সর্বভারতীয় স্তরে অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষা গ্রহণ করা হইবে বলিয়া স্থির করা হইয়াছে। মনে হইতে পারে, এই প্রস্তাব উত্তম। দেশ যখন একটাই, তখন পরীক্ষা কাঠামোয় সামঞ্জস্য থাকা তো ভাল কথা। ইহা ভুল ধারণা। মূলত ভুল। দেশ এক বলিয়া পরীক্ষাও এক হইতে হইবে, ইহা কোনও যুক্তিই নহে। বরং শিক্ষা এবং পরীক্ষার ব্যবস্থায় যত বেশি বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে, শিক্ষার ততই মঙ্গল। কিন্তু সেই প্রসঙ্গ এই স্তম্ভে বহু-আলোচিত। তাহা থাকুক। অন্য একটি সমস্যায় দৃষ্টিপাত করা যাক। সমস্যাটি প্রশ্নপত্রের ভাষা লইয়া। এখনও অবধি স্থির হইয়াছে ইংরেজি আর হিন্দি ভাষায় প্রশ্নপত্র করা হইবে। বিভিন্ন প্রদেশের আপত্তি, কেন তাহাদের প্রদেশের ভাষায় প্রশ্ন করা হইবে না! আপত্তি বঙ্গদেশীয়রাও করিয়াছেন। বাংলা ভাষায় প্রশ্ন না হইলে সরকার পক্ষ আইনের দ্বারস্থ হইবেন বলিয়া জানাইয়াছেন। এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তি জানাইয়াছেন, মাতৃভাষায় প্রশ্ন না করিলে গ্রামান্তের মেধাবী পড়ুয়ারা চিকিৎসক হইতে পারিবেন না, গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থা সংকটের মুখে পড়িবে। মাতৃভাষার দাবি ও গ্রামের মেধাবী পড়ুয়াদের প্রবেশাধিকারের দাবি সংগত বলিয়া মনে হইলেও দেখা যাইবে, ইহার মধ্যে যুক্তির বিস্তর ফাঁক রহিয়াছে।
ডাক্তারি পড়া বা ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্ন মাতৃভাষায় করা ইত্যাদি দাবি নূতন কিছু নহে। যে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থা এক্ষণে জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছে ও যে বিদ্যা অর্জনের জন্য সর্বভারতীয় স্তরে পড়ুয়ারা পরীক্ষা দিবার জন্য আগ্রহী, সেই ব্যবস্থা উনিশ শতকে ইংরেজ আমলে গড়িয়া উঠিয়াছিল। সেই সময়ে ডাক্তারিবিদ্যা শিক্ষার জন্য বাংলা শ্রেণির ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। এই শ্রেণির ছাত্ররা ‘নেটিভ’ ছাত্ররা বাংলায় চিকিৎসাবিদ্যা পড়িতে পারিতেন। প্রথমে এই ব্যবস্থা জনপ্রিয় হইলেও কিছু দিনের মধ্যেই সেই উদ্যোগে ভাটা পড়িয়াছিল। কারণ, বইয়ের অভাব। বিজ্ঞান ইংরাজিতেই পড়া সহজ, সুতরাং মাতৃভাষার কাঠামো মজবুত না করিয়া মাতৃভাষার পক্ষে গলা ফাটানো অর্থহীন। দ্বিতীয়ত, দাবি তোলা হইয়াছে, গ্রামের মেধাবী ছাত্ররা মাতৃভাষার প্রশ্ন না পাইলে বঞ্চিত হইবেন। যাঁহারা মেধাবী তাঁহারা ইংরাজিতে প্রশ্ন পড়িয়া মানে বুঝিতে পারিবেন না কেন? শহরের মেধাবীরা পারিবেন, গ্রামের মেধাবীরা পারিবেন না, ইহা কেমন কথা? আর, ইংরাজি জানা ডাক্তারেরা শহরে থাকিবেন আর বাংলা জানা ডাক্তারেরা বাংলায় প্রশ্নের জবাব দিয়া পড়া শেষ করিয়া গ্রামে যাইবেন, এই ‘শ্রমবিভাজন’ই বা কেমন বুদ্ধি? যেন বিচিত্র এক বিভাজনকে স্বীকার করা ও প্রতিষ্ঠা দেওয়া হইতেছে। ইহা নিতান্ত অপযুক্তি। এই অপযুক্তি ভুলিয়া যাহা করিতে হইবে তাহা হইল, ইংরাজি জানিতে হইবে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় স্তরে ইংরাজিই জ্ঞান ও যোগাযোগের উপযুক্ত ভাষা। অপর ভাষা সেই সামর্থ্য এখনও অবধি অর্জন করিতে পারে নাই। পারিলে দেখা যাইবে। মাতৃভাষা-প্রেম ভাল, কিন্তু সেই ভালবাসার নামে যুক্তিকে অস্বীকার করা চলে না। গ্রামের জন্য মাতৃভাষা, শহরের জন্য ইংরাজি এই যুক্তি অর্থহীন। ক্ষতিকরও। |