পুজো ও পার্বণ...
বিভুঁই সরস্বতৈঃ দেব্যৈ নমঃ
সুচেতনা সরকার
(ক্রয়ডন, লন্ডন)
ংস্কৃতটা ঘেঁটে গেলেও সংস্কৃতিটা বদলায়নি। সরস্বতী পুজোর সকালে পুরোহিত অপহরণ করার সংস্কৃতির কথা বলছি। বারান্দায় শাড়ি পরে রুমি, সুমি, টুকটুকি ঠাকুরমশাইয়ের জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছে। কোনও রকমে বাড়িতে অঞ্জলিটা হয়ে গেলেই স্কুলে যাওয়া হবে। রাস্তায় বাবা, জ্যাঠা কিম্বা ছোড়দা সাইকেলে চড়া বা পায়ে হাঁটা পুরুত দেখলেই পিছন পিছন দৌড় দিচ্ছে ঠিক একেবারে চোরের পিছনে ধাওয়া করার মতোই, কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই ‘নো লাক’! বাড়ির সামনে এমনি ‘হাইজ্যাকিং পার্টি’ দেখলেই পুরুতঠাকুরের সাইকেলটা প্রায় ফেরারির গতিতে ‘হুউউউশ’ করে বেরিয়ে যেত। তার পর অনেক কসরতের পর এক জন ঠাকুরমশাই যদিও বা হস্তগত হলেন, কিন্তু তাঁর সংস্কৃত মন্ত্র শুনে কচিকাঁচারা অক্কা পাবে— নিশ্চিত! এমন ‘হাইজ্যাকড’ এক পুরুত এক বার বাগদেবীকে ‘বাগদাদেবী’ বলেছিলেন— ঠাকুমা বল্লেন, “অ পুরুতঠাকুর, বাগদাদেবী কী গো? এই বাগদেবীর কি চিংড়িহাটায় বাড়ি?” তো পুরুতও সোজাসুজি বলে দিলেন, “কুড়ি টাকায় এর চেয়ে আর বেশি কী পাবেন ঠাকমা? ভাল মন্তরের জন্য ভাল মালকড়ি ছাড়ুন! সব বইয়ের মাপে বেরোবে!”

পুরোহিত অপহরণের ঘটনা সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারেও বহাল রয়েছে এত দিন পরেও।

সাউথ লন্ডনের একটি জনবহুল শহর ক্রয়ডন। বেশ কিছু ঘর বাঙালির বসবাস। গত বছর সরস্বতী পুজোতে শুরু হয়েছিল ক্রয়ডন বেঙ্গলি কানেকশনের যাত্রা। এ বার তার দ্বিতীয় বছর। হৈহৈ করে ঠাকুর সাজানো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া দেওয়া, এক সঙ্গে নাড়ু বানানো, স্যুভেনিরের জন্যে দিন-রাত এক করে স্পনসর জোগাড়, সবই বেশ মজার ব্যাপার! কিন্তু গোল বাধল সেই পুরুত খুঁজতে গিয়ে। মুখুজ্যে, চাটুজ্যে দেখলেই— এই ধর, এই ধর ব্যাপার! শেষ কালে বাঙালি বামুনরা আমাদের দেখলেই পালায় আর কি! কথোপকথনটা অনেকটা এই রকম হত—
“আচ্ছা আপনি কি পুজো করতে পারবেন?”
“পুজো?”
আকাশ থেকে পড়ে নব্যযুগের কম্পিউটারাইজড বং-সমাজ! আমতা আমতা করে ঢোঁক গিলে আরও অবাক হয়ে আবার বলে, “পুজো?”
বামুনের আহ্লাদে গদগদ সুন্দরী আধুনিকা বউটি একগাল হেসে বলে, “আহা সুদি ওতো বাড়িতেই কোনও দিন পুজো করে না! তায় আবার এ রকম পাড়ার পুজো? তুমি আর লোক পেলে না?” দু’হাতে ঘণ্টা আর প্রদীপের দু’রকম চক্কর কাটার ‘সিনক্রোনাইজেশন’-এ আধা সাহেবি মানুষটার কেমন দুর্দশা হতে পারে ভেবেই হেসে কুটিপাটি হয় তার অর্ধাঙ্গিনী।

আমি নাছোড়বান্দা! দমে যাওয়া আমার কম্ম নয়। আরও দু’চারজন কে পাকড়াও করি! কেউ বলে, “ওমা আমি তো বাংলা পড়তেই পারি না!” তো কেউ আবার বলে, “বুঝলে সুচেদি, আমি হলাম কি না কলেজে পড়ার সময় ইউনিয়নের জিএস,আর আমি করব কি না পুজো? ছোঃ! আমি লেফট লিবারাল উদারচিত্ত সেকুলার বাঙালি! হে হে! তুমি বরং অন্য কাউকে ধরো গে!”

কী মুশকিল! শেষ অবধি পূজারি মিলল বটে। একদম ধোপদুরস্ত সাহেব— দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত এলাকার একদম খাঁটি বঙ্গসন্তান, বহুজাতিক ব্যাঙ্কের ট্রেডার, শিক্ষাদীক্ষা কোনও কিছুতেই কম নয় সে। তার স্ত্রীটি আইরিশ, নরম সরম মিষ্টি মেয়ে, ভিক্টোরিয়া। বাংলা সংস্কৃতি, ভাষা, গান, খাওয়াদাওয়া-সহ সে ভালবাসে তার স্বামীর দেশের সব কিছুকে! পুজোর জোগাড়যন্ত্রে তারই বেশি উৎসাহ। পাঁচালি জোগাড় হল— কে যেন কলকাতা থেকে স্ক্যান করে পাঠিয়েছিল। আমি যখন পুরোহিতের সঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণের ‘রিহার্সাল’ করছিলাম তখন ভিক্টোরিয়ার প্রতিটা শব্দের মানে নিয়ে কী উৎসাহ, কত কৌতূহল! ভিকিকে দেখে কেন জানি আর একজন আইরিশ কন্যার কথা মনে আসছিল— যিনি ভারতের ধর্ম, রাজনীতি, মানুষের টানে দেশ আত্মীয়স্বজন ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন হাজার হাজার মাইল! সারদা মায়ের আদরের ‘খুকি’ সিস্টার নিবেদিতার কথাই বলছি। ক্রয়ডন থেকে বেশি দূরে নয়, টেনিস তীর্থ উইম্বলডনেই তো তিনিও থাকতেন!

ক্রয়ডনে স্বয়ং মা সরস্বতী তো পৌষ মেলার শান্তিনিকেতন থেকে এসে হাজির হয়েছিলেন আগের বছরেই, সুটকেস বন্দিনী হয়ে। শুধু পাটের দড়ির অপরূপ কারুকাজে হাল্কা বাদামি রঙের সরস্বতী যেন সত্যিই ‘বিভুঁই সরস্বতী’ হয়ে উঠেছেন এখানে! লন্ডনবাসিনী বিদ্যাদেবী যেন আমাদেরই মতো দেখতে, গায়ে তার রোদের আদর লাগা, ছায়া ছায়া রঙে চোখ ঝলসায় না! শুভ্রা সরস্বতীর থেকে এ যেন অনেক সুন্দর, সহনীয়। পাটে বোনা বাগদেবীর গলায় পরিয়ে দিই কাগুজে গাঁদার মালা, আর সদ্য ফোটা ক্রিসান্থেমাম, মাথার চূড়ো খোঁপায়, কুচযুগলে, হংসপাখায় চন্দ্রাণী পার্লস! জেনারেশন এক্স বাঙালি আমরা, এ ছাড়া মুক্তাহার আর পাব কোথায়? সরস্বতীর পায়ের তলায় বাদ্যযন্ত্র এখানেও রাখা হয়— আমাদের ছেলেপুলেরা হারমোনিয়াম-তবলা ছাড়াও শেখে স্যাক্সোফোন, পিয়ানো, অর্গান, ফ্লুট রেকর্ডার, ক্ল্যারিওনেট। বইপত্রেও তো রকম ফের! তবু মায়েরা ছুঁইয়ে নেয় পরীক্ষার কলম বা ইস্কুলের ডায়েরি— এক মুঠি ফুল সযত্নে ভরে রাখে এফসিইউকের অথবা গুচির ডিজাইনার পার্সে। মায়ের মন তো ! হাজার বছরেও বদলাবার নয়! হাতেখড়ি হয় ম্যাগনেটিক স্লেটে গোটা গোটা বাংলা হরফে ‘অ’ ‘আ’— দেখে চোখ জুড়োয়! আমি যে নিজেকে চিরদিন এই বাংলাতে এ ভাবেই খুঁজে এসেছি!


মঞ্চে আসে পরিবর্তিত পরিবর্ধিত কাবুলিওয়ালা— পরিবর্তনের যুগ়, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে তো হবে! আসলে সোহমের কাবুলিওয়ালা হওয়ার কথা ছিল। সে স্কুলে স্যাক্সোফোন শিখত তাই আমাদের স্টেজের কাবুলিওয়ালা আর মিনির ভাব হয় স্যাক্সোফোনে— ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ গানের সুরে। পরে অবশ্য লাজুক সোহম পিছিয়ে আসে কাবুলিওয়ালার চরিত্র থেকে। সে জায়গা নেয় কলকাতার ছেলে ইন্দ্রনীল। কিন্তু তত দিনে কাবুলিওয়ালার ভাগ্য তো লেখা হয়ে গিয়েছে, তাই গপ্পো আর বদলায় না— এই মডার্ন রহমতের এক হাতে স্যাক্সোফোন আর এক হাতে মেওয়ার প্যাকেট। ছোট্ট সুদীপ্তার ডাক নাম মিনিই হয়ে যায় লোকের মুখে মুখে। ৩ থেকে ৫ বছরের ছেলেপুলে আত্রেয়ী, অনুষ্কা, আদৃতা, আশনা, জিয়া, রিতিকা, প্রাঞ্জল, শুভম, ইধান্ত, শ্রেয়ান, সাগ্নিক, সুস্মিত আর সায়ক হাত ধরে নাচে ‘আয় তবে সহচরী’। গুড়িয়া আর জাগরী নাচে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’। আর বিয়ের দিনের মিনি হয় শরণ্যা— কিশোরী সে কন্যার নাচে মনে হয় সাগরপারের একুশ শতকের গ্লোবাল বাঙালি ডাকছে মা সরস্বতীকে ‘এস দেবী এস হে আলোকে...’।
এই ‘আলোকে’ নিয়ে আসার গল্পটাই ক্রয়ডন বেঙ্গলি কানেকশনের গল্প। সেই সুখের গল্পে ফেসবুক, ট্যুইটার, ই মেল সব জায়গা থেকে জড়ো হতে থাকে বাঙালিরা। সবাই একে একে আসছে, মিশছে, মিলছে, দেওয়া নেওয়া চলছে, ভালবাসা-আত্মীয়তা গড়ে উঠছে। আমাদের একটাই মিল। আমরা সবাই বাঙালি! একটাই আশা, বাংলা ভাষাটাকে যেন ছেলেপুলেদের মধ্যে গেঁথে দিতে পারি।

সরস্বতীর পায়ে এক মুঠো হলুদ মেঠো ফুল— ডেইজি দিয়ে ভাবি, এই আমার গাঁদা। হলুদ শাড়িতে, কুর্তা পাজামায় কুচোকাঁচাদের দেখে মনে পড়ে, ফেলে আসা সকালের অঞ্জলি, খিচুড়ির লাইন, আনকোরা ভ্যালেন্টাইন পর্ব, টোপা কুলের চাটনি, ইস্কুলের দেওয়াল পত্রিকা, গোটা-সেদ্দ কিম্বা জোড়া ইলিশকে।

ক্রয়ডনের বাতাবরণে বসন্ত পঞ্চমীর চাঁদের আঁকাবাঁকা ভাষায় লেখা হয় কলকাতার উৎসবের কথা। এখানকার বেঙ্গলি কানেকশন সত্যিই এক ‘সংযোগ’ হয়ে উঠেছে। আগামী দিনে বাংলার সঙ্গে লন্ডনের সেতু হয়ে দাঁড়াবে এই বাঙালি ইচ্ছেডানার গল্পটি।
—নিজস্ব চিত্র
পুজোর বিশেষ লেখনী
এক যে ছিল সরস্বতী পুজো
শুভশ্রী নন্দী
রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ