মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী দেশের সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশকে চারটি ছোট ছোট রাজ্যে ভাগ করার প্রস্তাব দিয়াছেন। এই মর্মে রাজ্য বিধানসভার আসন্ন অধিবেশনে আনুষ্ঠানিক বিলও আসিতেছে। উদ্যোগটি নির্বাচনী। আগামী নির্বাচন তাঁহার পক্ষে বিশেষ আশাপ্রদ হইবে না, এমন শঙ্কা হইতেই এই ভাগাভাগির প্রস্তাব। ইহার মধ্যে কেবল জাঠ নেতা অজিত সিংহ প্রস্তাবের সমর্থন করিয়াছেন। তিনি দীর্ঘ কাল জাঠ-অধ্যুষিত পশ্চিম উত্তরপ্রদেশকে ‘হরিৎ প্রদেশ’ নামে আলাদা করার দাবি তুলিয়া আসিতেছেন। লক্ষ্য: উত্তরপ্রদেশের বৃহত্তর পরিসরে কল্কে না পাইয়া জাঠ বলয়ের সংকীর্ণ পরিসরে শাসকের গদিতে আসীন হওয়া। রাজ্য-রাজনীতির অন্য সব কুশীলবই এই বিভাজনের ঘোরতর বিরোধিতায় অবতীর্ণ। অবশ্য সেই বিরোধিতাও হয়তো তত নীতিগত নয়, যত নিজ-নিজ গোষ্ঠীর সংকীর্ণ স্বার্থ-তাড়িত।
উত্তরাখণ্ড বাহির হইয়া যাওয়ার পরও উত্তরপ্রদেশ একটি বৃহৎ রাজ্য, সন্দেহ নাই। কিন্তু ইহাকে আরও চারটি রাজ্যে ভাগ করিলে কী সুবিধা হইবে? মায়াবতী প্রশাসনিক সুবিধার কথা বলিয়াছেন। কিন্তু প্রতিটি রাজ্যের জন্য আলাদা বিধানসভা, মন্ত্রিসভা, রাজ্যপাল, আমলাতন্ত্র, অসংখ্য নূতন নিগম ও সেগুলির অগণিত আধিকারিক পরিবর্তনটি বিপুল ব্যয়সাধ্য। আর, জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা, অনগ্রসরতা-জনিত ক্ষোভের প্রতিকারের সুযোগ, গোষ্ঠীগত আবেগ এগুলি রাজ্য পুনর্গঠনের সুযুক্তি হইতে পারে না। বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ ভাঙিয়া গড়া ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ় ও উত্তরাখণ্ডের বিগত এক দশকের খতিয়ান লইলেই স্পষ্ট, ওই সব নবগঠিত রাজ্যের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা যেমন দূর হয় নাই, তেমনই জনজাতীয় ওই রাজ্যগুলিতে তথাকথিত মূল ধারার ‘বহিরাগত’দের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যও হ্রাস পায় নাই, কেবল খিড়কির দরজা দিয়া তাহা চালানো হইতেছে। বুন্দেলখণ্ডকে আলাদা রাজ্য করিলেই খরাকবলিত, দারিদ্রপীড়িত ওই অঞ্চলে উন্নয়নের প্লাবন প্রবাহিত হইবে, এমন নয়। রাজ্য পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে ভাষাকে অগ্রাধিকার দিবার যে মানদণ্ড স্থির হইয়াছিল, এখনও পর্যন্ত তাহার অসারতা প্রতিপন্ন হয় নাই। তথাপি যদি অন্য, নূতনতর কোনও মানদণ্ড সংযোজন করিতে হয়, তবে আবার একটি কমিশন গড়া যাইতে পারে, যাহার বিচার্য বিষয়ের মধ্যে জাতিসত্তার আবেগ, অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা ইত্যাদিও অন্তর্ভুক্ত হইবে।
যত দিন তাহা না হইতেছে, তত দিন স্বতন্ত্র রাজ্য গড়ার দাবি তুলিয়া ধরা একটি আত্মঘাতী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, তেলেঙ্গানায় যাহার মূল্য সকলকে চুকাইতে হইতেছে। আন্দোলনের নামে সেখানে যে-পরিমাণ সরকারি সম্পদ ধ্বংস করা হইতেছে, তাহা কিন্তু তেলেঙ্গানারই সম্পদ, এবং সমগ্র দেশেরও। জনগোষ্ঠীর আবেগ কীভাবে রাজনীতিকরা উস্কাইয়া থাকেন এবং হিংসাত্মক আন্দোলনে তাহাকে বিভেদপন্থী, এমনকী সাম্প্রদায়িক করিয়া তুলিতে পারেন, সাম্প্রতিক ইতিহাসে তাহার অসংখ্য নজির। জনগোষ্ঠীর আবেগ শিরোধার্য করিতে হইলে পশ্চিমবঙ্গ হইতে গোর্খাল্যান্ড, কামতাপুর, বৃহত্তর কোচবিহার, মহারাষ্ট্র হইতে বিদর্ভ, মরাঠাওয়াড়া, কর্নাটক হইতে কুর্গ, অসম হইতে বড়োল্যান্ড, মেঘালয় হইতে খাসি, গারো ও জয়ন্তিয়াদের আলাদা-আলাদা রাজ্য মঞ্জুর করিতে হয়। তাহার পর দেশের প্রতিটি জেলার অধিবাসীরাই জেলাভিত্তিক আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক সংহতির দোহাই পাড়িয়া আত্মশাসন দাবি করিতে থাকিবে। মায়াবতী-প্রস্তাবিত পূর্বাঞ্চল বা অবধ-প্রদেশের কোনও দাবি কিন্তু ওই সব অঞ্চলের অধিবাসীরা কখনও তোলেন নাই, তবে এ বার বহুজনসমাজ পার্টির প্ররোচনায় তুলিতেও পারেন, বিশেষত যদি মায়াবতী জনাদেশে পরাস্ত হইয়া বিরোধী নেত্রীতে পরিণত হন। রাজনীতির এই খেলা আগুন লইয়া খেলা, যাহা সকলকেই পুড়াইয়া মারিতে পারে। |