আপনার কলমে


‘বগা’র ‘ফান্দে’ ধরা দিতে
মেহেদী হাসান
(বাংলাদেশ)
বেশ কিছু দিন ধরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা ভাবছি। যাদের সঙ্গে রোজ আড্ডা দিই, তাদের অনেকের মাথাতেও এই বেড়ানোর বিষয়টা ঘুরছিল। কিন্তু মতানৈক্য থাকায় কোথায় যাব তা ঠিক করা যাচ্ছিল না! অবশেষে বগাকেইন লেক যাওয়ার বিষয়ে একমত হওয়া গেল। তবে সবাই নয়, কাটছাঁট করে সাত জন যেতে রাজি হয়েছে এই হ্রদ-ভ্রমণে। বেড়াতে যাওয়ার জন্য সংখ্যাটা নেহাত মন্দ নয়!

জানুয়ারির এক শীতের সন্ধ্যায় ‘পরিবহন’-এর বাসে উঠেছিলাম আমরা। উদ্দেশ্য বান্দারবান। ঢাকা থেকে প্রায় আট ঘণ্টার সফর শেষে, পর দিন সকালে পৌঁছেছিলাম বাংলাদেশের পর্বত নগরীতে। জলখাবার খেয়েই বেরোতে হল ‘চান্দের গাড়ি’র খোঁজে। স্থানীয় এই গাড়িগুলি দেখতে অনেকটা ট্রেকার বা জিপের মতো, তবে হুড খোলা, কখনও আবার হুডের জায়গায় খাঁচার মতো করা। এই ‘চান্দের গাড়ি’তে বসে ও দাঁড়িয়ে ২৫-৩০ জন একসঙ্গে সফর করে। সে তুলনায় সংখ্যায় আমরা নিতান্তই কম। তাই যে যার পছন্দের সিট বেছে নিয়ে বেশ আরাম করেই বসে পড়লাম। দর কষাকষি করে ‘রুমা ঘাট’ পর্যন্ত চোদ্দশো টাকা ভাড়াটা যদিও খুব একটা কম নয়। আমাদের মূল অভিযানের শুরু এখান থেকেই। বগাকেইন হ্রদে থাকার জায়গা নেই, দিনের দিন ঘুরে চলে আসতে হয়। তবে রুমা বাজার এলাকায় বেশ কিছু হোটেল-লজ আছে। খাবার দাবারেরও অভাব নেই।

শান্ত নদী— সাঙ্গু
আমরা চলেছি মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে। সঙ্গে রয়েছে সাঙ্গু নদী। মায়ানমারের আরাকান পর্বত থেকে উত্পত্তি সাঙ্গুর। তার পর অনেকটা পথ পেরিয়ে বান্দারবানের কাছে এসে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। রাস্তার অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। খানিকটা অংশ তো বেশ ভাঙাচোরা। একটা জায়গায় আমাদের গাড়ি আটকেই গেল। শেষে অনেক কষ্টে ঠেলেঠুলে আবার রাস্তায় তোলা হয় তাকে। আসলে পাহাড়ি রাস্তা, তাই মাঝে মাঝেই ধস নামে। কিন্তু ভাঙা-পথের ধকল ভুলিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি। তার অপার সৌন্দর্য বাঁকে বাঁকে যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। বেশ কয়েকবার গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলা ছাড়া আর উপায় ছিল না! প্রকৃতি এত সুন্দর হতে পারে! প্রায় ২০-২৫ কিলোমিটার চলার পর একটি সেনা ছাউনির কাছে এসে গাড়ি থামল। জায়গাটার নাম গ্যারিসন-ওয়াই জংশন। এখান থেকে একটা রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে পার্বত্য অঞ্চল চিম্বুক-নীলগিরির দিকে। ছাউনিতে নাম লিখিয়ে আমরা চললাম বাঁ দিকে রুমা-র পথে।
‘পথিক চলেছি আমি পথের বাঁকে
অজানা সুরে কে যেন আমার ডাকে...’

এই রাস্তাটা আরও খারাপ এবং সংকীর্ণ। তবে গাড়ির চালক বেশ অভিজ্ঞ। কোথাও পথের দু’পাশেই পাহাড়, কোথাও আবার এক পাশে পাহাড় আর অন্য পাশে গভীর খাদ। প্রায় ৩০ কিলোমিটার চলার পর আমরা পৌঁছলাম রুমার ‘আর্মি ক্যাম্প’-এ। সেখানে আরও এক বার নিজেদের নাম নথিভুক্ত করতে হল। গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে গেলাম রুমা ঘাটে নৌকার খোঁজে। এখান থেকে দু’ভাবে রুমা বাজার যাওয়া যায়। হয় নৌকা ভাড়া করে সরাসরি, না হলে জন প্রতি ২ টাকা ভাড়া দিয়ে নদী পার হয়ে খানিক পথ হেঁটে। শরীর বেশ ক্লান্ত, তাই ২৫০ টাকায় নৌকা ভাড়া করা হল। শীতকাল বলে সাঙ্গুর জল খুবই কম। হেঁটেই পার হওয়া যায়। দু’ধারে বিভিন্ন সব্জি আর বাদামের খেত। চাষ করা হয় ঝুম পদ্ধতিতে। এ ছাড়া কিছু জায়গায় ধান ও বিশেষ প্রজাতির তামাকের চাষও হয়।

চান্দের গাড়ি

রুমা পল্লি
রুমা বাজার পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেল। সে দিনই ‘বগা লেক’ যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু গাড়ি পাওয়া গেল না। তিনটের পর লেক দর্শনের জন্য গাড়ি যাওয়ার অনুমতি নেই। অগত্যা বাজার অঞ্চলেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। কিন্তু কোনও হোটেলেই জায়গা পাওয়া গেল না। শেষে সরকারি ‘রেস্ট হাউস’-এর কেয়ারটেকারকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে রাজি করানো হয়।

সন্ধে নামতে এখনও ঢের দেরি। এই সময়টায় কী করা যায়? খানিক দূরের রিজুক ঝর্না দেখে আসলে মন্দ হয় না! ঝর্না দেখতে যেতে হবে জলপথেই। তেরোশো টাকায় দু’টি নৌকা ভাড়া করলাম। ঘণ্টা দুয়েকের পথ। রওনা দিতে বিকেল গড়িয়ে গেল। মাঝ পথে সূর্যাস্তও দেখে ফেললাম। একে শীতকাল, তায় আবার নদীর বুকে সন্ধেবেলা; সঙ্গে তেমন গরম জামা নেই। ভেবেছিলাম রিজুকের ধারায় স্নান করব। কিন্তু কপাল খারাপ! এত দেরি করে পৌঁছলাম! তার মধ্যেই তিন ‘সাহসী’ সেই জলে স্নান করল এবং এক জন জ্বরও বাধিয়ে বসল।

রুমার স্থানীয় মানুষদের সময়জ্ঞান খুবই ‘ভাল’। আসলে তাঁদের দশ মিনিট মানে আমাদের প্রায় ১ ঘণ্টা। আর সেই দশ মিনিটের চক্করে পড়েই যত গণ্ডগোল! তবে একটা আলাদা রকমের অ্যাডভেঞ্চারও হল বটে। রাতের নদী, চার দিক অন্ধকার, শুনশান নীরবতা, গা ছমছমে ব্যাপার। ঠান্ডা লাগছিল বলে সবাই নৌকার ভেতরে বসে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। এমন সময় পথ হারিয়ে ফেললেন মাঝিভাই। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার কিন্তু আকাশে তারার মেলা— এক মহাজাগতিক অনুভূতি। সপ্তর্ষিমণ্ডল, কালপুরুষ সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। রাত প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ রুমা বাজারের ঘাটে পৌঁছলাম। রাতের খাবার খেয়ে আবার গেলাম চান্দের গাড়ি ঠিক করতে। পর দিন বগা লেকে যেতে হবে যে!

রিজুকের পথে...

রিজুক জলপ্রপাত
দ্বিতীয় দিন, সকাল সাড়ে ন’টা। চান্দের গাড়ি সঠিক সময়েই এসে গিয়েছিল। শুরুর দিকে রাস্তা ভাল, কিন্তু পরের দিকে খুবই দুর্গম। রাস্তা বলতে শুধু বালি আর পাথর। তার ওপর পাহাড়ি বাঁক। পথও বেশ খাড়াই। কিন্তু চারপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে এ সবের কিছুই টের পাওয়া য়ায় না। এ সময়টায় পাহাড়ে পাতা ঝরার দিন। আর ক’দিন পরেই নতুন তরু পল্লবে ছেয়ে যাবে পাহাড়ের কোল। শীতের সকালে সোহাগি রোদ পাহাড়ের গায়ে যেন সোনালি আভা ছড়িয়ে দিয়েছে—
‘প্রভাতের নতুন সূর্য অবাক চোখে চায়
আঁকা বাঁকা পথ বেয়ে কে কোথা যায়?’


পাহাড়ের গায়ে ঘুরে ঘুরে এক সময় আমরা হারিয়ে গেলাম মেঘের রাজ্যে। হঠাত্ই মেঘের আস্তরণ সরিয়ে ভেসে উঠল বগাকেইন হ্রদের স্বচ্ছ জল।

বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিকদের মতে বগাকাইন হ্রদ মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বা উল্কাপিণ্ডের পতনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের মতে আবার এটি সৃষ্টির কারণ ভূমিধস। আদিবাসী উপকথা অনুযায়ী, অনেক কাল আগে পাহাড়ের গুহায় বাস করত এক ড্রাগন। স্থানীয় বম ভাষায় ড্রাগনকে বলা হয় ‘বগা’। ড্রাগন দেবতাকে তুষ্ট করতে গবাদি পশু উত্সর্গও করত তারা। এক বার কয়েক জন সেই ড্রাগনটিকে হত্যা করে। আর তার পরই পাহাড়ের চূড়াটি জলমগ্ন হয়ে যায় এবং ভাসিয়ে দেয় আশপাশের গ্রাম। এই উপকথার কোনও বাস্তব ভিত্তি হয়তো নেই। তবুও উপকথার সেই ড্রাগন এবং হ্রদের জ্বালামুখের মতো গঠন মৃত আগ্নেয়গিরির ধারণাটির সঙ্গে মিলে যায়। এক অদ্ভুত কারণে বছরে এক বার (এপ্রিল-মে মাসে) এই হ্রদের জল প্রাকৃতিক ভাবে ঘোলাটে হয়ে যায়। আর তা নিয়েই স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন কৌতূহল।
লেকের সঠিক গভীরতা এখনও জানা যায়নি। পাশের সেনা ছাউনির এক জওয়ান আমাদের জানালেন, তাঁরা ২০০ ফুট লম্বা দড়ি দিয়ে জলের গভীরতা মাপার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দড়ি শেষ হয়ে গেলেও তল পাওয়া যায়নি। শোনা যায় বাংলাদেশের এক প্রসিদ্ধ ডাইভার ১৫০ ফুটের মতো ‘রিডিং’ পেয়েছিলেন। লেকের তলার শ্যাওলা, শালুক আর শাপলার শিকড় জড়ানো থাকায় তিনি আর গভীরে যেতে পারেননি। ডুবুরি ভদ্রলোক জলের তলায় অনেক দৈত্যাকার মাছও দেখেছিলেন বলে জানা যায়।

বেশ কিছু ক্ষণ ছবি তুলে, এ বার আমরা এগোলাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডাং-এর দিকে। লেকে আসার রাস্তা যত না খারাপ, তার থেকেও খারাপ এখনকার পথ— পাহাড়ি বাঁক, ধুলোয় ভরা উঁচু নিচু রাস্তা। কেওক্রাডাং পৌঁছতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। কিছু ক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম লেকের পাড়ে। দুপুরের চড়া রোদে সবাই মিলে মনের আশ মিটিয়ে হ্রদের জলে গা ভাসালাম।

বগাকেইন হ্রদ
এ বার খাওয়ার পালা। লেক অঞ্চলে একটি দোতলা হোটেলে গিয়ে দেখি সেখানে বেশ কিছু লোভনীয় পদ পাওয়া যাচ্ছে— ঢেঁকিছাটা লাল চালের ভাত, আলু ভর্তা, সব্জি, ডাল, মাছের ভাজি, তার সঙ্গে ‘এপেটাইজার’ হিসেবে পাহাড়ি মরিচ ভাজা, ভীষণ ঝাল, কিন্তু খেয়ে চরম মজা! হোটেলের মালিক ‘সিয়াম দিদি’ খুবই সাধারণ পাহাড়ি মহিলা। নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা করে ডিগ্রি পাশও করেছেন। এখন এই হোটেল চালান। বিয়ে করেননি শুধু বাবা-মা-ভাই-বোনদের কথা ভেবে। এমন মানুষও আছে পৃথিবীতে!

লেকের ধারে আগুন জ্বালিয়ে প্রায় সারা রাত আড্ডা, গান ও খেলা চলল। খুবই মজা করেছি! পর দিন ভোর ছ’টায় লেক থেকে ফিরতি পথ ধরলাম। সবাই কেমন মনমরা হয়ে রয়েছে। মাত্র একটি দিনেই ‘বগা’ আমাদের হৃদয়ে যে জায়গা করে নিয়েছে তা কখনই মুছে যাওয়ার নয়!

টুকিটাকি তথ্য
যাতায়াত

• ঢাকা থেকে বাসে বান্দারবান। এর পরে ‘চান্দের গাড়ি’তে রুমা। চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করলে দু’ আড়াই হাজার টাকা পড়বে। রুমাতে এক দিন থাকা যেতে পারে। এখানে হোটেল ও ডাকবাংলো আছে। রুমা থেকে চান্দের গাড়িতে করে বগা লেক।
• গাড়ি রুমা পর্যন্ত সব সময় যায় না। আর্মি গ্যারিসনের পরে সাঙ্গুর তীরে সদরঘাটে নামিয়ে দিতে পারে। এখান থেকে নৌকায় কিংবা পাহাড়ি ট্রেইল ধরে (প্রায় ৪ কিলোমিটার) রুমা পৌঁছনো যায়।


সিয়াম দিদির হোটেল

কেওক্রাডাং রিসর্ট

স্থানীয় বাজার এালাকা

লাইমি হিল রিসর্ট

থাকা ও আনুমানিক খরচ

• রুমা সেনা ছাউনিতে ৩০০ টাকা দিয়ে একজন গাইড-সহ নিজেদের নাম নথিভুক্ত করতে হবে।
• বগা লেক এখন একটি জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। প্রচুর দেশি-বিদেশি পর্যটক আসে। তাই গত কয়েক বছরে থাকা খাওয়ার খরচ বেড়ে গিয়েছে।
১০০-২০০ টাকার মধ্যে রাতে থাকার ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। ইচ্ছে করলে ‘ক্যাম্প ফায়ার’ করা যেতে পারে।
• এ ছাড়া সেনা বাহিনীর একটা কটেজও আছে। এটা মাঝে মাঝে ভাড়া পাওয়া যায়। খরচ রাত প্রতি ২৫ টাকা।

বিনোদন ও অবসর যাপন

• রুমায় থাকলে কাছেই রিজুক ফল্স। এখানে পাহাড়ি তাঁতের গামছা, লুঙ্গি, থামি এবং অন্যান্য জিনিস অকল্পনীয় সস্তা।
• মুংলাই পাড়া নামে চমত্কার একটা বম পল্লি আছে। ‘ফিটনেস লেভেল’ ভাল হলে ঝিরির পথ ধরে ১২-১৫ কিলোমিটার পথ ট্রেকিং করা যায়। ভাগ্য ভাল থাকলে পাইথন, হরিণ, বন্য গয়াল-সহ অন্যান্য বন্য প্রাণীর দেখা মিলবে।
• রক ক্লাইম্বিং করার জন্য কেওক্রাডাং আর মার্টিন্স রক দারুণ জায়গা।

এক কথায়: বগা লেকের রং কোথাও ঘন নীল, কোথাও বা একটু সবুজের ছোঁয়ায় আরও সুন্দর।

পেশায় সাংবাদিক। ছেলেবেলা কেটেছে ঢাকার মতিঝিল কলোনিতে। শান্ত মারিয়াম ক্রিয়েটিভ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ। লেখালেখির পাশাপাশি ছবি তোলাও বেশ পছন্দের।
ছবি: লেখক
লেখকের আরও ভ্রমণকথা
• নদী আর গহীন অরণ্যের মাঝে...

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদলপুরনো সংস্করণ