‘ডাক্তারবাবু’ নেই, ভাবতেই পারছে না মুরারই
খন দুপুর দেড়টা। খবর এল তাঁদের প্রিয় ‘ডাক্তারবাবু’ আর নেই। কয়েক মুহূর্তের জন্য কথাটা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না মুরারইবাসী। তবে ডাক্তারবাবু মোতাহার হোসেনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তে শোকের ছায়া নেমে আসে মুরারই বিধানসভা এলাকা জুড়ে।
জেলার মানুষের কাছে ডাক্তারবাবু হিসেবে পরিচিত মোতাহার হোসেন রবিবার দুপুর সওয়া ১টা নাগাদ কলকাতায় ঢাকুরিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। পেশায় চিকিৎসক মোতাহার ২০০৬ সাল অবধি ভোটে লড়েছেন।
সদ্য প্রয়াত এই কংগ্রেস নেতা ১৯৩০ সালে ২৯ অগস্ট মুরারই থানার ভীমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি রামপুরহাটের ১০ নম্বর ওয়ার্ডে থাকতেন। কলকাতা থেকে রাতে তাঁর দেহ এনে সেখানেই রাখা হবে।
দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পরে এ দিন দুপুরে মারা যান পাঁচ বারের বিধায়ক মোতাহার হোসেন। মৃত্যুর সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। বীরভূম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি অসিত মাল বলেন, “ডাক্তারবাবুর মৃত্যুতে রাজ্য তথা জেলা কংগ্রেসের অপূরণীয় ক্ষতি হল।”
তাঁর রাজনৈতিক ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৪৭ সালে স্কুল ফাইনাল পাশ করে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে এল এম এফ পড়েন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা থেকে এম বি বি এস পাশ করেন। দীর্ঘদিন তিনি রামপুরহাট শহরে একটি নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬২ সালে প্রথম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন এই কংগ্রেস নেতা। ওই বছর মুরারই থানার আমডোল পঞ্চায়েতের প্রধান হন। এবং তৎকালীন আঞ্চলিক জেলা পরিষদের সদস্যও হয়েছিলেন। তাঁর বাবা প্রয়াত কুরবান হোসেন ছিলেন এলাকার দোর্দন্ড প্রতাপ জমিদার ও কংগ্রেস নেতা। ১৯৬৭ সালে প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ডাক্তারবাবু। তিনি এসইউসি প্রার্থী বজলে আহমেদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে হেরে যান। ১৯৬৯ সালে ফের ভোটে দাঁড়িয়ে বজলে আহমেদের কাছে হেরে যান। ১৯৭২ সালে মুরারই কেন্দ্র থেকে প্রথম জেতেন মোতাহার হোসেন। ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি বিধায়ক ছিলেন। ’৭২ সালের পর তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৭৪ সালে তিনি মন্ত্রী হন। বর্তমানে তিনি রাজ্য সংখ্যালঘু কমিশনের সদস্য ছিলেন। এমন কী তিনি প্রদেশ কংগ্রেসের সম্পাদক ছিলেন।
নুরে আলমের সঙ্গে বিধানসভা ভোটের প্রচারে মোতাহার হোসেন (চালকের পাশে)। ফাইল চিত্র।
মুরারইয়ে কংগ্রেসের ‘জন্মদাতা’ হিসেবে পরিচিত মোতাহার হোসেন ’৭৪ সালে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্বে স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী হন। ওই সময় তিনি অর্থ দফতরের অতিরিক্ত দায়িত্ব সামলেছেন। শেষ বারের মতো তাঁকে দেখা গিয়েছিল গত বিধানসভা নির্বাচনে মুরারই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী নুরে আলম চৌধুরীর হয়ে রোড-শো করতে। সেই সময় তাঁকে দেখতে প্রচুর মানুষ ভিড় করেছিলেন।
এলাকার প্রিয় ডাক্তারবাবু হয়ে ওঠার পিছনে তাঁর নানা কর্মকাণ্ডের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৭৩ সালে বাঁশলৈ নদীর উপরে কল্যাণ সেতু নির্মাণ মোতাহার হোসেনের তত্বাবধানে হয়। তাঁরই জন্য রাজগ্রাম এলাকার পাথর শিল্প ফুলে ফেঁপে উঠেছে। শুধু তাই নয়, তাঁরই উদ্যোগে এলাকার কবি নজরুল কলেজ, মুরারইয়ের গ্রামে গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থা, মুরারই গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে পাইকর, ভীমপুর, রাজগ্রাম, চাতরা, পঞ্চহোড়-সহ মুরারই বিধানসভাকেন্দ্রের বেশিরভাগ স্বাস্থ্যকেন্দ্র তাঁরই উদ্যোগে নির্মাণ হয়। তাঁর সময়ে রামপুরহাট মহকুমার মধ্যে মুরারইয়ে প্রথম পাইপের মাধ্যমে পানীয় জল পৌঁছয়। অনেক সময়ে সদ্য প্রয়াত এই কংগ্রেস নেতাকে দেখা গিয়েছে বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ মানুষ জনকে শান্ত করতে। ১৯৯১ সালে মুরারই এলাকায় ডাকাতির প্রতিবাদে স্থানীয় মানুষ যখন থানা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন তখন মোতাহার হোসেন এলাকায় পৌঁছে মানুষ জনকে শান্ত করার পাশাপাশি প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন।
এলাকার বাসিন্দা তথা স্থানীয় কংগ্রেস নেতা আসরাফ হোসেন, প্রদীপ ভকত, নুরুল ইসলাম, আব্দুর রহমান, সুজয় দাস, অষ্টম রবিদাস, আসিফ ইকবাল, আফতাবউদ্দিন মল্লিকদের কথায়, “ডাক্তারবাবু নেই মানে মুরারইয়ের মানুষ এক আপনজনকে হারালেন। তাঁর মতো নেতৃত্বের কাছে আমরা চিরঋণী।” তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মোতাহার হোসেন ছিলেন দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।” এই প্রবীণ নেতার কাছে দলের নেতা-কর্মী, সমর্থক যেমন এক তেমনি সাধারণ মানুষ ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাও সমান ছিলেন। তাঁর সঙ্গে সব স্তরের মানুষই বসে আড্ডাও দিতেন।
সিপিএমের মুরারই জোনাল সম্পাদক বরকত উল্লাহ বলেন, “উনি বিরোধী রাজনীতি করলেও রাজনীতি ছাড়া তাঁর সঙ্গে আমাদের ভাল সম্পর্ক ছিল। তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাই।”
রবিবার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য, রাজ্যের সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া, মৎস্যমন্ত্রী আবু হেনা প্রমুখ এই প্রবীণ নেতার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ দিন নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে প্রদেশ কংগ্রেসের পঞ্চায়েতি রাজ সম্মেলন ছিল। মোতাহারের মৃত্যুতে সেখানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। ওই সম্মেলনেও প্রদীপবাবু, মানসবাবু শোকপ্রকাশ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। সন্ধ্যায় মোতাহারের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় প্রদেশ কংগ্রেস দফতর বিধান ভবনে। সেখানে মোতাহারের মরদেহ দলীয় পতাকায় ঢেকে দেওয়া হয়। বিধায়ক অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়, আবু তাহের খান, মইনুল হক, প্রদেশ কংগ্রেসের সহ-সভাপতি দেবব্রত বসু প্রমুখ সেখানে মোতাহারকে শ্রদ্ধা জানান। প্রণিসম্পদ বিকাশ দফতরের মন্ত্রী নুরে আলম চৌধিুরী বলেন, “রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও তাঁর বাবার আমল থেকে আমাদের পরিবারের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক আছে। উনি শেষ বয়সে নির্বাচনে আমার সঙ্গে যে ভাবে থেকেছেন তা ভোলা যায় না। তাঁর মৃত্যুতে আমি অভিভাবক হারালাম।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.