়ের মহিমা উপভোগ করা যায়। ব্যক্তি ব্রাহ্মণের প্রতাপ গিয়াছে, কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাব অটুট। তাই জাতিভেদপ্রথা ও তাহার সবচেয়ে বর্বর অভিব্যক্তি অস্পৃশ্যতার প্রকোপ এখনও শক্তিশালী। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের পরিসরে থাকিয়াও একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন ব্রাহ্মণের ভুক্তাবশিষ্ট উচ্ছিষ্ট মাখানো কলাপাতায় শূদ্রের গড়াগড়ি খাওয়ার প্রথাকে সনাতনত্বের দোহাই দিয়া পুনরুজ্জীবিত করেন, তখন ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের সেই অপরাজেয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। ধিক্ এই সনাতনত্বকে।
কর্নাটকের বিজেপি মন্ত্রীর আর একটি যুক্তি, যাঁহারা খালি গায়ে ওই এঁটো কলাপাতার উপর গড়াগড়ি খান, সেই শূদ্ররাই পুণ্যার্জনের আশায় প্রথাটির প্রত্যাবর্তন চাহিয়াছেন। চাহিতেই পারেন। তাঁহাদের তো কেহ বুঝায় নাই যে ব্রাহ্মণ দ্বিজশ্রেষ্ঠ নয়, বরং শূদ্রের মতোই পাপী-তাপী কিংবা জন্ম নয়, কর্মই পাপপুণ্য নির্ণয় করে। যাঁহাদের বুঝাইবার কথা, সেই শিক্ষিত উচ্চবর্ণীয়রা শূদ্রের শিক্ষাহীনতাকে স্থায়িত্ব দিয়াছেন। শূদ্রের সমষ্টিগত অবচেতনে প্রোথিত ব্রাহ্মণের দেবত্বের উপকথাটি যত্নসহকারে অক্ষত রাখা হইয়াছে। তাই পুণ্যার্জনের ব্রাহ্মণ-নির্দিষ্ট পন্থাগুলিই শূদ্র এখনও নিষ্ঠাভরে অনুসরণ করিতেছে। রামস্বামী নাইকার পেরিয়ারের মতো কোনও সংস্কারক কর্নাটকের দলিত জনসমাজে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়িতে সচেষ্ট হন নাই। তাই তামিলনাড়ুর নিম্নবর্গীয় চৈতন্যে যে স্বাধিকারপ্রমত্ততা দ্রাবিড় আন্দোলনের মধ্য দিয়া প্রকাশিত, কর্নাটকে তাহার অনুরূপ কোনও আন্দোলন শূদ্র জাগরণের অনুঘটক হইতে পারে নাই। এই সীমাবদ্ধতাই ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্টস্পর্শে সাক্ষাৎ স্বর্গলাভের প্রলোভনটিকে শূদ্রদের মনে সঞ্চারিত রাখিয়াছে। একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের সরকার কিছুতেই এ ধরনের আত্মক্ষয়কারী অনগ্রসরতাকে জিয়াইরা রাখিতে পারে না। প্রজাকে অন্ধ তমসায় নিমজ্জিত রাখা নয়, তাহার যথার্থ মঙ্গলসাধনই প্রকৃত রাজধর্ম। |