পুজো ও পার্বণ...
এক যে ছিল সরস্বতী পুজো
শুভশ্রী নন্দী
(আটলান্টা)
রস্বতী পুজো মানেই শুধু রোদ-রঙা হলুদ শাড়ি নয়, অনেকেরই প্রথম শাড়ি পড়ে শিহরিত হবার দিন। বই না ছোঁয়া, গুরুজন-গ্রাহ্য আর অনুমোদিত হবার দিন, বড়দের চোখে আশকারার সিগন্যাল পেয়ে বইপত্র দেবী পায়ে গচ্ছিত রেখে, টো টো কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার দিন, এক বছর চাতক-প্রতীক্ষার পর কুল খাবার লাইসেন্স পাবার দিন, ভবিষ্যতের বিদ্যাসাগর-আইনস্টাইনদের হাতে খড়ির দিন,অলিখিত-বকলমে বাংলা ভালেনটাইন্স ডে— রোমান্স-রোমাঞ্চ-অ্যাডভেঞ্চার কেমন করে যেন সরস্বতী পুজোর ভ্যেন-ডায়াগ্রামের মধ্যে জুড়ে যায়, ঢুকে পড়ে উত্সবের আনুষঙ্গ হয়ে। ভোলাভালা-এলেবেলে-সাদামাটা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে কেউকেটা বনার দিন। জোড়া ইলিশে রসনাতৃপ্তির দিন।

“শ্বেতপদ্মাসনা দেবীশ্বেতপুষ্পপদ শোভিতাশ্বেতাম্বর ধরানিত্যং শ্বেতগন্ধানুলেপন”— এত শ্বেতের মধ্যে কোথা থেকে হলুদের উদয় হল! সে রহস্য অনুন্মোচিতই রয়ে গেল। এত সাদার মাঝে বাঙালি তার নিজস্ব ঢঙ-আবেগে আবিষ্কার করে ফেলল হলুদ। সে থাক, যে কোনও ‘ব্র্যান্ড-নিউ’ ইংরেজি বছরের প্রথম পুজোর শুরু বিদ্যার দেবীকে দিয়েই। ফাল্গুন মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ আর বিদ্যাস্থানে বিল্ব পত্র দিয়ে তাঁকে আবাহন করি আমরা। অন্যান্য পুজোর মতো শুধু অঞ্জলিতেই নয়, আয়োজনের অংশীদার ও ভাগীদার ছোটরাও। পিড়ি, গাঁথা-মালা, তামা-পাথর-কাঁসার বাসন, আসন, বামুন, চিনি-পৈতে, ইত্যাদি উন-কোটি পুজোর উপাচার অন্য পুজোর ব্যাপক আয়োজনে ছোট্টদের দু’চোখ থেকে হারিয়ে গেলেও, ঘরের চারভাগের একভাগ জুড়ে থাকা ঘরোয়া পুজোর আয়োজন-উপাচার যেন মাথায় বসে যায়। মুখস্থ করে নেয় চোখ, ‘মেমরি গেম’-এর মতো। সংস্কৃত ভাষা না জেনেও একমাত্র সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি-মন্ত্র, ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে গড় গড় করে মুখস্থ বলে যেতে পারে মগজের কোষ। খাগের কলম কালিতে ডুবিয়ে লিখতে কেমন লাগে, তার স্বাদও পেয়েছিলাম সরস্বতী পুজোয়। ‘দোয়াত আছে, কালি নাই’ বলেই তো মলাটের সেই দুটি ছেলে মেয়ে এত ‘হাসি-খুশি’। আর আমার বেলায় খাগ, বাবার সুলেখা কালি-ভরা নিবের কলম, বোনের মেড ইন চায়না ‘উইংসাঙ পেন’ আর আমার ডট/ বল পেন পাশাপাশি শুয়ে জানায় চতুষ্কোণ উপস্থিতি। এ যেন বংশপরম্পরায় কলমের বিবর্তনের ইতিহাসের প্রদর্শনী। আর সারা বছর আলমারিতে বন্দি থাকা, বিদেশ থেকে পিসির আনা পার্কার আর শেফার্ড কলম দুটিও ততক্ষণে সরস্বতীর সামনে বলছে ‘প্রেসেন্ট প্লিজ’।

দিদিমাদের সঙ্গে হারাল তেঁতুল-বিচি দিয়ে অক্ষর শেখার অভ্যেস, মায়েদের সঙ্গে হারাল বিদ্যা-শিক্ষার সরঞ্জাম স্লেট-চক, আর আমাদের শৈশবের সঙ্গে হারাল সেই কালির কলমের চাপে, কড়া-পড়া মধ্যমার আঙ্গুলগুলো!

লক্ষ্মীপুজো একান্তই ঘরোয়া ও ব্যক্তিগত। দুর্গাপুজো হয় সাবেকি, নয় সর্বজনীন। কিন্তু সরস্বতী পুজোর বেলায়, যতই সকলে সর্বজনীন পুজোয় হন্তদন্ত হয়ে ছুটুক, তার আগে বাড়ির পুজো সারা চাই-ই চাই। এ ভাবেই সরস্বতীপুজো ‘ওগো আমার, ওগো সবার’ পুজো। সরস্বতী পুজোর নামে, কাঠ অ-রোমান্টিকেরও নস্টালজিক ছবির সিরিজ বেরিয়ে পড়ে মনের প্যান্ডোরার বাক্স থেকে। আরেকটি অতিরিক্ত হাফ-ডে আদায়ের জন্য প্রায় আগের দিনই ইস্কুল থেকে ফিরে, বইপত্র দেবী-পায়ে সমঝে গা-ঢাকা দি আর কি! ইস্কুল চত্বরে সারি বেধে দাড়িয়ে,আগের দিনই নাড়ু-মুচমুচে কুচো নিমকি জাতীয় শুকনো খাবার প্লাস্টিক ব্যাগে পুরে, মোমের আলোয় মুখবন্ধ করতে লেগে যেত অসংখ্য নিরলস কচি হাত। ‘এ যে স্কুলের ছাত্রী নয়, যেন পাকা প্যাকেট বাঁধার ফ্যাক্টরি কর্মী’— রাশভারি দিদিমণিরাও ঠাট্টা করতে জানেন তা হলে!! সঙ্গে পরদিন পাতপেড়ে খিচুড়ি-লাবড়া খাবার উদ্যোগে কলাপাতা ও শালপাতা ভেজা কাপড়ে মুছে রাখার হুল্লোড়েই হয়ে যেত অষ্টম পিরিয়ডের সমবায়িকা বই এর 'দশে মিলে করি কাজ" এর হাতে কলমে অভিজ্ঞতা। জানতে ইচ্ছে হয়, সেই রামেরা হারিয়ে গেলেও, রামরাজ্য কি এখনও অটুট? নাকি সেই সব দিনগুলোকে গিলে ফেলেছে এইসব দিন, আরও অনেক অ্যান্টিক অভ্যেসের মতো। জীবনের প্রথম অনুষ্ঠান উপস্থাপনা ভাগ্যিস বাগদেবী এসে উদ্ধার করেছিলেন বলেই না, অপরিণত বয়সে সে যাত্রা রক্ষা হয়েছিল! সেই শিশু-বিশ্বাস আজও টলাতে পারেনি বড়বেলার ঝড়ঝাপটা। আর জীবনে প্রথম বনা স্যাঁকা রুটি? সেও তো সরস্বতী পুজোকে ঘিরেই। ডেকরেশনে কোন আবাস জিতবে-তাই নিয়ে কত পরিকল্পনার লোফালুফি ছোঁড়াছুড়ি। আর সেদিনই আত্মগঞ্জনায় স্বলজ্জ জীবনপাঠ হয়েছিল যে কতজনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি থাকলেও, স্যাঁকা রুটিরই জুটে যায় তারিফের তকমা। বুক বাজানো শেখেনি তখনও কচি-ছাত্রী মনটি।

এক পাড়ার পাঁচ বাড়ির পুজো সারতে আসবেন যে পুরুত মশাই়, কার এবং কোন বাড়িতে প্রথম আসবেন, তাই নিয়ে দেখা করে বা ফোনে চলে বড়দের নেগোসিয়েশন-এর তোড়জোড়। কখনো সখনো পুরুত ক্রাইসিস এর পারদ চরমে উঠলেও, কুছ পরোয়া নেই। পুজোর মধ্যে ছোট ছোট চোখগুলি হঠাত্ই আবিষ্কার করে ফেলে, পুজোর আসনে বসা কোনও পাড়ার চেনা কাকুকে, বা নিজের বাড়ির জ্যেঠুকে। মনে পড়িয়ে দেয় প্রচলিত রসিকতা, এ যেন নিজেদের পরিবারের মধ্যে বিয়ে স্বীকৃত সম্প্রদায়ের কন্যা, শুভদৃষ্টির সময় বরটিকে দেখে চমকে বলে ওঠে, ‘আরে! সোনাদা দেখি!’ ‘বীণা রঞ্জিত পুস্তকহস্তে’...এ যেন দেবী বর্ণনার আঁকা ছবি। এক হাতে পড়া-পরীক্ষা, আরেক হাতে গান-বাজনা কলা-চর্চার দায় নেবার দেবী ‘গডেস অব উইসডম’— সরস্বতী। তাই জন্যই তো পড়ার বইয়ের সঙ্গে দেবী পায়ে গচ্ছিত থাকে গানের স্বরলিপি খাতাও। পুজোর পরদিন বইয়ের ভাঁজে চেপ্টে থাকা গাঁদাফুল-বেলপাতা ভরসার চিহ্ন হয়ে লেপ্টে আছে যেন। এখনকার পড়ুয়াদের কাছে এও এক গপ্প ঠেকবে, একমাত্র দুগ্গাপুজো ছাড়া একদা ছাত্রকুলেরা পুজোর পরদিন ১০৮ বার ‘ওম সরস্বতৈঃ নমঃ’ লিখে তবেই পড়াশুনোর নিত্যনৈমিত্তিক রোজনামচায় ফিরে যেত। ছোট্ট ছোট্ট মূর্তিগুলোয় সেজে থাকত দোকানগুলো একমাত্র সরস্বতী পুজোতেই, যার আবার বিসর্জনও হত না। মহা ফাঁকিবাজকে পাহাড়া দিতেই বোধ হয়, মা পড়ার টেবিলের ওপর মূর্তিটি বসিয়ে নিশ্চিন্তে সংসার সমুদ্দুরে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। আর আমাদের মাথায় শুধু পড়াশুনো ছাড়া দুনিয়ার বাকি সব কিছু কিলবিল করত। প্রায়শই চঞ্চল মনকে দেখা যেত গবেষণা করতে— বাহন হাঁসটি যদি এত প্রিয়, তবে ‘পরীক্ষায় ডিম পাবি’ বলে আমার সঙ্গে হাঁসটির হবু সন্তানকেও কেন এতো গালাগালির গ্লানি সহ্য করতে হয়? আর আমেরিকাতেও একটু বেশী মাত্রায় ছেলেমানুষী করলে, প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে আমার মেয়েকে আদর করার সময়, তার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে স্কুলের মিস বলে কিনা ‘সিলি গুজ’!

আমাদের দেখাদেখি বই পায়ে লাগলে আমার মুসলমান বন্ধুর হাত মাথায় উঠে যেত। যেমন উঠত আমার তিন বছরের অবোধ বোনেরও। আর আমার অসমিয়া বন্ধুর জাতীয় উত্সব বিহু, আর তেলুগু বন্ধুর জাতীয় উত্সব দিওয়ালি, উড়িয়া বন্ধুর দশেরা, আর আমার দুর্গাপুজো হলেই বা কি হলো? আমার হাতেখড়ি তো তেলুগু বন্ধুর অক্ষর-অভ্যাস, আর উড়িয়া বন্ধুর বিদ্যারম্ভ— সরস্বতী পুজোর ব্যাপারে ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ হয়ে আমরা ‘এক সূত্রে বাঁধিয়াছি, সহস্রটি মন’। বিদ্যার দেবীকে অগ্রাহ্য করব, এমন অতিরিক্ত একটি মাথা, কারও ঘাড়ের ওপর আছে নাকি? মাথার ভেতর মগজটির কদর ছাত্র-ছাত্রীদের চাইতে আর কে বেশি জানে? তাই সরস্বতী পুজো ছাত্র-ছাত্রীদের সর্বজনীন পুজো। মাইক বাজনার দেবী সরস্বতী নন। বরং হুল্লোড়হীন তিনি স্কুল-কলেজ-হস্টেল চত্বরে সকলের বাড়িতে বোন লক্ষ্মীর মতই স্বচ্ছন্দ-ঘরোয়া-আদৃত। মাত্র একদিনের পুজো, ড্যাং ড্যাং করে বাজনা নেই-ভাসান নেই, অন্য শহর থেকে আসা আত্মীয়েরা বাড়ি জুড়ে নেই। অত ‘নেই’-এর মাঝেও, ছাত্রশক্তি দলনেত্রী হয়ে তিনি স্থায়ী ভাবে বিরাজিত-উপাসিত। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেশীয় সরস্বতী পুজোর বড় অঙ্গ না হলেও, আমেরিকায় সরস্বতী সে ইচ্ছে পূরণ করেছে— সেও এক বড় পাওয়া। ছোটরাই সে দিনের অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। বিদেশের মাটিতে সরস্বতী পুজোকে ঘিরেই বাঙালি এনেছে এক নতুন ডাইমেনশন। মন ভালো করতে, মায়ের সযত্নে জমিয়ে রাখা আমার ছোটবেলার ডায়েরিটা খুললেই কাঁচা হাতের লেখা বেশ উপভোগ করি। আরে! সেখানে সরস্বতী পুজো নিয়ে, কালজয়ী-প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে, কটি লাইন কোনও জাদুবলে? যে কোনও যুগের, যে কোনও ছাত্র-ছাত্রীর মনের ছয়লাপ ও ছায়া রয়েছে এই কটি ছত্রের মর্মমূলে। যা আজও ঠেকে ‘টাটকা-নতুন’
সরস্বতী পুজো সরস্বতী পুজো
আমার প্রথম হলুদশাড়ি পড়া
সরস্বতী পুজো সরস্বতী পুজো
আমার হস্টেল চষে ঘোরা
সরস্বতী পুজো সরস্বতী পুজো
প্রথম হাতেখড়ির দাগ
সরস্বতী পুজো সরস্বতী পুজো
মুখে কুলের অমন স্বাদ
সরস্বতী পুজো সরস্বতী পুজো
এমন পুজো আর কোথায়?
ঠাকুর বই আগলে রেখে মজা করতে পাঠায়।
— নিজস্ব চিত্র
পুজোর বিশেষ লেখনী
বিভুঁই সরস্বতৈঃ দেব্যৈ নমঃ
সুচেতনা সরকার
রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ