রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের যে ‘টানাপোড়েন’ চলছে, তাতে তিনি আদৌ বিচলিত নন বলে সাফ জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রদেশ কংগ্রেসের ক্ষমতা ‘সীমিত’ বলে কটাক্ষ করে মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিলেন, জোট শরিক কংগ্রেসকে পশ্চিমবঙ্গে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ দল বলে তিনি মনেই করছেন না! সেই সঙ্গেই এ বার ভবানীপুর-কাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি কংগ্রেসকে জড়িয়ে দিলেন রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা।
মমতার মতে, রাজ্যে তৃণমূল বা তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেসের কিছু ‘সমস্যা’ হচ্ছে। কিন্তু তাঁর দিক থেকে কোনও সমস্যা নেই। বরং, কংগ্রেসের হাইকম্যান্ডের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ‘ভাল’। প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বকে মমতা ‘বার্তা’ দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান শাসক দল কংগ্রেসের সঙ্গে সর্বভারতীয় স্তরে তিনি ‘ভাল’ সম্পর্ক রেখেই চলেছেন।
জোটে ‘টানাপোড়েনে’র জন্য মমতা যে ভাবে রাজ্য কংগ্রেসকেই দায়ী করেছেন এবং ভবানীপুর-কাণ্ডের সঙ্গে তাদের নাম যুক্ত করেছেন, প্রত্যাশিত ভাবেই তা অস্বীকার করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীর এই সাম্প্রতিকতম বক্তব্যের পরে রাজ্যে জোট-রাজনীতি কোন খাতে যায়, তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে জোট শিবিরের অন্দরে।
রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বুধবার একটি সর্বভারতীয় বৈদ্যুতিন চ্যানেলে প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী পরিষ্কার বলেছেন, “কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রধান দল বটে। কিন্তু এ রাজ্যে কংগ্রেসের ক্ষমতা খুবই কম। কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল। তবে রাজ্যের কংগ্রেস তেমন গুরুত্বপূর্ণ দল নয়। যা সমস্যা ওদের (কংগ্রেসের)। আমার কোনও সমস্যা নেই।” একই সঙ্গে তাঁর অভিযোগ, “সিপিএমের হার্মাদরা রাজ্যের কংগ্রেসে যোগ দিয়েছে!” ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাসে’র প্রতিবাদে মমতার খাস তালুক হাজরা থেকে ময়দানে গাঁধী মূর্তির পাদদেশ পর্যন্ত যুব কংগ্রেস সভানেত্রী মৌসম বেনজির নূর, কংগ্রেস সাংসদ দীপা দাশমুন্সিদের মৌনী মিছিলকে ‘ফালতু’ বলে নস্যাৎ করার পাশাপাশিই ভবানীপুর-কাণ্ডে সরাসরিই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জনকে ঘিরে ভবানীপুর থানা আক্রমণ করার ঘটনায় কংগ্রেস জড়িত। আমি খবর পেয়ে থানায় গিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করেছি। এলাকায় শান্তি বজায় রাখতেই থানায় গিয়েছিলাম। কেননা, পরের দিন বখরি ঈদ ছিল।” ওই ঘটনায় অভিযুক্ত দু’জনকে তিনি লকআপ থেকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন বলে যে অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তুলেছে বিরোধীরা, তা-ও উড়িয়ে দিয়ে মমতা বলেন, “কিছু লোক এই মিথ্যেটা রটাচ্ছে! চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলছি, আমি কাউকে থানা থেকে ছাড়াতে যাইনি। কাউকে ছাড়াতে গেলে রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী হিসেবে আমার থানায় যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না!”
মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিযোগে ‘উষ্মা’ প্রকাশ করে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য পাল্টা বলেছেন, “ভবানীপুর-কাণ্ডে কংগ্রেসের কোনও সম্পর্ক নেই। ওই ঘটনা থেকে কংগ্রেস ১০০ কিলোমিটার দূরে ছিল! ওই ঘটনা নিয়ে ভাল করে অনুসন্ধান করা হোক। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় কোনও সংস্থাকে দিয়ে অনুসন্ধান করানো হোক।” সিবিআই তদন্ত চান কি না, জানতে চাওয়া হলে প্রদীপবাবু বলেন, “বিশেষ কোনও সংস্থার নাম করছি না।”
বেশ কিছু দিন ধরেই রায়গঞ্জে এইম্স ধাঁচের হাসপাতাল, মমতার উপরে হামলায় অভিযুক্ত মোক্তারকে কংগ্রেসে নেওয়া, আবার কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত রাম পেয়ারি রাম-খালেক মোল্লাকে তৃণমূলে নেওয়া, বগুলায় পুলিশের গুলিতে কংগ্রেসের মহিলা সমর্থকের মৃত্যু নিয়ে দুই শরিকের টানাপোড়েন চলছিলই। গত শুক্রবার মৌসম, দীপাদের মিছিল তাতে নতুন ইন্ধন যোগ করে। যার পরে মমতা কংগ্রেসকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। কংগ্রেস আবার পাল্টা হুঁশিয়ারি দেয় নেতাজি ইন্ডোরে পঞ্চায়েতি রাজ সম্মেলন থেকে। সেই ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গেই যোগ হল মমতার এ দিনের মন্তব্য। যার মধ্যে আছে এমন কটাক্ষও “হাজার খানেক লোক নিয়ে একটা ফালতু মিছিল (মৌসমদের) করেছে। লোকই তো হয়নি মিছিলে।” তাঁদের কর্মসূচিতে পাঁচ লক্ষাধিক লোকের ‘সমর্থন’ থাকে বলে দাবি করেছেন মমতা।
তৃণমূল নেত্রীর এমন ‘আক্রমণে’র জবাবে প্রদীপবাবুর বক্তব্য, “তৃণমূলের সরকারের সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেসের কোনও বিরোধ বা সমস্যা নেই। বিরোধে যাওয়ার প্রশ্নও নেই। যেটুকু বলতে হয়, দলের প্রয়োজনেই বলতে হয়। আমাদের লোকেরা আক্রান্ত হলে বলতে হয়। আমাদের কার্যালয় দখল করলে বলতে হয়। কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য না-পেলে বলতে হয়।”
সিপিএমের ‘দুষ্কৃতী’দের দলে নেওয়া নিয়ে এর আগে একাধিক বার তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে কংগ্রেস। আবার মোক্তারকে দলে নেওয়ায় সেই অভিযোগ ফিরেও গিয়েছে কংগ্রেসের দিকে। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় তা নিয়ে চিঠিও দিয়েছেন জোটসঙ্গীকে। এ বার স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই সরাসরি সেই অভিযোগ তোলায় দু’পক্ষের চাপানউতোর আরও ‘তপ্ত’ হয়েছে। প্রদীপবাবু যেমন পাল্টা বলেছেন, “হার্মাদরা কী করে কংগ্রেসে যোগ দেবে? হার্মাদদের হাতেই তো প্রচুর কংগ্রেস কর্মী খুন হয়েছেন। মেদিনীপুরের সবং, লালগড়, নারায়ণগড়, খড়্গপুর-সহ বিভিন্ন জায়গায় আমাদের কর্মীদের উপর হার্মাদরা অত্যাচার চালিয়েছে।”
বস্তুত, শুধু জোট শরিক কংগ্রেসের সঙ্গে ‘বিরোধ’ই নয়, মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীর কাছে এ দিন প্রশ্ন ছিল, তাঁর নিজের দলেও কাউকে ‘গুরুত্ব’ না-দেওয়া নিয়েও। তাঁর সরকার কি কেবলই ‘ওয়ান ওম্যান শো’? মমতা পাল্টা বলেছেন, “সনিয়া গাঁধী আর রাহুল গাঁধী ছাড়া ওঁদের দলে আরও কোনও নেতার নাম করা হয়? অ্যান্টনির (প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি) কথা কেউ বলে? জয়ললিতা বা মায়াবতীকে তো এই প্রশ্নটা করেন না? ওঁরা কী বলেন, আগে দেখুন। তার পরে আমায় বলবেন!”
কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তোপ দাগার পাশাপাশিই রাজ্যে শিশুমৃত্যু নিয়ে এ দিন ফের বিগত বামফ্রন্ট সরকারকেই দায়ী করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। শিশুমৃত্যুর নিরিখে মহারাষ্ট্র, কেরল, তামিলনাড়ুর পরে চতুর্থ স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, এ কথা ‘স্বীকার’ করেই মমতা দাবি করেন, “গত ৩৪ বছর ধরে বাম সরকার তো শিশুমৃত্যু রোখার মতো কোনও পরিকাঠামোই তৈরি করেনি। ছ’মাসে কী ভাবে করব আমরা! গ্রাম-গঞ্জে অপুষ্টিতে ভুগছেন প্রসূতিরা। হাসপাতালে না-এসে এখনও অসংখ্য ঘরেই প্রসব হচ্ছে।” তবে রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তৈরিতে তাঁরা যথেষ্ট উদ্যোগী বলে জানিয়ে মমতার বক্তব্য, “হাসপাতালগুলির অবস্থা ফেরানোর চেষ্টা চলছে। শিশুমৃত্যু এখন কিছুটা কমেছে।”
তাঁর সরকারের ৬ মাস পেরিয়ে এসে মুখ্যমন্ত্রীর সার্বিক ‘মূল্যায়ন’ “পাহাড়, জঙ্গলমহল ও সিঙ্গুরের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি। পাহাড়ে শান্তি ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। রেখেছি। ওখানে পুরভোটও হয়ে গিয়েছে। জঙ্গলমহলের আদিবাসী মানুষকে বিপিএল বলে ঘোষণা করেছি। সিঙ্গুরেও জমিটা ফিরে পাওয়া নিয়ে মামলা চলছে। আশা করি, মামলায় আমরাই জিতব। মানুষ টাটাদের পাশে নেই।” |