দর্শক সংখ্যায় লিও মেসির আর্জেন্তিনাকে হারিয়ে দিল কলকাতার ডার্বি। কিন্তু সেই ম্যাচের মতোই এ দিনও কলকাতাকে ডুবতে হল লজ্জার অন্ধকারে। সেই সরকারের সাংগঠনিক ক্রুটি। সেই স্টেডিয়ামের ফ্লাডলাইট নিভে গোটা মাঠ আঁধারে ঢাকা পড়ে ম্যাচ সাময়িক বন্ধ হয়ে যাওয়া!
বিদ্যুৎ বিভ্রাটই শুধু নয়, সঙ্গে আরও দু’টি লজ্জা জড়িয়ে রইল মরসুমের প্রথম ডার্বির সঙ্গে। পেনাল্টি-বিতর্ক এবং খেলার শেষে আচমকাই ১৯৮০-র ১৬ অগস্টের দুঃস্বপ্ন ফিরিয়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায়।
উত্তরাখণ্ডের রেফারি, র্যাঙ্কিংয়ে গোটা দেশের এক নম্বর প্রতাপ সিংহের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনার মধ্যেই স্টেডিয়ামের এক নম্বর গেটে ম্যাচের পর ভিড়ের চাপে পদপিস্ট
হয়ে আহত হলেন বারো জন।
সকলকেই হাসপাতালে নিয়ে যান স্থানীয় মানুষ। দশ জনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও অমর সর্দার ও অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামে দু’জন দর্শক বাইপাসের ধারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি। অবস্থা আশঙ্কাজনক। পুলিশ মূল ফটক না খোলায় ভিড়ের চাপ আছড়ে পড়েছিল এক নম্বর গেটে। অন্ধকারে অনেকে মাটিতে পড়ে যান। দর্শকরা গেট ভেঙে না ফেললে একত্রিশ বছর আগেকার ইডেনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই পারত।
তিনটি লজ্জার ঘনঘটায় শুধু বাংলা নয়, কলকাতার মুখ পুড়ল দেশ-বিদেশেও। কারণ ম্যাচটি দেখতে স্টেডিয়ামে ভাষ্যকার হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দুই নামী প্রাক্তন ফুটবলার-সহ বহু বিদেশি। এ ছাড়াও ম্যাচটি একটি আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে বহু দেশে দেখানো হয়েছে। |
মাস আড়াই আগে মেসি-ম্যাচে আর্জেন্তিনা দলের সাংবাদিক সম্মেলন শুরু হওয়ার মুখে অন্ধকার নেমে এসেছিল যুবভারতীতে। আর এ দিন ম্যাচ শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে বন্ধ হয়ে গেল স্টেডিয়ামের বেশির ভাগ আলো। খেলা বন্ধ ছিল আঠারো মিনিট।
কেন বিদ্যুৎ বিভ্রাট, তা নিয়ে ম্যাচের পর তীব্র বিতর্ক। ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র ও মোহনবাগান কর্তাদের মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়েছে। ক্রীড়ামন্ত্রীর মন্তব্য, “বিদ্যুৎ পর্ষদ থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়াতেই বিপত্তি। এটা ক্রীড়া দফতরের দোষ নয়।” মোহনবাগান সচিব অঞ্জন মিত্র ক্রীড়ামন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারেনি। তিনি ‘সাবোতাজ’ বলেছেন। দু’জনেই তদন্ত চাইছেন পুরো ঘটনাটির। ভারত-জাপান ম্যাচ, এএফসি কাপের ম্যাচ এবং আই লিগ ম্যাচ সরকার পরিবর্তন হলেও যুবভারতীর আলোর ব্যবস্থা যে সেই তিমিরেই, সেটা বারবার প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে।
কিছু লোক ষড়যন্ত্র করে স্টেডিয়ামের আলো নিভিয়ে দিয়ে সমস্যায় ফেলতে পারে, এই আশঙ্কা নিয়ে আগেই রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী ও ক্রীড়ামন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিল মোহনবাগান। সেটা সত্যি হয়ে যাওয়ার পর তদন্ত চেয়ে আবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ ওই দুই মন্ত্রীর দ্বারস্থ হচ্ছেন মোহন কর্তারা। কিন্তু বারবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে কলকাতার মুখ পুড়লেও কেন যুবভরতীতে স্থায়ী জেনারেটরের ব্যবস্থা হচ্ছে না, জানতে চাওয়া হলে ক্রীড়ামন্ত্রী বলে দিলেন, “সেটা করতে গেলে চার কোটি টাকা দরকার। এই টাকা এখন আমাদের হাতে নেই।”
কলকাতার লজ্জা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বিতর্কিত রেফারিং। লাখেরও বেশি মানুষ খেলা দেখতে এসেছিলেন মাঠে। প্রত্যাশার ফানুস উড়িয়ে। কিন্তু তাকে একটা বাঁশিতেই চুপসে দিলেন প্রতাপ সিংহ। ফিফা প্যানেলে থাকা রেফারি যে বাঁশিতে ম্যাচের ফয়সালা করলেন, তা বিতর্কিত। ওপারা বক্সের মধ্যে সুনীল ছেত্রীকে ট্যাকল করেছিলেন। কিন্তু ট্যাকলের সময় সুনীলের পায়ে, না বলের উপর, কোথায় লেগেছিল ওপারার পা, তা নিয়েই বিতর্ক। ঘটনার সময় রেফারি ছিলেন কিছুটা দূরে। ম্যাচের পরে ক্ষোভে ফুটছেন পেন-ওপারারা। ইস্টবেঙ্গল কোচ এবং কর্তারাও। রেফারির বিরুদ্ধে তাঁরা চোখা মন্তব্যও ছুড়ে দিয়েছেন ‘চুরি করেছেন’, ‘ডাকাতি করেছেন’ বলে। ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার বললেন, “যত দূর যেতে হয় যাব। ছাড়ব না। অনেক বার মার খেয়েছি রেফারির হাতে, আর সহ্য করব না। ম্যাচের সিডি দিয়ে আমরা চিঠি পাঠাচ্ছি ফেডারেশনে।”
রবিবারের ডার্বি ছিল ধুন্ধুমার যুদ্ধ। লোডশেডিংয়ের পরেও তা থামেনি। বরং ঝামেলা আরও বেড়ে যায়। খেলা বন্ধ হয়ে গেলে মোহনবাগানের পয়েন্ট কাটা যেত। কারণ, তারা ম্যাচ সংগঠক। সে জন্যই লোডশেডিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠে ছুটে যান মোহনবাগান সচিব। ম্যাচ কমিশনার গোয়ার অ্যান্টনি ডি’কস্টাকে তিনি বলেন, “আলো এখনই আবার চলে আসছে। ম্যাচ বন্ধ করবেন না।” পাল্টা ছুটে আসেন ইস্টবেঙ্গল ম্যানেজার স্বপন বল-সহ অন্য লাল-হলুদ কর্তারাও। তাঁরা জানতে চান, আলো আসার জন্য কত ক্ষণ অপেক্ষা করা হবে। দর্শকদের নিরাপত্তার কথা ভেবে মাঠের একটি অংশের আলো খেলার শুরু থেকেই জেনারেটরের সাহায্যে জ্বালানো ছিল। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময়েও তা নেভেনি। তার ভিতরেই দুই প্রধানের কর্তাদের মধ্যে ঝামেলা চলতে থাকে। রীতিমতো একশো মিটার স্প্রিন্ট টেনে এক মোহন-কর্তা নিয়ে আসেন আই লিগের আইনের বই। সেখানে দেখা যায় তিরিশ মিনিট করে দু’দফায় মোট এক ঘণ্টা অপেক্ষা করা যেতে পারে ম্যাচ শুরুর জন্য। পরে ম্যাচ কমিশনার ডি’কস্টা বলেন, “আঠারো মিনিটের মধ্যে আলো চলে এসেছে। তিরিশ মিনিট পর্যন্ত দেখতে চেয়েছিলাম। ইস্টবেঙ্গল চাপ দিচ্ছিল সময়টা দেখার জন্য।” রেফারিং ও মোহনবাগানের পেনাল্টি নিয়ে তিনি রেফারির পাশেই দাঁড়িয়েছেন।
বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ক্ষুব্ধ ট্রেভর মর্গ্যান। এর আগেও বিদেশে তাঁর দলের খেলায় আলো নিভে গিয়েছে। তবু ইস্টবেঙ্গল কোচ বলছিলেন, “ওই সময় ম্যাচটা আমরা প্রায় পকেটে পুরে নিয়েছিলাম। আলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছেলেরা ‘কুল’ হয়ে গেল। সেটা পরে আর তোলা যায়নি।” অন্ধকারের সময় সুব্রত ভট্টাচার্যও আশঙ্কায় ছিলেন। মোহনবাগান টিডি বললেন, “আমার ছেলেরাও তো ‘কুল’ হয়ে গিয়েছিল। ভয় ছিল, ছন্দটা না হারিয়ে যায়। হেরে গেলে অনেকে অনেক দোষ দেয়। বিদেশেও এ রকম হয়। তবে এ রকম না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।”
|
এই নিয়ে আট বার |
৮ সেপ্টেম্বর ২০০৪
ভারত-জাপান
প্রাক বিশ্বকাপ
ম্যাচ। ৩০ মিনিট। |
৩ এপ্রিল ২০১১
চিরাগ ইউনাইটেড-ডেম্পো
আই লিগ। খেলা শুরু হয় ১৫ মিনিট দেরিতে। |
১ নভেম্বর ২০০৮
চিরাগ ইউনাইটেড-স্পোর্টিং ক্লুব
দ্য গোয়া
আই লিগ। ২৭ মিনিট। |
১৫ মে ২০১১
ইস্টবেঙ্গল-ডেম্পো, আই লিগ।
শুরু হয় ১৫ মিনিট দেরিতে। |
২৮ অগস্ট ২০০৮
মহমেডান স্পোর্টিং-জর্জ
টেলিগ্রাফ
স্থানীয় লিগ। ১৯ মিনিট। |
২ সেপ্টেম্বর ২০১১
আর্জেন্তিনা-ভেনেজুয়েলা
আন্তর্জাতিক ফ্রেন্ডলি। সাংবাদিক
সম্মেলনের সময় আলো নিভে যায়। |
১৭ নভেম্বর ২০১০
বায়ার্ন মিউনিখ অলস্টার-ইস্টবেঙ্গল অলস্টার
প্রদর্শনী ম্যাচ। ম্যাচ
শেষে আলো নিভে যায়। |
২০ নভেম্বর ২০১১
মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল
আই লিগ। ২০ মিনিট। |
|
বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং রেফারিং বাদ দিলে অবশ্য এ দিনের ম্যাচ সব অর্থেই ছাপিয়ে গিয়েছে সাম্প্রতিক কালের সব ডার্বিকে। আবেগে, উত্তেজনায়, উন্মাদনায় তো বটেই। দর্শক সংখ্যাতেও। ’৯৭-র ফেড কাপের সেই রেকর্ডকে ম্লান না করতে পারলেও তার পরে কোনও ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে যুবভারতীতে এত দর্শক হয়নি। বিকেল চারটে অর্থাৎ ম্যাচ শুরুর আড়াই ঘণ্টা আগে থেকেই গেটে গেটে লাইন পড়েছিল। পুলিশের নির্দেশে ঝামেলা এড়াতে ভিআইপি বক্সের উল্টো দিকের একটি বড় অংশের টিকিট বিক্রি হয়নি। তাতেও পুলিশের হিসাবে মাঠে লোক এসেছিল লাখেরও বেশি।
যা দেখে অবাক ও বিস্মিত দুই প্রধানের স্পনসর বিজয় মাল্যর ছেলে মোহনবাগান চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মাল্য। ক্রিকেট, মোটর রেসিং দেখে অভ্যস্ত সিদ্ধার্থ উত্তেজনার আঁচ পোহাতে ভিভিআইপি বক্সের ঠান্ডা ঘর ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বাইরে। নাগাড়ে মোবাইলে ছবি তুলেছেন দর্শকদের। ইলিশ এবং চিংড়ির। লাল-হলুদ আর সবুজ-মেরুন বেলুনের। প্রিয় দলের রং মেখে সেজেগুজে মাঠে আসা মহিলা দর্শকদের ছবি তুলতেও দেখা গেল তাঁকে। নস্ট্যালজিয়ায় আক্রান্ত সিদ্ধার্থ বলছিলেন, “ছোটবেলায় চিমার খেলা দেখেছি গ্যালারিতে বসে। দেখছি উন্মাদনা একটুও কমেনি। গ্যালারিটা বরং আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। ইডেনে এক সপ্তাহ আগেই দশ হাজার লোকও হয়নি। কিন্তু আমাদের ম্যাচ দেখতে এসেছেন তার দশ গুণেরও বেশি লোক। এত লোক আমি কোনও ক্রিকেট ম্যাচ বা বিশ্বকাপ ফাইনালেও দেখিনি।” সোমবারই মোহন-কর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসছেন তিনি।
আট দিন আগে টিকিট ছেড়েছিল ম্যাচের উদ্যোক্তা মোহনবাগান। তখন থেকেই ঝামেলা শুরু হয়েছিল টিকিট বণ্টন নিয়ে। কিন্তু এই রবিবার দেখা গেল, প্রায় সমান দর্শক এসেছিল দু’পক্ষের। বরং মহার্ঘ্য ভিভিআইপি বক্সের বেশির ভাগটাই দখল করে নিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। ম্যাচ শুরুর প্রায় দেড় ঘণ্টা আগে রবিন সিংহ, টোলগে, অ্যালান গাও-রা নিজেরা এসে পরিবারের লোকজনদের বসিয়ে দিয়ে যান সেখানে। মোহনবাগানের লোকজন এসে টিকিট পরীক্ষা করে তাঁদের বের করে দেওয়ার পর কয়েক জন সামনের লাল-হলুদ গ্যালারিকে তাতানোর চেষ্টা করেন। তাতে ভয় পেয়ে যান মোহনবাগানের কর্মীরা। শেষ পর্যন্ত বৈধ টিকিট না থাকা সত্ত্বেও টোলগে-গাওদের পরিবারকে বসতে দিতে বাধ্য হন তাঁরা।
আই লিগে প্রথম এই ম্যাচ সংগঠন করছে কলকাতার কোনও ক্লাব। মোহনবাগান কেমন আয়োজন করে এ দিনের ম্যাচ, তা নিয়ে আগ্রহ ছিল ফুটবলমহলে। রেফারি, টিকিট বিক্রি, পুলিশ ও বেসরকারি নিরাপত্তাবাহিনী মোতায়েন, সবই করেছিল মোহনবাগান। সবাইকে চমকে দিয়ে বিশ্ব ফুটবলের মতো গ্যালারির দিকে মুখ করে ছিল পুলিশ। আইএফএ ম্যাচ সংগঠন করলে মাঠে যেমন তাদের লোকের ভিড় থাকে, এ দিন তা-ও তেমন চোখে পড়েনি। জাল টিকিট এবং গণ্ডগোল আটকাতে ছ’টি সিসিটিভি বসানো হয়েছিল। তাতে অবশ্য সব কিছু আটকানো যায়নি।
দর্শকের মতো লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন পতাকার সংখ্যাও ছিল প্রায় সমান সমান। সঙ্গে আবির, তুবড়ি ও পটকা তো আছেই। আতসবাজি নিয়ে মাঠে ঢোকার জন্য ম্যাচের আগে বারো জনকে আটক করে পুলিশ। জলের বোতলের মুখ খুলে ফেলে দেওয়া সত্ত্বেও মোহনবাগানের পেনাল্টি থেকে গোলের পর মাঠে প্রচুর জলের বোতল পড়েছে। ভিআইপি বক্স থেকে চেয়ার খুলে ছুড়ে মাঠে পাঠানো হয়েছে। পড়েছে দু’একটা ইটও। ওডাফার গোলের পর সবুজ-মেরুন রংয়ের তুবড়ি পুড়েছে মোহন-গ্যালারিতে। পটকাও। পুলিশ আটকাতে পারেনি। গ্যালারিতে কোথায় ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান বসবে, তা লিখে রাখা হয়েছিল বোর্ডে। তা সত্ত্বেও বহু জায়গাতেই পাশাপাশি বসেছিলেন দুই ক্লাবের কর্তা-সমর্থকরা। সৌভাগ্য, সেখানে বড় কোনও ঝামেলা বাঁধেনি। |