মোহনবাগান- ১ (ওডাফা পেনাল্টি)
ইস্টবেঙ্গল-০
|
কল্পনা করে নেওয়া যাক, ৩৫ বছর আগের ইডেনের সামনের রাস্তা।
তখন গঙ্গার দিক থেকে হাওয়া বইত মৃদুমন্দ। সকালের দিকে বব উইলিস, ক্রিস ওল্ড, জন লিভারের মতো সুইং বোলাররা সাহায্য পেতেন। ক্রিকেট দেখতে হাজির থাকত কমলালেবু, উলের সোয়েটার বোনা, কাঁসর ঘণ্টা, হাজার হাজার মানুষ।
সেখানেই মহম্মদ আকবরের একটা ১৬ সেকেন্ডের গোল পাল্টে দিয়ে যায় মোহনবাগান সমর্থকদের দীর্ঘ দুঃখ ও যন্ত্রণার বারমাস্যা। ইডেনের সামনের রং বদলে গেছিল সবুজ-মেরুনে।
রবিবার রাত পৌনে ন’টার সময় ইস্টার্ন বাইপাসের সামনের রংটা ও রকমই সবুজ-মেরুন হয়ে গেল। যে সব ম্যাটাডর যাচ্ছে, সবার মাথায় সবুজ-মেরুন পতাকা। অগ্রহায়ণের গ্রাম বাংলার খেত ভরে উঠেছে সোনালি আমন ধানে। ধান কেটে গোলা ভর্তির কাজ চলছে। মোহনবাগান সমর্থকরাও যেন সোনালি ধান তুললেন গোলায়। দীর্ঘ দিন পরে ইস্ট-ভারতী আবার মোহন-ভারতী।
লোডশেডিং? তাঁদের কাছে অর্থহীন। কোনওমতে বাঁচা? অর্থহীন। বিতর্কিত পেনাল্টিতে জয়? অর্থহীন।
পঁয়তিরিশ বছর আগে বড় ম্যাচের পর দিন আনন্দবাজার পত্রিকার শিরোনাম ছিল, “ইস্টবেঙ্গল খেলেছে, মোহনবাগান জিতেছে।” সেই শিরোনাম এই ম্যাচের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়। |
লক্ষ লোকের সামনে রবিবার দ্বিতীয়ার্ধের একটা সময় ম্যাচের সংগ্রামটা দাঁড়িয়েছিল সংগ্রাম বনাম ইস্টবেঙ্গল। সঞ্জুর শট, বলজিতের হেড কোনও মতে সেভ করে যাচ্ছিলেন সংগ্রাম। ভাসুমের হেড অল্পের জন্য বেরিয়ে গেল। পেন ওর্জি বল ধরলেই মনে হচ্ছিল, অমর কিছু সৃষ্টি হবে। মোহনবাগানের যাবতীয় বোঝাপড়ার ছবিটা ছেলেবেলার ঝুলনের দৃশ্য তৈরি করার মতো লাগছিল। ঘাস দিয়ে সবুজ পাহাড় হয়েছে। ত্রিপল ও তুলো দিয়ে বরফ। নল দিয়ে ঝর্ণা। আসলে যে ওগুলো কিছুই না বোঝা যেত সব ভেঙে দিলে। তেমনই দ্রুত ঝুরঝুরে হয়ে যাচ্ছিল মোহনবাগানের মাঝমাঠ। সংগ্রাম এই জায়গায় অনন্য ভরসা দিলেন।
আগের দিন ম্যাঞ্চেস্টার সিটির প্রাক্তন কিপার জন বুরিজ মোহনবাগান মাঠে আবিষ্কার করেছিলেন, ২০০২ সালের বুসান এশিয়াডে তিনি কোচিং টিপস দেন সংগ্রামকে। মোহনবাগান কিপারের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেন খ্যাপাটে বুরিজ। তার পরেই কি আমূল বদল কাঁচরাপাড়ার ছেলেটির?
এই ম্যাচটার আগে পর্যন্ত সংগ্রামকে আনফিট দেখাত। গোল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে সমস্যা। লক্ষ লোকের যুবভারতীতে তিনি পুরনো সংগ্রাম। ইস্টবেঙ্গল কিপার গুরপ্রীতের ভক্ত বুরিজের গলায় ম্যাচ শেষে অন্য স্বীকৃতি, “ও ম্যান অফ দ্য ম্যাচের থেকেও বেশি।”
লক্ষ লোকের গ্যালারির সামনে সংগ্রাম নন, জয়ের দৌড় দিচ্ছিলেন ‘মোহনবাগানের বাঞ্ছারাম’ওকোলি ওডাফা। বলই আসেনি বেশি। যখন এসেছে, ওডাফা তাঁর দুন্দুভি বাজিয়েছেন ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্সে। ‘বাঞ্ছারাম’ বলেও যে জন্য ওডাফাতেই সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ছিল ইস্টবেঙ্গল ভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রীর। বিরতির ওই মারাত্মক চাপের মধ্যেও সুনীল ছেত্রীর জন্য ওডাফা রেখেছিলেন অভ্রান্ত সিটার। ওটা হলে ২-০ হত। এমনিতে ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে হওয়ার কথা ছিল ৪-২।
পেনাল্টিটা কি ছিল আদৌ? অবশ্যই বিতর্কিত। সুনীলকে ওপারার ট্যাকলটা এমন ভাবে হল, দুটো ব্যাপারই হতে পারে। রেফারিদের পক্ষে কঠিনতম পরিস্থিতি। সুনীলকে ওপারা ট্যাকলটা করেছিলেন বল-এ পা চালাবেন বলেই। সেটা বলে লেগে যায় পায়ে। রেফারি প্রতাপ সিংহর উচিত ছিল সহকারী রেফারির সঙ্গে কথা বলা। পেনাল্টি নিয়ে তিনি সত্যিই যদি নিশ্চিত হন, তা হলে ওপারাকে হলুদ কার্ড দেখাতে দেরি করলেন কেন?
২৬-১১-র বর্ষপূর্তি হওয়ার মুখে প্রতাপ সিংহই ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের চোখে নতুন আতঙ্কবাদী। এই ম্যাচ মোহনবাগান আয়োজন করেছিল বলে রেফারিদের দায়িত্বে ছিল তারাই। ফলে ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের তীব্র অসন্তোষ সহজবোধ্য। এ বার থেকে বড় ম্যাচ কোনও ক্লাব আয়োজন করলে ফেডারেশনের দেখা উচিত, অন্তত রেফারিংয়ের দায়িত্বে যেন জাতীয় সংস্থার আলাদা টিম থাকে। এই দায়িত্ব ক্লাবের হাতে ছাড়া উচিত নয়। তা হলে এত সন্দেহ, এত বিতর্ক হবে না। |
ম্যাচটার শুরু থেকে দুই কোচ একেবারে সাইডলাইনের সামনে দাঁড়িয়ে। যত সময় গেল, মর্গ্যানের অঙ্গভঙ্গি ছিল দেখার মতো। অচেনা মর্গ্যান। টিমটা ওয়ার্ম আপ করার সময় থেকে তিনি ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির দিকে সবাইকে নিয়ে গেলেন। দলটাকে লক্ষ লোকের সামনে তাতাতে। ম্যাচ চলাকালীন একবার সহকারী রেফারির দিকে, একবার চতুর্থ রেফারির দিকে তেড়ে গেলেন। মোহন-ইস্ট ম্যাচে জয়ের রেকর্ড ধুয়ে যাচ্ছে দেখে তীব্র উত্তেজিত। সুব্রত ভট্টাচার্য সেখানে সারাক্ষণ অনেক ঠান্ডা। তিনিও অচেনা সুব্রত। শুধু ম্যাচটা শেষ হওয়ার সময় তিনি দু’হাত ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন। ওটাই আসল সুব্রত।
রক্ষণ খারাপ, রক্ষণ খারাপ বলে সুব্রতর চারপাশের পরিবেশ এত আতঙ্কিত হয়েছিল, মোহন-টিডির রাতের ঘুম উধাও ছিল এতদিন। রাতেও জেগে উঠেছেন অনেক বার। এই ম্যাচটায় দেখা গেল, প্রথম থেকেই রক্ষণকে সাহায্য করতে মোহনবাগানের মাঝমাঠ মিডল থার্ড ছেড়ে নিজেদের ডিফেন্সিভ থার্ডেই বেশি ঘুরছেন। ওডাফা এবং সুনীল ছেত্রীর সঙ্গে ব্যারেটো-নবিদের বিশাল ব্যবধান। ধ্বংসাত্মক ফুটবল। চাপে থাকার ফুটবল।
পাহাড়ি ছেলেদের অপাপবিদ্ধ মুখ থাকে, কিন্তু ফুটবল পায়ে পড়লেই হয়ে ওঠেন নিষ্ঠুর গোলন্দাজ। সঞ্জু, ভাসুম, রবার্ট, নওবারা প্রথম থেকেই গতি ও পাসিংয়ে চোখে পড়ছিলেন। যা মোহনবাগানে দেখাই যায়নি। বিরতির পরে ইস্টবেঙ্গলের আক্রমণ তেলের মধ্যে পাঁচফোড়ন পড়ার মতো ব্যাপার, আরও ঝাঁঝ। মোহনবাগান তখন জয় ধরে রাখতে মরিয়া ডিফেন্সে। বিরতির প্রথম থেকেই ব্যারেটো নেমে আসছেন ড্যানিয়েল-কিংশুকদের গায়ে। নবি, জুয়েল রাজারাও তাই।
ইস্টবেঙ্গল চাপ রেখেও পারল না তিনটি কারণে।
এক) টোলগে না থাকায় তাদের ফরোয়ার্ড লাইনে ঝাঁঝ ছিল না। গাও স্ট্রাইকার নন। পেনাল্টি বক্সের মধ্যে এমন ডাইভ দিচ্ছেন, তাতে টটেনহ্যামে ক্লিন্সমানের কথা মনে পড়ায়।
২) মেহতাব না থাকায় তারা লং বল স্টাইল থেকে বেরোতে পারল না। আক্রমণের ধারা হয়ে গেল এক রকম। শুধু লং বল। শুধু লং বল।
৩) লোডশেডিংয়ে খেলা বন্ধ হওয়ায় তাদের অসুবিধেই হল বেশি। দম পেয়ে গেলেন ক্লান্ত মোহন-ফুটবলাররা।
চার নম্বর কারণটা রাখতে হবে? তা হলে মোহনবাগানের নতুন অস্ট্রেলিয়ান স্টপার ড্যানিয়েল জেলেজনি-র কথাটা রাখুন। একেবারে অচেনা অ্যাস্ট্রোটার্ফ, অচেনা পরিবেশে নেমে তাঁর মধ্যে দেখা গেল উঠে-নেমে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রবণতা। গতি ভাল, হেডিংও। দেখে মনে হল না, তিনি আসলে সাইডব্যাকের ফুটবলার। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বেঁটেখাটো কিংশুক দেবনাথকে দেখাচ্ছিল অমিত ভদ্র বা অচিন্ত্য বেলেল। যাঁরা সব সময় ঝুঁকিহীন খেলতেন। নবি এ দিনও ফুসফুসে কয়েকশো টন অতিরিক্ত বাতাস ভরে খেললেন। যতটুকু অভাব থাকছিল, তা ঢেকে দিলেন ব্যারেটো। পরিশ্রমে, বুদ্ধিতে। সেটাই সংগ্রাম হয়ে ছড়াল বাকিদের মধ্যে।
সুব্রত আজ রাতে শান্তিতে ঘুমোবেন এই ছেলেগুলোর জন্যই। উনিশশো ছিয়াত্তর, আকবর, ১৬ সেকেন্ড, ইডেন, কপালউড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। “সে বার তো একটা সুযোগও পাইনি গোল ছাড়া। এ বার তো গোটা চারেক ভাল চান্স পেয়েছিলাম। ওরা তুলে তুলে ছাড়া খেললটা কী?”
বাবলুবাবু ফিরে গিয়েছেন নিজস্ব মেজাজে। পাড়ায় পাড়ায় মোহনবাগান ভক্তরাও।
মোহনবাগান: সংগ্রাম, সুরকুমার, ড্যানিয়েল, কিংশুক, ধনরাজন, জুয়েল, ব্যারেটো, রাকেশ (স্নেহাশিস), নবি, সুনীল, ওডাফা।
ইস্টবেঙ্গল: গুরপ্রীত, রবার্ট, নির্মল, ওপারা, নওবা, সঞ্জু (রবিন্দর), সুশান্ত (বলজিৎ), পেন, ভাসুম, গাও, রবিন।
|
বাগানের দুই নায়ক। ওডাফা ও সংগ্রাম। ছবি: সুমন বল্লভ ও উৎপল সরকার |