স্ত্রী না গাড়ি! কে বেশি পছন্দের তা নিয়ে মজা করতেন আত্মীয়-পরিজনেরা। শুনে হাসতেন নীরজ।
মধ্যপ্রদেশের গ্বালিয়রের ঋষিনগরের বাড়ি থেকে গত এপ্রিল মাসে সদ্য কেনা ঘি রঙের নতুন ‘আই টোয়েন্টি’ চেপে স্ত্রী অনুমিতা সিং গৌরকে সঙ্গে নিয়ে কল্যাণীতে এসেছিলেন নীরজ। কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নীরজ গৌর।
|
মৃত অনুমিতা সিং গৌর। |
আগের মাসেই চাকরিটা পান নীরজ। গুছিয়ে সংসার করতেই সদ্য বিবাহিত স্ত্রী আর নতুন গাড়ি নিয়ে কল্যাণীর এ ব্লকের একটি আবাসনের তিনতলায় ফ্ল্যাট ভাড়া করেন। অনুমিতাও চিকিৎসক। চাকরির খোঁজ করছিলেন তিনিও। সেই সূত্রে ধরেই দিন কয়েক আগে তাঁর নামে হিমাচল প্রদেশে চাকরির পরীক্ষার ইন্টারভিউয়ের চিঠি আসে। ইন্টারভিউ দিতে যেতেই সোমবার রাতে ব্যাগ গুছিয়ে ব্যান্ডেল থেকে দুন এক্সপ্রেসের এসি কামরার যাত্রী ছিলেন অনুমিতা। স্ত্রীকে কেলা ছাড়বেন না বলে সঙ্গে ছিলেন নীরজও। প্রতিবেশীদের বলে গিয়েছিলেন গাড়িটার দিকে একটু নজর রাখতে, ফিরে আসবেন খুব শিগগিরই। কিন্তু সোমবার রাতের ঘটনা নীরজের জীবনের সবকিছু উল্টে দিয়েছে। দুন এক্সপ্রেসের এসি কামরায় অগ্নিকাণ্ডে হারিয়েছেন তাঁর প্রিয়তমাকে। ট্রেনে অনুমিতার সঙ্গে গল্প করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নীরজ। স্ত্রী’র সঙ্গে সেই শেষ দেখা, শেষ কথা। মাঝরাতে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঘুম ভেঙেছিল নীরজের। আগুন আর ধোঁয়ার মধ্যে অনুমিতার পা ধরে টেনে নামানোর চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। শেষ পর্যন্ত কূপের দরজা ভেঙে বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কোনওরকমে। জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে। জ্ঞান ফিরতেই আইটিইউ’তে থাকা নীরজ বার বার স্ত্রী’র খোঁজ করেছেন চিকিৎসকদের কাছে। বার বারই চিকিৎসকেরা তাঁকে শান্ত থাকার পরামর্শ দিয়ে মুখ ফিরিয়েছেন। চিকিৎসকদের এ হেন ‘অবহেলা’ স্ত্রী-র বেঁচে থাকা নিয়ে ক্ষীণ আশাটুকু জাগিয়ে রেখেছিল তাঁর মনে। |
কিন্তু বুধবার যখন ধানবাদের শ্মশানে অনুমিতার পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া দেহটা সৎকার করা হচ্ছিল তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি নীরজ। চিকিৎসকদের বারণ সত্ত্বেও জোর করে শ্মশানে গিয়েছিলেন। যে চুড়ি আর হাতঘড়ি দেখে অনুমিতাকে শনাক্ত করেছিলেন তাঁর বাবা-মা, সেগুলো দেখতেও চেয়েছিলেন একবার। পরে ফের হাসপাতালে ফিরিয়ে আনা হয় তাঁকে।
টেলিফোনে নীরজ বললেন, ‘‘ধোঁয়ার তীব্রতায় শ্বাসকষ্টে ঘুম ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ওকেও টেনে তোলার চেষ্টা করি। কিন্তু পারলাম না। দরজাটাও লক হয়ে গিয়েছিল। সেটাকে মরিয়া হয়ে ভাঙার চেষ্টা করছিলাম কয়েকজন। দরজাটা ভাঙার পরে কামরার বাইরে পড়ে গেলাম। আর কিছু মনে নেই। মুহূর্তে সব কেমন ছারখার হয়ে গেল। অনুমিতা নেই, কিছুতেই মানতে পারছি না।’’
মেনে নিতে পারছেন না কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজের অন্য শিক্ষক ও কর্মীরাও। এমনকী নীরজ-অনুমিতার ‘সুখের সংসারে’র প্রতিবেশীরা। মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘উনত্রিশ বছরের ছটফটে তরুণ নীরজ। তেমনি ওঁর স্ত্রী। ওঁর স্ত্রী দাঁতের চিকিৎসক। এই কলেজেও চাকরির চেষ্টা করেন। এখানে সুযোগ না হওয়ায় বাইরে চেষ্টা করছিলেন। মঙ্গলবার দুপুরে খবরটা পেয়ে আমাদের দু’জন শিক্ষক ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। নীরজের স্ত্রী’র মৃত্যুটা আমাদের কাছে প্রচণ্ড ‘শক’। এই ক’দিন আগে আমাদের কলেজের অনুষ্ঠানে ওঁরা দু’জনে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে হৈ-হৈ করে অনুষ্ঠান করলেন।’’
কল্যাণী এ-৮/৫০-এ’র বহুতলের তিনতলায় ৫ নম্বর ফ্ল্যাটটি নীরজ আর অনুমিতার। দরজায় নেম প্লেটে দু’জনের নামের পাশে ফোন নম্বর লেখা। জরুরি প্রয়োজনে ফোন করার জন্য। প্রতিবেশীরাও নীরজ-অনুমিতার দুর্ঘটনার কথা জানতেন না। পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা মন্দিরা সরকার বলেন, ‘‘একদিন আগেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ গল্প হল। ওঁদের কোনও আত্মীয় এখানে থাকেন না। এই কয়েক মাসেই আবাসনে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলেছিলেন। অনুমিতা বাংলা বলতে পারতেন না। কিন্তু বুঝতেন। দু’জনেই খুব হাসিখুশি ছিলেন। গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন মাঝেমাঝে। স্ত্রীকে এত ভালবাসতেন যে গাড়িতে নাম লিখে রেখেছিলেন ওঁর স্বামী।”
আর এক প্রতিবেশী অঞ্জনা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ওই ইন্টারভিউ-এর চিঠিটা ক্যুরিয়ারে এসেছিল। সেদিন ওঁরা ছিলেন না। আমিই সেটা নিয়েছিলাম। কিন্তু সোমবার যে ওঁরা গিয়েছেন তা জানতে পারিনি। গাড়িটা আছে দেখে ভেবেছিলাম ওঁরাও আছেন। কারণ যেখানে যেতেন গাড়িতেই তো যেতেন।’’ আবাসনের সামনেই দাঁড় করানো ছিল নীরজের ‘আই টোয়েন্টি’। ড্যাসবোর্ডে উজ্জ্বল করে লেখা অনুমিতার নামটা এখন শুধুই স্মৃতি। স্ত্রী নেই। গাড়িটা আছে। ফিরে এসে তাতে চড়তে পারবেন কী নীরজ?
|