আপনার কলমে


পথ গিয়েছে কেদারনাথে
শিবু মণ্ডল
ত পুজোর মরসুমেই কেদারনাথ যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু নানা কারণে আর যাওয়া হয়নি। তাই সিদ্ধার্থদা বলতেই এ বার রাজি হয়ে গেলাম। কেদারনাথ অনেকদিন থেকেই ডাকছিল আমায়। অন্য দিকে আমার স্ত্রী শিখাও নেই, ও শিলিগুড়িতে। সুতরাং একেবারে ঝাড়া হাত পা। শুধু অফিসে বলে ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে।

এত অল্প সময়ের মধ্যে গঢ়বাল মণ্ডল বিকাশ নিগম-এর অতিথিনিবাসে কোনও বুকিং পাওয়া গেল না। গৌরীকুণ্ড ও কেদারনাথে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের ধর্মশালা বুকিং করার জন্য আমরা হরিদ্বারে তাঁদের আশ্রমে যোগাযোগ করলাম। কিন্তু কোনও আশ্বাস পাওয়া গেল না, শুধু বলা হল— চলে যান খালি থাকলে পেয়ে যাবেন।

এই সময় পুরো পিক সিজন, তাই এক দিন আগেও বাসের টিকিট পাওয়া গেল না। অগত্যা কোনও রকমে একটি শেয়ার ট্যাক্সিতে আমাদের ঠাঁই হয়ে গেল। কলকাতা থেকে আসা তিন জন পর্যটকের কেদার-বদ্রী দুই ধামের জন্য রিজার্ভ করা সেই ট্যাক্সিতে গৌরীকুণ্ড ‘ড্রপিং’-এর জন্য আমাদের আড়াই হাজার টাকা দিতে হবে। তাতেই রাজি হয়ে গেলাম। এ দিকে ভারত সেবাশ্রমের আশ্রমে গিয়ে দেখা হয়ে গেল আমার এক পুরনো সহকর্মী আশিস চক্রবর্তীর সঙ্গে। সপরিবার তিনি হরিদ্বারে ঘুরতে এসেছেন, আগামিকাল কেদারনাথ যাওয়ার বাসের টিকিটও বুক করে ফেলেছেন।
পঞ্চকেদারের অন্যতম শ্রী কেদারনাথ ধাম
পর দিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমাদের ট্যাক্সি হরিদ্বার ছাড়ল। পাহাড়ে অনেক ঘুরেছি, তবুও কেদারনাথ দর্শনের জন্য মনটা ভীষণ ছটফট করছিল। শোনা যায়, তিনি না ডাকলে নাকি তার দর্শন পাওয়া যায় না— তাই উত্তেজনা আরও বেশি! হৃষীকেশের পর পাহাড়ের গা বেয়ে ধীরে ধীরে গাড়ি উপরে উঠতে লাগল। ডান দিকে প্রায় ৪০০ ফুট নীচে উদ্দাম গঙ্গার স্রোত। তার সঙ্গে টাল খেতে খেতে চলছে র‌্যাফটিং-এর দল। ঘণ্টা দুয়েক বাদে আমরা পৌঁছলাম বিয়াসি। চাষের জন্য, পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট ধাপ কাটা এখানে। গঙ্গার চরাতে গজিয়ে উঠেছে বেশ কিছু ‘ট্যুরিস্ট হাট’। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা চাইলে এখানে এক-দু’রাত কাটাতে পারেন। বিয়াসি পেরিয়ে পথের ধারের এক ধাবায় এখানকার বিখ্যাত আলুপরাঠা, ছোলা ও টকদই দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে আবার চলার শুরু।

ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল দেবপ্রয়াগে— ভাগীরথী ও অলকানন্দার সঙ্গমস্থল। এখানে ভাগীরথীর স্বচ্ছ আর অলকানন্দার গাঢ় খয়েরি স্রোত স্পষ্ট বিভাজন রেখার সৃষ্টি করেছে। রামায়ণে কথিত আছে, রাবণ হত্যার পর রাম পাপস্খালনের জন্য এখানে তপস্যা করেছিলেন। সেই প্রাচীন রাম মন্দির দর্শন ও সঙ্গমে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণের জন্য বহু পুণ্যার্থীর সমাগম হয় এখানে। রাস্তা থেকেই দু’চারটে ছবি তুলে অলকানন্দাকে ডান দিকে রেখে পাহাড়ের সর্পিল পথ বেয়ে এগিয়ে চললাম আমরা।

দুপুর সাড়ে এগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম শ্রীনগর— বেশ বড়সড় জমজমাট এক শহর, সমুদ্রতল থেকে প্রায় ১৭০০ ফুট উচ্চতায়। চায়ের তেষ্টা মেটাতে একটা বিরতি নিলাম এখানে। আশপাশ দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি একটি পাহাড়ি শহর। রৌদ্রের তাপও বেশ প্রখর। অতীতে এটি গঢ়বালের রাজধানী শহর ছিল। চোদ্দশো শতাব্দীতে এর স্থাপনা করেন গঢ়বালের রাজা অজয়পাল। এ অঞ্চলে অলকানন্দার উপর বাঁধ তৈরি হচ্ছে জলবিদ্যুতকেন্দ্র তৈরির জন্য। বাঁধ বরাবর, পাহাড়ের উপর দিকে তৈরি হচ্ছে নতুন রাস্তাও। আরও কিছুটা এগোনোর পর নজরে এল বিখ্যাত মাতা ধারিদেবীর মন্দির। ধর্মপ্রাণ সিদ্ধার্থদা গাড়িতে বসেই মায়ের উদ্দেশে শ্রদ্ধাভরে প্রণাম সেরে নিলেন।
দেবপ্রয়াগ রুদ্রপ্রয়াগ
এর পর রুদ্রপ্রয়াগ— মন্দাকিনী এসে মিশেছে অলকানন্দার সঙ্গে। এখান থেকে রাস্তা দু’টি ভাগ হয়ে একটি চলে গিয়েছে অলকানন্দার ধার ধরে বদ্রীনাথ, অন্যটি মন্দাকিনীর ধার ধরে কেদারনাথ। অলকানন্দার উপর দিয়ে সেতু পেরিয়ে, ৬৫ মিটার সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে পাহাড়ের অপর প্রান্তে মন্দাকিনীর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম কিছু ক্ষণ। আরও কিছুটা গেলে একটি ছোট ঝুলন্ত লোহার সেতু আছে। সেটির মাঝামাঝি গেলে স্পষ্ট দেখা যায় অলকানন্দা-মন্দাকিনীর সঙ্গম— মন্দাকিনীর স্বচ্ছ সবজে-নীল জলধারার সঙ্গে মিশে গিয়েছে অলকানন্দার গাঢ় খয়েরি স্রোত। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য অবাক চোখে দেখতে দেখতে মনটা কেমন যেন ভাবুক হয়ে গেল! সত্যিই পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে এমন রহস্যময় রূপ— এ পথে না বেরোলে দেখা হত না! আরও কিছুটা নীচে নেমে গেলাম সঙ্গমস্থলের খুব কাছে। সুন্দর বাঁধানো ঘাটে পুণ্যার্থীরা স্নান সেরে নিচ্ছেন। সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের উপর রুদ্রনাথজির মন্দির। এখানে দেবর্ষী নারদ ভগবান শিবের কাছে সঙ্গীতবিদ্যা শিখেছিলেন। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে তিলবাড়া হয়ে ১৮ কিলোমিটার দূরে অগস্ত্যমুনি বাজার। রাস্তার ডান দিকে, পাহাড়ের ধাপে ছোট্ট ঘিঞ্জি বসতির মধ্যেই কোনও রকমে টিকে থাকা অগস্ত্যমুনির মন্দির। এর পর থেকে রুক্ষ পাহাড়ের নীচের ঢালে মন্দাকিনীর ধার ধরে ধাপে ধাপে তৈরি করা সুন্দর চাষাবাদের জমি দেখে দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। গঙ্গা ও দেবভূমি হিমালয়ের অপার সৌন্দর্যের মোহে পড়ে খিদের কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম। চন্দ্রাপুরী বলে একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে নেওয়া হল। ঘড়িতে তখন দুপুর আড়াইটে। ধাবাটির পেছনের দিকটা খোলামেলা, কিছুটা দূরেই মন্দাকিনী কল-কল সুর তুলে বয়ে চলেছে।

মন্দাকিনীর কলতান শুনতে শুনতে চলে এলাম কুণ্ডে। কুণ্ড মানে দু’টি রাস্তার বিভাজন। একটি রাস্তা মন্দাকিনীর উপর ব্রিজ পার করে চলে যায় গৌরীকুণ্ডে, আর একটি রাস্তা সোজা উখিমঠে। প্রতি বছর ভাইফোঁটার দিন কেদারনাথের মন্দির বন্ধ হয়ে যায়, খোলে অক্ষয়তৃতীয়ার সময়। শীতকালের এই ছ’মাস কেদারনাথজির পুজো হয় উখিমঠের মন্দিরে। আবার সবুজ পাহাড়ের চড়াই বেয়ে পথ চলা। এই রাস্তা থেকে উল্টো দিকের বিস্তৃত পাহাড়ের উপরে উখিমঠ জায়গাটিকে স্পষ্ট দেখা যায়। সেখানের ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের গেরুয়া রঙের বিশাল আশ্রমটি ছোট দেশলাই বাক্সের মতো লাগছিল। কুণ্ড থেকে চার কিলোমিটার দূরেই গুপ্তকাশী। এখানে শিবের বিখ্যাত মন্দির আছে। কথিত, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আত্মীয়-বন্ধু হত্যার গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য পাণ্ডবেরা যখন শিবের খোঁজে আসেন তখন শিব এখানে নিজেকে ‘গুপ্ত’ করে রাখেন। আমরা অবশ্য শিবের খোঁজ না করে সোজা চলে গেলাম গৌরীকুণ্ডের পথে।

যতই মহাশক্তির কাছাকাছি চলেছি পথ যেন ততই সংকীর্ণ ও দুর্গম হয়ে চলেছে। নালা ও ফাটা নামে দু’টি লোকালয় পেরিয়ে পৌঁছলাম শোনপ্রয়াগ। ফাটা এলাকায় পাহাড়ের উপর বেশ কয়েকটি হেলিপ্যাড নজরে পড়ে। এখান থেকে কেদারনাথ পর্যন্ত হেলিকপ্টার পরিষেবা পাওয়া যায়। শোনপ্রয়াগে বাসুকিগঙ্গা এসে মিশেছে মন্দাকিনীতে। এখান থেকেই গৌরীকুণ্ড যাওয়ার গাড়িগুলির লম্বা লাইন পড়ে। কারণ, গৌরীকুণ্ডের ৫ কিলোমিটার আগে থেকে গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাস্তা ভীষণ সংকীর্ণ হওয়ায় আগে যাওয়া সব গাড়িগুলি যাত্রীদের নামিয়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমাদের প্রায় ঘণ্টা খানেক সেই জ্যামে আটকে থাকতে হল। অবশেষে বেলা পাঁচটা নাগাদ গৌরীকুণ্ড পৌঁছলাম। আশিসও তার পরিবার নিয়ে কিছু ক্ষণ আগেই পৌঁছেছে। সবাই মিলে চলে গেলাম ভারত সেবাশ্রমে। মহারাজের সঙ্গে কথা বলে কোনও রকমে দু’টি ঘর পাওয়া গেল।
কেদারের পথে...

ডুলিতে সওয়ার...

পথের ধারে খাওয়ার সাধন...
ভারত সেবাশ্রমের একদম সামনেই গৌরীদেবীর মন্দির ও তার পাশে সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতায় একটি উষ্ণকুণ্ড। কথিত আছে, ভগবতী গৌরী এখানেই শিবের তপস্যা করেছিলেন। মন্দিরের উল্টো দিকে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বেশ কয়েকটা ধর্মশালা, লজ, পুজোর পসরা সাজানো দোকান। সন্ধেবেলায় সকলেই কুণ্ডের গরম জলে স্নান সেরে নিলাম। গৌরীকুণ্ড থেকে কেদারনাথ ১৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হয়। তবে অন্যান্য পাহাড়ি তীর্থস্থানের মতো এখানেও ডুলির প্রচলন আছে। ইচ্ছে হলে ঘোড়ায় চড়েও যাওয়া যায়। আমরা হেঁটেই কেদার জয় করব বলে ভোর পাঁচটায় রওনা হয়ে গেলাম। শুরুতে ঘোড়ার ভিড় ও তাদের মলমূত্রের গন্ধের মধ্যে দিয়েই এগিয়ে যেতে হয় পাহাড়ের গা ঘেঁষে তৈরি সরু রাস্তা দিয়ে। পথের ডান দিকে নীচে দিয়ে গর্জন করে নেমে এসেছে মন্দাকিনী আর তার দু’পাশের জমিতেই সবুজের সমাহার। পাহাড়ের গায়ে থরে থরে উঠে গিয়েছে ফার ও পাইন গাছের সারি। বনরাজির ফাঁকফোকড় দিয়ে উঁকি মারছে ও পারের পাহাড়ের পিছন থেকে উঠে আসা ভোরবেলার স্বপ্নমাখা নরম আলো। আকাশ একদম পরিষ্কার ঝকঝকে। মাঝে মাঝে চোখ পড়ে পাহাড়ি ঝরনা। অতিরিক্ত ভিড়ের জন্য গম্ভীর পাহাড়ি পথের নির্জনতা ও নিস্তব্ধতা অবশ্য উপভোগ করতে পারছিলাম না। চার কিলোমিটার দূরে গড়ুরচটিতে খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার পাহাড় চড়া। এর পরের বিরতি কেদার ও গৌরীকুণ্ডের ঠিক মাঝামাঝি রামওয়াড়াতে।
স্বর্গ থেকে নেমে আসা মন্দাকিনী ভোরের আলোয় কেদার শৃঙ্গ
এর পর থেকে চড়াই ক্রমশই বাড়তে থাকে। কিছুটা হাঁটার পরই হাঁফ ধরে যায়, উচ্চতার কারণে। এত উপরে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে তাই। যত এগোতে থাকি পাহাড়ের সবুজ দীর্ঘ গাছপালাগুলিও একটা একটা করে যেন উধাও হতে থাকে। তার পরিবর্তে রুক্ষ পাহড়ের গায়ে দেখা যায় ছোট বড় ঝোপঝাড়। গায়ে হিমেল হাওয়ার ছোঁয়া নিয়ে পাহাড়ের একটা বাঁক ঘুরতেই দূরে দেখতে পেলাম কেদারনাথের বরফাবৃত শৃঙ্গ। সমস্ত ক্লান্তি যেন হঠাত্ উধাও হয়ে শরীরটা চনমনে হয়ে গেল। রাস্তার ধারের চটিতে একটা দোকানের সামনে রাখা চেয়ারে বসলাম, একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য। চা খেতে খেতে দোকানের মালিক সুরজ সিংহের সঙ্গে অনেক গল্প হল। তার মুখেই শোনা গেল কেদারনাথের কাহিনি—
পাণ্ডবদের চোখে ধুলো দিয়ে শিব গুপ্তকাশী থেকে কেদারনাথে এসে দেখলেন সেখানে অনেক মোষ চরে বেড়াচ্ছে। শিব তখন মোষের ছদ্মবেশ ধরে সেই পালের সঙ্গে মিশে গেলেন। ভীম শিবের চাতুরী ধরতে পেরে নিজের দুই পা ফাঁক করে দু’পাশের পাহাড়ে রেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভগবান হয়ে মানুষের পায়ের তলা দিয়ে যেতে পারলেন না শিব। ভীমের পায়ের ফাঁক গলে সব মোষ চলে গেলেও একটি মোষ গেল না। ভীম মহিষরূপী সেই শিবকে চিনতে পেরে পিছন থেকে জাপটে ধরতেই শিব মাটির তলায় লুকোবার চেষ্টা করেন। কথিত, তার ফলে শিবের পশ্চাদ্দেশ পড়ে রইল কেদারনাথে। তাই কেদারনাথে মহিষরূপী শিবের পশ্চাদ্দেশের বিগ্রহের পুজো করা হয়। শরীরের অবশিষ্ট অংশগুলি যথাক্রমে মদমহেশ্বর, তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ, কল্পেশ্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। যাই হোক পাণ্ডবদের ভক্তিতে খুশি হয়ে শিব স্বমূর্তিতে ধরা দিয়ে তাদের জ্ঞাতি হত্যার পাপ থেকে মুক্ত করে দেন। তার পর পাণ্ডবরা এই পাঁচ জায়গায় মহাদেবের মন্দির নির্মাণ করেন, যা পঞ্চকেদার নামে খ্যাত।
বরফাবৃত কেদার শৃঙ্গ
মন্দিরের এক কিলোমিটার আগেই হাল্কা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। দুপুর প্রায় একটা। সেবাশ্রম পৌঁছতে পৌঁছতেই ভিজে গেলাম। সেখানে রাত্রি যাপনের জন্য ডর্মিটরিতে জায়গা পাওয়া গেল। আশ্রমটি মূল মন্দিরের ঠিক পেছনে। তার পাশেই গা ঘেঁষে রয়েছে শঙ্করাচার্যের সমাধিস্থল আর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে স্বর্গ থেকে নেমে আসা মন্দাকিনী। কিছু ক্ষণ বাদেই বৃষ্টি থেমে গেল, মেঘ সরে গিয়ে ঝকঝকে রোদ। খাওয়াদাওয়া সেরে কিছু ক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। পথের ক্লান্তিতে ঘুম জড়িয়ে এসেছিল সারা শরীর জুড়ে। হঠাত্ করে সিদ্ধার্থদার ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল। জানলা দিয়ে দেখি বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। উত্তেজনায় শরীরের জড়তা উধাও। দু’জন তৈরি হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আশিসও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। মন্দির দর্শনের জন্য তখনও লম্বা লাইন। প্রায় ১১,৮০০ ফুট উচ্চতায় এই মন্দিরের চারদিকে বিস্তৃত উপত্যকা, পেছনে সামান্য দূরেই বরফাবৃত পাহাড় চূড়া থেকে নেমে এসেছে মন্দাকিনী। প্রকৃতির এই আশ্চর্য স্বর্গীয় রূপ দু’চোখ ভরে দেখার আনন্দ ভাষায় বা লেখায় প্রকাশ করা যায় না। শরীর-মন যেন এখানকার আকাশ-বাতাস-প্রকৃতির রূপে আবেশিত। সেই অবস্থাতেই চারিদিকে অনেক ক্ষণ এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। কোথাও জমে থাকা জলের উপর বরফের পাতলা আস্তরণ, কোথাও আবার বরফের গহ্বরের ভিতর থেকে গড়িয়ে আসা ঝরনার ধারা। মন্দাকিনীর পাড় ধরে অনেক দূর চলে গেলাম। বরফাবৃত পাহাড়ের চূড়াগুলি দেখে যত কাছে মনে হয় আসলে অতটা কাছে নয়। সন্ধে হয়ে আসছে তাই ফিরে এলাম। বৃষ্টি কমে গেলেও এ বেলা আকাশ আর পরিষ্কার হল না।

পর দিন ভোর তিনটের সময় উঠে কেদারনাথ বিগ্রহ দর্শনের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম সবাই। পাঁচটায় মন্দির খোলার পর কেদারনাথজির দর্শন হল। আজ আকাশ এক দম পরিষ্কার। মোলায়েম নীল আকাশে সূর্যোদয়ের অপেক্ষা করতে লাগলাম। অবশেষে সূর্যদেব তার করুণ আলোর সোনালি স্পর্শ বরফ শৃঙ্গের চূড়ায় চূড়ায় ছড়িয়ে দিতে লাগল। আমরা সাক্ষী রইলাম সেই স্বর্গীয় ক্ষণের। আরও এক প্রস্থ ঘোরাঘুরি করে ন’টা নাগাদ প্রাতঃরাশ সেরে নিলাম। এ বার ফেরার পালা। কেদারধামের স্বর্গীয় টান কাটিয়ে আসতে মন চাইছিল না, কিন্তু সংসারের মায়ায় আবদ্ধ আমাদের মতো সাংসারিক প্রাণীদের ফিরে না এসে উপায় নেই! বেলা তিনটে নাগাদ গৌরীকুণ্ড পৌঁছলাম। রাতটা ভারত সেবাশ্রমে কাটিয়ে পর দিন ভোরবেলায় জিএমওইউ-এর বাস ধরে বিকেল চারটে নাগাদ হরিদ্বার ফিরে এলাম।

এক কথায়: কেদারনাথ যাত্রার পরম নৈসর্গিক অনুভূতিই শুধু নয়
সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে আধ্যাত্মিক চেতনার অনুরণনও শুনতে পেলাম।

জন্ম, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া— সবই উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি অঞ্চলে। বিগত বেশ কয়েক বছর ‘ভেল’-এর হরিদ্বার শাখায় কর্মরত। অবসর সময় কাটে কবিতা আর ভ্রমণকাহিনি পড়ে। রোজনামচা লেখার অভ্যেসও আছে। বই পড়ার সঙ্গে রয়েছে নতুন নতুন জায়গা, বিশেষত পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর নেশা।
ছবি: লেখক

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ