স্টেডিয়ামের ভিতরেই লোক হয়েছিল ১৫ হাজারের বেশি। বাইরেও ছিলেন অগুন্তি কর্মী-সমর্থক। তবু নেতাজি ইন্ডোরে রবিবার পরিচিত ‘কংগ্রেস-সুলভ’ বিশৃঙ্খলা দেখা গেল না! ‘অভিভূত’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেই ফেললেন, “আপনারা যে এত সুশৃঙ্খলভাবে সম্মেলনে অংশগ্রহণ করলেন, তাতে মানুষের কাছে একটা বার্তা যাবে। মানুষ বুঝবে যে, কংগ্রেস সুশৃঙ্খল একটা দল। আপনাদের ধন্যবাদ।”
সাধারণত ক্যাডার-ভিত্তিক বামপন্থী দলগুলোর সম্মেলন যে শৃঙ্খলা দেখা যায়, অ-বামপন্থী দলগুলোয় তা দেখা যায় না। দলীয় নেতৃত্ব যদিও সেই উচ্ছৃঙ্খলতাকে ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’ বলেই ব্যাখ্যা করে থাকেন। তবে গত বেশ কয়েকবছর ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর তৃণমূল কংগ্রেসের শৃঙ্খলা আনতে পেরেছেন। তৃণমূলের সমাবেশ এখন অনেক সুশৃঙ্খল। রবিবার রাজ্য-রাজনীতি দেখল, তৃণমূলের জোটসঙ্গী কংগ্রেসও এদিন সেই রাস্তায় হাঁটতে সক্ষম হয়েছে। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে কংগ্রেসের এক দিনের পঞ্চায়েতি-রাজ সম্মেলন আগাগোড়া সুষ্ঠু ভাবে শেষ হল।
সকাল সাড়ে ১০টায় সম্মেলন শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই স্টেডিয়ামের গ্যালারি প্রায় ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। মঞ্চের সামনের চত্বরও কানায় কানায় ভর্তি হয়ে গিয়েছিল রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা কর্মী-সমর্থকে। স্টেডিয়ামের বাইরেও ভিড় জমিয়েছিলেন দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা। বস্তুত, সাম্প্রতিক কালে রাজ্য কংগ্রেসের এত বিশাল সমাবেশ হয়নি। ২০০৮ সালের ৯ অগস্ট শেষবার নেতাজি ইন্ডোরে সম্মেলন করেছিল রাজ্য কংগ্রেস। বক্তৃতা করেছিলেন তৎকালীন প্রদেশ সভাপতি প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। তারপর গত কয়েকবছরে রাজ্য কংগ্রেসের তরফে যে সম্মেলনই হোক না কেন, তা হয়েছে গোষ্ঠী-বিভাজনের ছায়ায় এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এদিন সেই বেড়া ভেঙে কংগ্রেসের বিভিন্ন গোষ্ঠীর নেতারা একই মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিলেন। যেখানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সম্ভবত দলের দুই সাংসদ দীপা দাশমুন্সি এবং মৌসম বেনজির নূরের সহাবস্থান। ওই দুই মহিলা সাংসদ অবশ্য সম্প্রতি রায়গঞ্জে এইম্স এবং কংগ্রেসের কর্মীদের উপর তৃণমূলের ‘হামলা’ নিয়ে পরস্পরের কাছাকাছি এসেছেন। অথচ কয়েক মাস আগে যুব কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দু’জনের অনুগামীরা নজরুল মঞ্চে বচসা-ধস্তাধস্তি এমনকী, চেয়ার ছোড়াছুড়িতেও জড়িয়ে পড়েছিলেন!
মঞ্চে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তথা বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়কে দেখে সম্মেলনে আগত কর্মী-সমর্থকরা হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানান। গোটা স্টেডিয়াম আরও একবার হাততালিতে মুখর হয় বহরমপুরের সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরীকে দেখে। বিভিন্ন বক্তার বক্তৃতার সময় স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাস তো ছিলই। কিন্তু তা মাত্রাছাড়া হয়নি। বিকেল সাড়ে তিনটে পর্যন্ত চলতে-থাকা সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকেই মঞ্চের পিছন দিকে চলেছে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যাহ্নভোজ। এক-একটা দলে কর্মীরা খাওয়া সেরে আবার নিজের নিজের জায়গায় ফিরে এসে বক্তৃতা শুনেছেন। শুনেছেন, আগামী পঞ্চায়েত ভোটে কী ভাবে নিজেদের সংগঠিত করতে হবে। শুনেছেন কোনও রকম ‘বিতর্ক’ বা প্ররোচনায় মাথা না ঘামিয়ে কী ভাবে কংগ্রেসের পায়ের তলার জমি ‘শক্ত’ করতে হবে।
তেরঙা জাতীয় পতাকার রঙে সাজানো স্টেডিয়ামের ভিতর শেষপর্যন্ত ঢুকতে পেরেছিলেন সাকুল্যে ১৬ হাজারের মতো দর্শক। যাঁরা স্থানাভাবে ভিতরে ঢুকতে পারেননি, তাঁরা বিকেল পর্যন্ত ঠায় স্টেডিয়ামের বাইরে টাঙানো জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখলেন সম্মেলন। শুনলেন নেতৃত্বের নির্দেশ-পরামর্শ। কিন্তু তাঁদের মধ্যেও কোনও রকম ‘বিশৃঙ্খলা’ ছিল না। স্টেডিয়ামের পিছন দিকে যে সারা দিন ধরে নাগাড়ে খাওয়া-দাওয়ার পাট চলেছে, তা ভিতরে বসে ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি। সময়াভাবে এক মহিলা নেত্রী বক্তৃতা দিতে না-পেরে খানিকটা উসখুস করছিলেন বটে। কিন্তু প্রদেশ সভাপতি মাইক ধরে সকলকে বলতে না-দিতে পারার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে নেন।
তাঁর সভাপতিত্বের সময় কংগ্রেসের এই প্রথম সম্মেলনে কর্মীরা ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ’ থাকায় স্বভাবতই খুশি প্রদীপবাবু। দিনের শেষে যিনি বলেছেন, “দলকে মজবুত করা, পঞ্চায়েতের জন্য প্রস্তুতি এসব তো রাজনৈতিক দিক। প্রণব’দা দিগ্নির্দেশ দিয়েছেন। কর্মীরাও উদ্বুদ্ধ হয়ে ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু রাজ্য নেতৃত্বের কাছে এর বাইরেও ইতিবাচক দিক হল কর্মীদের শৃঙ্খলাপরায়ণতা। এই ধারা চালু থাকলে রাজ্যে কংগ্রেস অনেকদূর এগোবে বলেই আমার আশা।” |