আপনার কলমে...
১৬ পৌষ ১৪১৮ রবিবার ১ জানুয়ারি ২০১২


সমুদ্রে পাহাড়ে ঘেরা সান ফ্রান্সিসকো

দ্য রেস্টলেস সি
কটু খোলা হাওয়া ম্যাজিকের মতো কাজ করে রোজকার একঘেয়ে রুটিন থেকে পালাতে। ভারত থেকে কেউ যদি ট্রেনে চেপে বেশ কয়েকদিনের জন্য ঘুরতে না যায় আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেউ যদি ড্রাইভ করে কোথাও না ঘোরে তা হলে তাকে সেই আনন্দটুকুর ভাগ দেওয়া অতি বড় পণ্ডিতেরও অসাধ্য। যদিও এই আনন্দ ক্ষণিকের তবু এ যেন পরম পাওয়া। অনেকটা “এসকেপ ফ্রম রিয়্যালিটি”। আমার ছোটবেলার বন্ধুটি যখন তার স্বামীকে নিয়ে ফিনিক্সে এল আমাদের কাছে, তখন আমরা ঠিক করলাম সান ফ্রান্সিসকো যাব, ড্রাইভ করে। ফিনিক্স থেকে সান ফ্রান্সিসকোর দূরত্ব সড়কপথে ৭৫২ মাইল অর্থাৎ ১২১০ কিলোমিটার মত। এটা বেশ ‘লং-ড্রাইভ’ এবং মাঝে মাঝে আমাদের থামতে হবেই। তাই গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে সময় খানিক বেশিই লাগবে। এত সব ভেবেও তৈরি হয়ে গেলাম সান ফ্রান্সিসকো ঘুরতে যাওয়ার জন্য।

সন্ধে সাড়ে ছ’টা। ডিসেম্বর মাসের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে শুরু হল আমাদের যাত্রা। প্যাসিফিক কোস্টের অ্যরিজোনায় শীতকালেই বৃষ্টি হয়। সুতরাং যাত্রা শুরু হল “মাথায় (অঝোর) বৃষ্টি নিয়ে”। অবশ্য পথের ক্লান্তি কেটে গেল সূর্যের আলো ফুটতেই। বিশাল রঙ্গমঞ্চে প্রকৃতি তার রূপের সম্ভার নিয়ে হাজির, সবার মন মাতাতে। মনস্থির করি সকালে ড্রাইভ করেই দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখার। ছবির মত সুন্দর ১৭টি দর্শনস্থল— সান ফ্রান্সিসকোয় “১৭ মাইল ড্রাইভ” নামে পরিচিত। এছাড়া দু -একটি অতিরিক্ত জায়গাও আছে।

সিল রক পিকনিক এরিয়া

হাকেলবেরীর পাইনের সারি

দ্য লোন সাইপ্রাস

পেবেল বিচ
প্রথম দ্রষ্টব্য স্থানটি ঘুরে পাহাড়ি রাস্তার বাঁক ধরে উঠে এলাম। দ্বিতীয় স্থান হাকেলবেরী। বাঁক ঘুরে কিছুটা উঠেই দেখি পাইনের সারির ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে নীল সমুদ্র। আদি অনন্ত রূপ তার— কোথাও সে প্রশান্ত, কোথাও উত্তাল তার জলরাশি। বাকি জায়গা দেখার জন্য নেমে এলাম উতরাইয়ের রাস্তা ধরে। এগুলোর নাম যেমন: দ্য রেস্টলেস সি, পেবেল বিচ, স্প্যানিশ বে, সিল রক পিকনিক এরিয়া (যেখানে সিল মাছেরা এসে বিশ্রাম করে, খেলা করে)। এছাড়া বার্ড রক, সাইপ্রাস পয়েন্ট লুক আউট— যেখান থেকে সারি সারি সাইপ্রাস গাছ দেখা যায়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য “দ্য লোন সাইপ্রাস”। এই স্থানটি একটি সাইপ্রাস গাছকে নিয়ে। গাছটা অদ্ভুতভাবে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে, যেন কোনও বিশেষ বৈশিষ্ট্য বহন করে চলেছে। প্রকৃতি নিজের খেয়ালে এমন অনেক অসাধারণ চিত্রপট সৃষ্টি করেছে।

এরপর আমরা চললাম সেই অনুপম শহর সান ফ্রান্সিসকোর দিকে।

শহরটি এত জাঁকজমকপূর্ণ এবং এত সুন্দর করে সাজানো যে গাড়ির থেকে হেঁটে ঘুরলে বেশি উপভোগ করা যায়। এখানে আছে ঐতিহ্যবাহী ট্রাম যাতে করে চারপাশটা ঘোরা যায়, তাও নামমাত্র খরচে। শহরের সব রাস্তাই পাহাড়ি রাস্তার মত উঁচুনীচু়। অনেক রাস্তা এতটাই চড়াই বা উতরাই যে মনে হচ্ছিল আমরা যেন এক মজাদার রাইড-এ উঠেছি। সন্ধের সান ফ্রান্সিসকোর রূপ তার সকালের রূপের একদম বিপরীত। সকাল কাটে প্রচণ্ড ব্যস্ততায় আর সন্ধেবেলায় শহর মেতে ওঠে ক্যাফের গুঞ্জনে, পাবের হুল্লোড়ে, ঝলমল করা আলো আর সঙ্গীতের তালে। টুইন পিকস থেকে সান ফ্রান্সিসকোর যে মনভোলানো দৃশ্য দেখা যায় তা হয়ত আমাদের মনের ফ্রেমে থাকবে চিরকাল। এখান থেকে দেখা যায় বিখ্যাত গোল্ডেন গেট ব্রিজ, আলকাট্রাজ আইল্যাণ্ড এবং গোটা শহরটাই।

ভিস্তা পয়েন্ট
মুর উডস
এরপর গোল্ডেন গেট ব্রিজ পেরোলাম। আরও এগিয়ে বেশ কিছুটা চড়াইয়ের পর আমাদের গাড়ি থামল ভিস্তা পয়েন্টে।

মুর উডস ন্যাশনাল মনুমেন্টে (ন্যাশনাল পার্ক) সুবিশাল গাছের সারি। প্রায় ১০০০ বছর পুরনো এই অতিকায় বৃক্ষরাজির জন্য দিনের বেলাতেও এই অরণ্যে আলোআঁধারির সৃষ্টি হয়। একটা রোমাঞ্চ লাগে। পার্কে একটি গাছের গুঁড়ি প্রদর্শিত আছে, যার জীবনকাল ৯০৯ থেকে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ । সূর্যের আলো ঠিকমত না পৌঁছনোয় এখানে এতটাই ঠাণ্ডা আর স্যাঁতসেঁতে যে প্রস্তুতি না থাকলে ঠাণ্ডায় বেশ কষ্ট পেতে হত। পার্কের ভেতর দিয়ে একটা ছোট্ট নদী কুলকুল করে বয়ে গেছে। তার জল এতটাই স্বচ্ছ যে প্রতিটি নুড়িপাথর দেখা যাচ্ছিল।

সান ফ্রান্সিসকোর ডাউন টাউন থেকে শুরু করে ক্রুকড স্ট্রিট, ফিসারম্যানস্ ওয়ারফ্ বিখ্যাত ঘিরারডেলি চকোলেট শপ- বাদ পড়েনি কিছুই। এক ফাঁকে ঘুরে নিলাম বেদান্ত সোসাইটিও। সেখানে সবার স্মিত হাসি আর আন্তরিকতা যেন ছুঁয়ে গেল মনকে।

পরদিন ঠিক করলাম ক্যালিফোর্নিয়া ১ হাইওয়ে ধরে লস এঞ্জেলেস হয়ে বাড়ি ফিরব। এই রাস্তা হল পাহাড় আর সমুদ্রের অভূতপূর্ব মিশ্রণ। প্রতি বাঁকে বাঁকে এখানে রোমাঞ্চ। পাহাড়, সমুদ্র, মেঘ, ঝিরঝিরে বৃষ্টির মাঝে মাঝে রোদ্দুর আর তার ফাঁকে আদিগন্ত রামধনু— এ এক মায়াবী পরিবেশ যেখানে প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকছে, কুহকের মত।

সমুদ্র কখনও মেঘাচ্ছন্ন, কখনও বা সূর্যের আলো পড়ে তার রং নীল বা সবুজ। কখনও দিগন্তরেখা উদ্ভাসিত করে ছবির মত দেখা যাচ্ছে রামধনু। কোথাও সমুদ্রের জল আছড়ে পড়ছে সাদা বালির তীরে, কোথাও ধাক্কা মারছে পাথরে। পাহাড়ের ধার দিয়ে আঁকা বাঁকা সরু রাস্তা ধরে কখনও দেখা পাচ্ছি উত্তাল সমুদ্রের, আবার কখনও দেখা মিলছে মেঘে ঢাকা পর্বত শৃঙ্গের। কোথাও গভীর গিরিখাত সাবধান করছে মনকে কোনও অজানা-আসন্ন বিপদ থেকে, আবার পরক্ষণেই মন হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধে। আকাশ কখনও মুখ ভার করেছে, আবার কখনও পাইনের ফাঁক দিয়ে একচিলতে রোদ্দুর এসে পড়েছে আমাদের মুখে— ছুঁয়ে যাচ্ছে আলতো করে আমাদের মন। গাড়িতে তখন বাজছে জন ডেনভারের সেই বিখ্যাত গান “সানসাইন অন মাই সোলডারস মেক মি হ্যাপি, সান সাইন ইন মাই আইস ক্যান মেক মি ক্রাই”।

ক্যালিফোর্নিয়া ১ হাইওয়ে থেকে প্রকৃতি

এক কথায়: এ এক মায়াবী পরিবেশ যেখানে প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকছে, কুহকের মত।

স্বামীর কর্মসূত্রে বেশ কিছুদিন টেক্সাসের হিউস্টনে কাটিয়ে, আপাতত বসবাস বেঙ্গালুরুতে। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও পরবর্তীকালে গণ-সংযোগ নিয়ে পড়াশোনা। বর্তমানে গৃহকর্মেই মনোযোগী।
ছবি: লেখক



রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল স্বাদবদল • আপনার রান্নাঘর • পুরনো সংস্করণ