পঞ্চায়েতের প্রধান, উপপ্রধান-সহ বামপন্থী পঞ্চায়েত সদস্যেরা ইস্তফা দেওয়ায় উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এ ছবি বিষ্ণুপুরের। সম্প্রতি ইস্তফা দিয়েছেন পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএম সভাপতিও।
পদত্যাগকারীরা প্রকাশ্যে ‘ব্যক্তিগত’ বা ‘শারীরিক অসুস্থতা’ জনিত কারণের কথা বললেও জেলা সিপিএম নেতৃত্বের অভিযোগ, তৃণমূল ‘ভয়’ দেখিয়ে ওই সদস্যদের গণ-ইস্তফা দিতে বাধ্য করিয়েছে। তৃণমূল অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু ঘটনা হল, একাধিক পঞ্চায়েতে এই গণ-ইস্তফার কারণে কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। আখেরে গরিব মানুষেরা সমস্যায় পড়ছেন।
তবে শুধু বিষ্ণুপুর নয়, এই একই ঘটনা ঘটেছে হুগলির আরামবাগ বা পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর, গড়বেতা ও জঙ্গলমহলের ১১টি ব্লকে। গত ১৫ অক্টোবর মেদিনীপুরে বিডিও-দের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, যে-সব পঞ্চায়েতে সদস্যদের অনুপস্থিতি বা ইস্তফার জেরে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, সেখানে বিডিও-রাই দায়িত্ব সামলাবেন। এর পরে রাজ্য সরকার নির্দেশিকা জারি করে ব্লক, মহকুমা ও জেলা স্তরে পঞ্চায়েতের কাজকর্ম দেখভালে ত্রিস্তরীয় তদারকি কমিটি গঠনের কথা বলে।
রাজ্যের রাজনৈতিক পালাবদলের পরে রাজ্যের আবাসনমন্ত্রী তথা জেলা তৃণমূল সভাপতি শ্যাম মুখোপাধ্যায়ের ‘খাসতালুক’ বিষ্ণুপুরের বামফ্রন্ট (মূলত সিপিএম) পরিচালিত কয়েকটি পঞ্চায়েতের সদস্যেরা বিডিও-র কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। তাঁরা সকলেই ‘ব্যাক্তিগত কারণ’ উল্লেখ করেছিলেন। কয়েক জন পঞ্চায়েত সদস্য পরে ইস্তফাপত্র প্রত্যাহারও করে নেন। কিন্তু উলিয়াড়া ও দ্বারিকা-গোঁসাইপুর পঞ্চায়েতের সদস্যেরা তা করেননি। ওই দুই পঞ্চায়েতেই সমস্যা বেশি। |
১১ সদস্যের উলিয়াড়া পঞ্চায়েতের সিপিএমের ৯ জন ও ফরওয়ার্ড ব্লকের ৩ জন সদস্য ছিলেন। পুজোর আগে ওই পঞ্চায়েতের প্রধান, উপ প্রধান-সহ সব সদস্য ইস্তফা দেন। দেড় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরে সেখানে আজও ‘প্রশাসক’ নিয়োগ করা হয়নি। ফলে থমকে গিয়েছে পঞ্চায়েত এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ। সমস্যায় পড়েছেন বিভিন্ন প্রকল্পের উপভোক্তারা। পঞ্চায়েতে বিভিন্ন কাজে আসা মানুষ খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন।
উলিয়াড়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমস্যা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে ওই পঞ্চায়েত পরিচালিত দাতব্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসালয়ে ওষুধপত্রও কেনা বন্ধ গিয়েছে। ফলে রোগীরা ওষুধ পাচ্ছেন না। উলিয়াড়া গ্রামেরই সত্তোরর্ধ্ব বৃদ্ধা গীতা কুম্ভকার বলেন, “‘বিনা পয়সায় এত দিন ওষুধ পেতাম। এখন তা বন্ধ।” জরুরি দরকারে আয়ের শংসাপত্র দরকার বেলিয়াড়া গ্রামের মোহর আলি মণ্ডলের। তাঁর কথায়, “ওই শংসাপত্রের খুব দরকার ছিল। কবে যে পঞ্চায়েতের জট খুলবে, বুঝতে পারছি না।”
সদস্যদের ইস্তফার জেরে উন্নয়ন সংক্রান্ত বেশিরভাগ কাজই যে থমকে রয়েছে, তা স্বীকার করে উলিয়াড়া পঞ্চায়েতের সচিব শঙ্করকুমার মজুমদার বলেন, “ এই এলাকার জন্ম-মৃত্যুর শংসাপত্র দেওয়া থেকে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পসব কিছুই থমকে গিয়েছে। টাকার অভাবে দাতব্য চিকিৎসালয়ের ওষুধও আনা যাচ্ছে না। কারণ, টাকা মঞ্জুর করতেন প্রধান।” বিষ্ণুপুরের বিডিও সুদীপ্ত সাঁতরা বলেন, “নানা প্রকল্পের টাকা আটকে রয়েছে। খরচ করা যায়নি। তবে, শীঘ্রই ‘প্রশাসক’ নিয়োগ করে সমস্যার সমাধান করা হবে।”
অন্য দিকে, দ্বারিকা-গোঁসাইপুর পঞ্চায়েতের ১০ জন সদস্যের মধ্যে সিপিএমের ৮ জন এবং ফরওয়ার্ড ব্লক ও তৃণমূলের এক জন করে সদস্য ছিলেন। মাস দু’য়েক আগে বামফ্রন্টের ৯ জন সদস্যই ইস্তফা দেন। নিয়ম অনুযায়ী ওই পঞ্চায়েতে সম্প্রতি প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, তাতে সমস্যা মেটেনি। প্রধান ও সদস্যেরা না থাকায় অনেক কাজ আটকে যাচ্ছে। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রশাসক জন্ম-মৃত্যুর শংসাপত্র দিতে পারেন না। এ জন্যও অনেকে সমস্যায় পড়েছেন।
এ সবের মধ্যেই বিষ্ণুপুর পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএম সভাপতি অসিত মাঝি সম্প্রতি ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দর্শিয়ে পদত্যাগ করেছেন। তাঁর সঙ্গে সিপিএমের আরও দুই সদস্য পদত্যাগ করেন। তবে সভাপতি ইস্তফা দেওয়ায় পুরনো বা নতুন কোনও প্রকল্পের কাজ বন্ধ হচ্ছে না বলে বিডিও জানান। তিনি বলেন, “বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি বিডিও হিসেবে আমি দেখি। তাই সমস্যা হচ্ছে না। নতুন বা পুরনো প্রকল্পের কাজও চলছে।” সহ-সভাপতিকে সভাপতির কাজ দেখতে বলা হবে বলেও তিনি জানান।
এই ব্লকেরই অযোধ্যা, রাধানগর, বেলশুলিয়া, লায়েকবাঁধ ও মড়ার পঞ্চায়েতগুলিতে বামপন্থী তথা সিপিএম ক্ষমতায় ছিল। ওই পঞ্চায়েতগুলির কয়েক জন বামপন্থী সদস্য ইস্তফা দিয়েছেন। যাঁরা ইস্তফা দেননি, তাঁদের সিংহভাগ তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। অনাস্থা এনে সিপিএমের প্রধান, উপপ্রধানদের সরিয়ে নতুন প্রধান, উপপ্রধান নির্বাচন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, বিষ্ণুপুর ব্লকের ৯টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ভড়া বাদে সব ক’টিই বামফ্রন্টের দখলে ছিল। শুধু বাঁকাদহ পঞ্চায়েতের কেউ এখনও ইস্তফা দেননি।
সিপিএমের বিষ্ণুপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক পরেশ মানিকের অভিযোগ, “আমাদের দলের পঞ্চায়েত সদস্যদের ভয় দেখিয়ে তৃণমূল ইস্তফা দিতে বাধ্য করিয়েছে। অনেক জায়গায় কৌশল বদলে আমাদের দলের পঞ্চায়েত সদস্যদের সমর্থন আদায় করে পঞ্চায়েতের ক্ষমতা ভোগ করছে।” উলিয়াড়া এলাকার এক সিপিএম নেতা বললেন, “পঞ্চায়েতের সব সদস্য ইস্তফা দেওয়ার পরে গ্রামাঞ্চলে কাজ বন্ধ দেখেও আমরা কার্যত চোখ বন্ধ রাখছি। প্রতিবাদ আন্দোলনে নামার মতো কর্মী-সমর্থকও জুটছে না।”
বিষ্ণুপুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি মথুর কাপড়ির অবশ্য দাবি, “সিপিএমের পঞ্চায়েত সদস্যেরা কেন পদত্যাগ করেছেন বলতে পারবো না। হতে পারে নিজেদের দলের গোষ্ঠীকোন্দলেই তাঁদের এই সিদ্ধান্ত।” |