ইতিহাসের হাতছানিতে কেপ টাউন |
বাসবদত্তা চক্রবর্তী
(মিশিগান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) |
স্কুলের ইতিহাস বইয়ে পড়েছিলাম বার্থোলোমিউ দিয়াজ-এর কথা। ভারতবর্ষের খোঁজে সুদূর ইয়োরোপ থেকে সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন পর্তুগিজ এই নাবিক। কিন্তু ১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকা ভূখণ্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তসীমার এক অন্তরীপে ভয়ঙ্কর ঝড়ের সম্মুখীন হলেন তিনি। ছত্রভঙ্গ হল তাঁর নৌবহর। যাত্রায় পড়ল ইতি। দিয়াজ অন্তরীপটির নাম দিলেন ‘ঝটিকা অন্তরীপ’ বা ‘কেপ অফ স্টর্ম’। পরবর্তী কালে এরই নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘উত্তমাশা অন্তরীপ’ বা ‘কেপ অফ গুড হোপ’। উত্তম আশাটা কী? ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ-সহ প্রাচ্যের অভিমুখে জলপথের দ্বার অবারিত করে দেবে এই অন্তরীপ। সেই আশা সফল হয় ভাস্কো দা গামার হাত ধরে। এই পথে এসে ১৪৯৮ সালে তিনি ভারতের পশ্চিম উপকূলের কালিকট বন্দরে জাহাজ নোঙর করেন। ঐতিহাসিক আর রোমাঞ্চকর এই ঝটিকা অন্তরীপে আমাদের ঝটিকা সফরের সুযোগ এল ২০১১-র ফেব্রুয়ারি মাসে, বেশ আকস্মিক ভাবেই। সায়নের কর্মসূত্রে আমরা তখন সদ্য মার্কিন দেশের বাসিন্দা হয়েছি, মাত্র ৩ মাস। ওকে এক সপ্তাহের জন্য যেতে হবে কেপ টাউন। আমিও জুটে গেলাম। দীর্ঘ ২৮ ঘণ্টার ক্লান্তিকর উড়ান শেষে তুষারাবৃত মিশিগান থেকে পৌঁছে গেলাম রোদ ঝলমলে পাহাড় আর নীল সাগরে ঘেরা, মনোরম উষ্ণতায় ভরা আশ্চর্য রঙিন এক শহরে। কেপ টাউন। সাউথ আফ্রিকায় তখন গরমকাল।
এই ফাঁকে ইমিগ্রেশন চেক-এর অভিজ্ঞতাটা ছোট করে বলে নিই। আমরা যখন ভারতীয় পাসপোর্ট ইমিগ্রেশন অফিসারকে দেখালাম, উনি ছানাবড়া চোখে বললেন, “তোমরা এখন কেন এসেছ আমাদের দেশে?”— আমরা তো হতভম্ভ! তখন তিনি এক গাল হেসে বললেন, “বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরু হওয়ার আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। আয়োজক দেশ তো ইন্ডিয়া। সাউথ আফ্রিকা থেকে লোকজন ইন্ডিয়া যাচ্ছে ক্রিকেট দেখতে, আর তোমরা ইন্ডিয়ান হয়ে কিনা এই সময় সাউথ আফ্রিকা এসেছ!” এর পর বেশ কিছু ক্ষণ ক্রিকেটের ভূত-ভবিষ্যৎ, সম্ভাব্য বিজেতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার পর আমরা ছাড়া পেলাম। কোনও দেশের এন্ট্রি পোর্টে ইমিগ্রেশন অফিসার যে পর্যটকদের সঙ্গে রসিকতাও করতে পারেন, সে অভিজ্ঞতা এই প্রথম। |
|
|
টেবল মাউন্টেন |
কেপ টাউন |
|
কেপ টাউনে আমরা উঠলাম ওয়েস্টিন গ্র্যান্ড হোটেলে। পর দিন ছিল সোমবার। সায়ন কিছুটা তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে এলে, আমরা রওনা দিলাম কেপ টাউনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ‘টেবল মাউন্টেন’-এর উদ্দেশে। এটি আসলে সমুদ্রের বুক চিরে উঠে দাঁড়ানো একটি মালভূমি, যার শীর্ষদেশটি টেবিলের মতোই সমতল। উচ্চতা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ফুট আর ব্যাপ্তি আনুমানিক ৩ কিলোমিটার। টেবল মাউন্টেনের মাথায় যখন মেঘের আস্তরণ জমে তখন তাকে বলা হয় ‘টেবল ক্লথ’! টেবল মাউন্টেন কেবল ওয়ে ধরে আমরা পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের মাথায়। বিকল্প উপায় হাইকিং করা। কিন্তু, সময় আর ক্ষমতা দু’টোরই অভাবে আমরা কেবল ওয়েকেই বেছে নিলাম। পাহাড়ের উপর রয়েছে বিচিত্র গাছপালা আর স্থানীয় ফুলে ভরা এক মনোরম প্রাকৃতিক উদ্যান। এক দিকে নেমে গেছে সিগন্যাল হিল, অন্য দিকে দেখা যায় কেপ টাউন শহর।
দেখতে দেখতে সময় হয়ে গেল সূর্যাস্তের। পাহাড়ের উপর বসে সমুদ্রের বুকে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা সত্যিই অবিস্মরণীয়। এ বার ফেরার পালা। নীচে নামার সময়, সদ্য আঁধার নেমে আসা কেপ টাউন শহরটাকে বড়ই মায়াবী রহস্যময়ী মনে হল।
মঙ্গল থেকে শনি— সপ্তাহের বাকি দিনগুলো সায়নের অফিস থাকায় দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই সন্ধেবেলাগুলো কাটাতাম ‘ওয়াটার ফ্রন্ট’-এ। এটি আসলে শহরের একটি সক্রিয় বন্দর আর সেই সঙ্গে পর্যটকদের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্যও বটে। টেবল মাউন্টেনের প্রেক্ষাপটে এই সামুদ্রিক বন্দরটিতে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় রেস্তোরাঁ ও শপিং মল। রেস্তোরাঁগুলোর মুখ্য আকর্ষণ সি-ফুড। আর মলগুলোয় রয়েছে স্থানীয় হস্তশিল্পের রকমারি সম্ভার— উটপাখির ডিমের খোলায় সূক্ষ্ম কারুকার্য করা ল্যাম্প কিংবা গজদন্তের তৈরি ময়ূরপঙ্খী নৌকা। কোথাও বা ছোট মঞ্চ তৈরি করে একদল আফ্রিকান তরুণ পরিবেশন করে চলেছে স্থানীয় সঙ্গীত বাঁশের ও কাঠের বিচিত্র বাদ্যযন্ত্র সহযোগে। সেই আরণ্যক সুরের মাদকতায় যে কোনও পথচারিই চুম্বকের মতো আকৃষ্ট হয়ে যোগ দিচ্ছে জমায়েতে। ক্ষণিকের জন্য গা ভাসিয়ে দিচ্ছে সুরের ছন্দে, দামামার তালে তালে। |
|
অবশেষে এসে গেল শনিবার— বহু প্রতীক্ষিত ‘কেপ পয়েন্ট’ যাত্রার দিন। সায়ন বুক করল চমৎকার এক ফরাসি গাড়ি। সকালের খাওয়া সেরে সকাল সকাল রওনা দিলাম দু’জনে। চালকের আসনে সায়ন, পাশে আমি ক্যামেরা হাতে। খাড়াই পাহাড়ের গা দিয়ে সর্পিল পথে ছুটে চলেছে আমাদের বাহন। আর সেই পাহাড়ের পাদদেশে সগর্জনে আছড়ে পড়ছে অতলান্তিকের সফেন ঢেউ।
এখানে জানিয়ে রাখি যে কেপ পয়েন্ট কিন্তু আফ্রিকা ভূখন্ডের দক্ষিণতম বিন্দু নয়। সেটির নাম আগুলাস পয়েন্ট। কেপ পেনিনসুলা আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের একটি অন্তরীপ, যার সবচেয়ে দক্ষিণ-পূর্ব বিন্দুটির নাম কেপ পয়েন্ট আর সবচেয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম বিন্দুটি হল ঐতিহাসিক কেপ অফ গুড হোপ। সেই আগুলাস পয়েন্ট আর কেপ পয়েন্টের মাঝের উপসাগরটির নাম ‘ফলস বে’। পঞ্চদশ শতকের ইউরোপীয় নাবিকরা নাকি কেপ পয়েন্টে পৌঁছনোর পর ভ্রান্তিবশত ফলস বে-তে ঢুকে পড়ত ভারত মহাসাগর ভেবে। এ দিকে ফলস বে প্রচণ্ড খরস্রোতা আর বিপজ্জনক পাথরে ভরা এক উপসাগর। এখানে ঢুকেই ছারখার হয়ে যেত জাহাজ। প্রাণ হারাতেন নাবিকেরা।
আমরা দুপুরের আগেই পৌঁছে গেলাম কেপ পয়েন্টে। এর চুড়োয় রয়েছে একটি লাইট হাউস। সেই লাইট হাউসে উঠে যে দৃশ্য দেখলাম, তা যে কোনও হলিউডি চলচ্চিত্রকে অনায়াসে হার মানায়। এক দিকে অতলান্তিক আর অন্য দিকে ফলস বে, মাঝে স্বচ্ছ মেঘের আস্তরণ মুড়ি দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে কেপ পেনিনসুলা। আপশোস একটাই— চোখে যা দেখলাম, সে দৃশ্য ঠিক মতো ক্যামেরাবন্দি করতে পারলাম না। |
|
নীচে নামার পর আশেপাশে ঘুরে সবচেয়ে বেশি দেখতে পেলাম আফ্রিকান পেঙ্গুইন। কখনও তারা উদ্দাম ঢেউয়ের তালে তালে সাঁতার কাটছে, কখনও বা নির্বিকার ‘অ্যাটিটিউট’ দেখিয়ে গটগটিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে।
কেপ পয়েন্টের পর আমরা গেলাম ‘ওয়াইন ল্যান্ড’ দেখতে। কেপ টাউনের বিভিন্ন পাহাড়ের ঢালে আঙুরের চাষ হয়। ফার্মের লাগোয়া থাকে ওয়াইন তৈরির কারখানা। টিকিট কেটে ঢুকলে সেখানে মিলবে ওয়াইন চেখে দেখার সুযোগ। তবে আমার চোখে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগল ওয়াইন ল্যান্ডের দৃশ্যপট— লাল, সবুজ, কালো বিচিত্র আঙুরে কী বর্ণময়, কী অপূর্বই না দেখায় এই পাহাড়ি উপত্যকাগুলোকে।
কেপ টাউনের এই বর্ণময় চিত্রই কিন্তু শেষ কথা নয়। এখানকার আনাচে কানাচে এখনও উঁকি দেয় বর্ণবিদ্বেষের ইতিহাস। ইতিহাসের সেই কলঙ্কিত অধ্যায়ের ময়নাতদন্ত করতে পর দিন রবিবার আমরা ফেরি ধরে পৌঁছে গেলাম রবেন আইল্যান্ড। দীর্ঘ ১৮ বছর বা তারও বেশি এখানেই নির্বাসিত ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা-সহ অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিরা। গাইড ভদ্রলোক জানালেন বর্ণবিদ্বেষ বা আপার্থেড-এর কাহিনি। স্বচক্ষে দেখে এলাম তখনকার কয়েকজন বন্দিকে। পর্যটকরা তাঁদের কাছে শুনছেন কারাজীবনের অভিজ্ঞতা।
রবেন আইল্যান্ড থেকে ফিরে আমরা দেখতে গেলাম কেপ টাউনের আরও একটি অঞ্চল বো কাপ। ঊনবিংশ শতকে প্রধানত বহিরাগত মুসলিমরা এই টাউনশিপটি তৈরি করে। এখানকার বাড়িগুলো রঙের ব্যবহার আর বিশেষ ধরনের স্থাপত্যশিল্পে অনন্য। আজও এই বাড়িগুলো সিগন্যাল হিলের ঢাল বেয়ে তাদের অপরিবর্তিত আদি অবস্থায় কেপ টাউনের বুকে মিশ্র সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। |
|
|
|
ওয়াইন ল্যান্ডের আঙুর |
রবেন আইল্যান্ডের কারাবাস |
রঙিন বো কাপ অঞ্চল |
|
ঘোরাঘুরির পর্ব শেষ। পর দিন মিশিগান ফেরত যাওয়ার পালা। সে দিন রাতে আমরা হাজির হলাম কেপ টাউনের এক বিখ্যাত কুর্দিশ রেস্তোরাঁ ‘মেসোপটেমিয়া’য়। চেয়ার টেবলের বন্দোবস্ত নেই। জুতো খুলে কুশনে হেলান দিয়ে গদিতে আয়েস করে বসতে হয়। পাশে রাখা কারুকার্য করা রঙিন গড়গড়া। যে কেউ চাইলে কয়েকটা টান মারতেই পারে। আমরা অর্ডার করলাম ৩-কোর্স ডিনারের। প্রথমে এল বিশাল এক থালা, দু’জনের জন্য একটাই। তাতে সাজানো আমিষ-নিরামিষ মিলিয়ে অন্তত ৬/৭ রকমের কাবাব আর পেল্লাই দু’টো রুটি। খাওয়া আরম্ভ করতেই শুরু হল চমক। ঘরে ঢুকল আরব্যরজনীর পাতা থেকে উঠে আসা তিনটি মেয়ে। কুর্দিশ গানের তালে তালে শুরু করল বেলি ড্যান্স। দু’ তিনটে গানের পর এরাই শুরু করল আরও চমকপ্রদ নাচ— কখনও মাথায় বিভিন্ন সাইজের কলসি, কখনও প্রদীপের সাজি নিয়ে ব্যালান্স করে নাচ। তত ক্ষণে আমাদের ডিনারের দ্বিতীয় পর্ব এসে গিয়েছে— প্রকাণ্ড থালায় পোলাও জাতীয় খাবারের সঙ্গে ভেড়ার মাংস, মুরগি, শামুক, ঝিনুক, আরও অনেক কিছু। নর্তকীরা এ বার প্রত্যেকের গদিতে একটা করে ঝলমলে ঝালর লাগানো কোমরবন্ধনী রেখে গেল। এ বার সেগুলো পরে আমাদেরও নাচে যোগ দিতে হবে। বাঁকা উঠোনের দোহাই দেব না— আমি বা সায়ন এক ফোঁটাও নাচতে পারি না। কাজেই খুব মনোযোগ দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। আড়চোখে দেখলাম, পাশের গদিতে যে প্রৌঢ় দম্পতি বসেছেন তাঁরাও কুর্দিশ চায়ের পেয়ালায় মনোনিবেশ করেছেন। অবশ্য, সেখানে উৎসাহী জনতার অভাব ছিল না। এক দঙ্গল আমেরিকান যুবক-যুবতী সোৎসাহে নাচতে শুরু করল। মিষ্টান্ন পর্বের সঙ্গে বদলে দেওয়া হল গানও। চালানো হল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কয়েকটি গান, যেমন শাকিরার হিপস্ ডোন্ট লাই, ওয়াকা ওয়াকা ইত্যাদি। অবশেষে স্লাম ডগ মিলিয়েনিয়ার। আমরা দারচিনি দেওয়া মিষ্টিগুলো মুখে পুরে দেখি ঘরভর্তি জনগণ উদ্দাম উল্লাসে নেচে চলেছে, আর সেই সঙ্গে সুখবিন্দর সিং-এর সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়ে চলেছে ‘জয় হো, জয় হোওওও, জয় হো’।
|
এক কথায়: রোদ ঝলমলে পাহাড় আর নীল সাগরে ঘেরা,
মনোরম
উষ্ণতায় ভরা, আশ্চর্য রঙিন এক শহর— কেপ টাউন। |
|
|
শিলিগুড়ির মেয়ে। শিবপুর থেকে বিই পাশ করে কয়েক বছর আইবিএম-এ চাকরি করার পর বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠরতা। স্বামী মিশিগানে কর্মরত। দু’জনেই দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতে প্রবল আগ্রহী। নিজের বা স্বামীর কর্মসূত্রে কিংবা নিছকই ভ্রমণের তাগিদে এখনও পর্যন্ত বেশ কিছু জায়গা দেখার সুযোগ হয়েছে। কাজ আর পড়াশুনোর ফাঁকে রান্নাবান্নাতেও বেশ উৎসাহ আছে। |
|
|
|
|
|
|
|