দুই মহাদেশ জুড়েছে একই শহর |
তাপসী চক্রবর্তী |
কাতার এয়ারওয়েজের বিমান যখন দোহা থেকে উড়াল দিয়ে তুরস্কের মাটি স্পর্শ করল, সেখানে তখন বেলা সাড়ে বারোটা। ঝকঝকে রোদ আর হিমশীতল হাওয়া যৌথ ভাবে স্বাগত জানাল আমাদের।
প্রত্যেক শহরেরই একটা নিজস্ব রং, গন্ধ আর ভাষা থাকে। বিমানবন্দর থেকে হোটেল পৌঁছনোর ফাঁকে ইস্তানবুলের ভাষা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা তৈরি হলেও গন্ধ আর রং নিয়ে কিছু ধোঁয়াশা থেকেই গেল। পাঁচ তারা হোটেলের অভ্যর্থনা ছিল একান্তই তুর্কি কায়দায় ভরপুর— জাতীয় পোশাক পরা সুন্দরীরা হাসি মুখে আপ্যায়ন করলেন আমাদের।
দুপুরে সামান্য কিছু খাওয়াদাওয়া করে সোজা ঘর-লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সময়টার গায়ে অদ্ভুত একটা বিষণ্ণতার চাদর জড়ানো, যা কিনা পরতে পরতে অনুভব করার— ‘কনস্তান্তিনোপল’কে দেখতে দেখতে ঠিক সেটাই মনে হচ্ছিল। কনস্তান্তিনোপল বললাম, কারণ, রোমান সাম্রাজ্য ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে যখন এশিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল, তখন প্রাচ্যে একটা রাজধানীর প্রয়োজন হয়ে পড়ল। সে জন্য এ শহরই তখন হয়ে ওঠে আর এক রাজধানী। কনস্তান্তিনোপল থেকে ইস্তানবুল— পৃথিবীর আর কোনও শহর এত বার নিজের নাম বোঙ হয় পাল্টায়নি। তবে আধুনিক ইস্তানবুলের অন্যতম রূপকার— কামাল আতাতুর্ক।
এক সময় সন্ধে নেমে এল শহর জুড়ে। আর আমরা বেরোলাম প্রমোদতরীতে বসফরাসের বুকে ভেসে বেড়াতে। অদূরেই বসফরাস সেতু। তুরস্কে বসফরাসের আলাদা একটা ভৌগলিক তাত্পর্যও আছে। ভূগোলের চোখে বসফরাস হল একটি ‘প্রণালী’। পূর্বের সি অফ মারমারা আর পশ্চিমের কৃষ্ণসাগরের মধ্যে এই বসফরাসই সংযোগ রক্ষা করে চলেছে সেই কবে থেকে, তার সঙ্গে দু’টি মহাদেশ— ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যেও। চমকে ওঠার মতো তথ্য! একই দেশ তো বটেই, একই শহরের এক দিকে ইউরোপ আর অন্য দিকে এশিয়া— দৈনন্দিন ভাবে মানুষ এশিয়া থেকে ইউরোপ, ইউরোপ থেকে এশিয়া আসছেন ‘বসফরাস ব্রিজ’ পার হয়ে। বসফরাসের বুকে প্রমোদতরীতে সে রাতে আমাদের গাইড ছিলেন তামীর— ছাব্বিশ বছরের ঝকঝকে ‘তরুণ তুর্কী’। ইংরেজি উচ্চারণ প্রায় নিখুঁত। আমি ওঁকে প্রশ্ন করলাম, পৃথিবীর আর কোন কোন দেশ তিনি ঘুরেছেন? ভারতের দিকে এসেছেন কি না? উত্তরে একগাল হেসে তামীর জানালেন, ‘‘তুরস্কের বাইরে কোনও দিকেই যাইনি।’’ তামীরের জন্ম ও বড় হওয়া তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায়। বড় হয়ে পড়াশোনা ও পেশার তাগিদে এখন তিনি ইস্তানবুলের অধিবাসী। ইস্তানবুল কলেজেই পর্যটনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা তাঁর। |
প্রথম দর্শন |
সাফাই করার গাড়ি |
ট্রাম |
|
ক্রুজ দূরে সরে সরে যায়, আমি ‘ডেক’-এ দাঁড়িয়ে অপলকে তাকিয়ে থাকি আলো ঝলমলে ইস্তানবুলের দিকে। মনের ক্যামেরায় গেঁথে রাখছিলাম সে সব মুহূর্ত— বসফরাস সেতু, সাসপেনশন সেতু, গালাটা সেতু, সুলতান মহম্মদ সেতু আর তার রঙের পরিবর্তন— কত আলো দিয়ে যে সাজানো! প্রচণ্ড হাওয়া, শীতার্ত রাতের আকুতি কমাতে সবাই ‘পানীয়’ হাতে মশগুল। ওই পানীয়ে অনভ্যস্ত আমি অগত্যা গরম স্যুপে চুমুক দিলাম। ছেলের কথা খুব মনে পড়ছিল— আর কিছু দিনের মধ্যে সে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হবে। ভবিষ্যতে এ রকমই কোনও বিশাল ও বিলাসবহুল প্রমোদতরীতে হয়তো সাদা ‘ইউনিফর্ম’-এ সেও দাঁড়িয়ে থাকবে অবসর-রাতে ডেকের উপর— আমারই মতন। প্রমোদতরীতে চড়ার এটাই আমাদের প্রথম অভিজ্ঞতা আর সেটা বেশ জাঁকিয়ে বসে গেল মনের মধ্যে। অনেক ভাল লাগা নিয়ে রাত এগারোটায় হোটেল ‘আখগুন ইস্তানবুল’-এ ফিরে এলাম।
পর দিন ঘুম থেকে উঠে খুব অবাক হলাম! দেখলাম,
এত সকালেই সাফাই কর্মীরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন শহর পরিচ্ছন্ন করতে। রাস্তা পরিষ্কার করতে এক অভিনব গাড়ি ব্যবহার করা হয় এখানে— গাড়ির সঙ্গেই ঝাঁটা লাগানো, গাড়ি চললে রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যায়।
আরও অবাক হলাম এখানকার ঝকঝকে ট্রামগুলি রাস্তার পাশ দিয়ে তীব্র গতিতে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে দেখে! ঘড়ির সঙ্গে একেবারে তাল মিলিয়ে। কলকাতার সঙ্গে এ সব কিন্তু একেবারেই মেলে না! |
হায়া সোফিয়ার অনদরমহল
|
ব্লু মস্ক
|
|
আমাদের বাস যখন শহরের রাজপথ হয়ে হায়া সোফিয়ার পাশে এসে দাঁড়াল, তখন অদূরে সি অফ মারমারাকে দিনের আলোয় আরও এক বার দেখলাম। হায়া সোফিয়া মসজিদ না গির্জা— তা নিয়ে সংশয় থাকাটাই স্বাভাবিক! তৈরির পর প্রায় ৯১৬ বছর এটি গির্জা হিসেবেই ছিল। দ্বিতীয় সুলতান মেহমেদের আক্রমণ ও সাম্রাজ্য জয়ের পর রোমান সভ্যতার স্থাপত্য কীর্তির অনন্য এই সৃষ্টিটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়। প্রায় সাড়ে চারশো বছর মসজিদ থাকার পর, ১৯৩৪ সালে, মিউজিয়াম হিসেবে হায়া সোফিয়া দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বিশাল এই মিউজিয়ামের ভিতরের শৈল্পিক কাজ দেখে চোখ ফেরানো দায়। ঝাড়বাতির আলোয় উদ্ভাসিত অন্দর।
হায়া সোফিয়া বা সেন্ট সোফিয়া দেখতে পুরো একটা দিন লাগে। এর বাঁ দিকে আছে ঐতিহ্য সমৃদ্ধ ‘ব্লু মস্ক’। ব্লু মস্কের ভেতরের দেওয়ালে প্রত্যেকটি জায়গায় ইতিহাস যেন জীবন্ত হয়ে রয়েছে ‘অজ্ঞাতকুলশীল’ সব শিল্পীদের অদ্ভুত সুন্দর কারুকীর্তিতে।
সন্ধে নামতেই ইস্তানবুল শহরের সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়। তখন যেন মোহময়ী, রহস্যময়ী বিশেষণগুলি যথার্থ ভাবে প্রয়োগ করা যায় তার রূপের বর্ণনায়। এ দিন সন্ধ্যায় ‘ডিনার’ সেরে আমরা গেলাম তুরস্কের বিখ্যাত ‘বেলি ড্যান্স’ দেখতে। ৫০ লিরা খরচ করে প্রথম শ্রেণির টিকিট কেটে দর্শকাসনের সবচেয়ে ভাল জায়গায় বসলাম। কিছু ক্ষণের মধ্যেই মঞ্চে ‘নর্তকী’দের প্রবেশ। নাচ যদি শিল্প হয়, তবে সেই শিল্পের প্রকৃত মর্যাদা বোধ হয় এই সব শিল্পীদের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। এঁরা ডানসিউজ নর্তকী। অনেকটা আমাদের ইতিহাসের আম্রপালীদের মতন। এই নাচে কিছুটা আরবি ও প্যালেস্তাইনের মিশেলও আছে। যাঁরা নাচলেন, তাঁরা বিভিন্ন দেশ— গ্রিস, বালগেরিয়া, মিশর, আর্মেনিয়া থেকে এসেছেন। নৃত্যানুষ্ঠানের পরে বিপুল খাবারদাবারের আয়োজন। এখানেই দেখলাম দেওয়ালে কোনও এক কবির লেখা কয়েকটি ছত্র, যার বঙ্গানুবাদ করলে মোটামুটি এ রকম দাঁড়ায়— ভুলে যেও না মানুষ, তোমার আয়ু সীমিত, তোমার ইন্দ্রিয় অস্থির, তোমাকে যুদ্ধে যেতে হতে পারে কাল...
পরের দিনের গন্তব্য বসফরাসের পাশে রুমেলি দুর্গ। রুমেলি দুর্গের উপর থেকে বসফরাসের নান্দনিক সৌন্দর্যের বিবরণ দিতে হলে মনের সবটুকু রোমান্স আর আবেগ নিংড়ে বার করে নিয়ে লেখায় তা লগ্নি করতে হবে। মার্ক টোয়েনের লেখায় পড়েছিলাম, কোনও একটা নতুন জায়গায় গিয়ে সেই জায়গার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কথা ভাল ভাবে জানতে হলে, সেখানকার বাজারে ঘুরতে হয় আর সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়। সেই কৌতূহলবশেই সন্ধ্যার পর গ্র্যান্ড বাজারে গেলাম। মনে হল কলকাতার লিন্ডসে স্ট্রিট দিয়ে হাঁটছি। গলিতে গলিতে মানুষের ঢল। ইস্তানবুলের মশলা আর শুকনো ফলের বাজার দুনিয়ার মানুষকে আকৃষ্ট করে। তার সঙ্গে রয়েছে চামড়া, ক্রিস্টাল ও কার্পেটের পশরা। বাজার বেড়িয়ে ইস্তানবুলের বিখ্যাত কাবাবে পেটপুজো সারলাম।
এ তো গেল প্রথাগত বাজারের উপাখ্যান। কিন্তু বর্তমানে যে জিনিসটি প্রায় ওতপ্রোত ভাবে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে তার দেখাও তো পাওয়া দরকার। তাই হাজির হলাম ইস্তানবুল তথা ইউরোপের সর্ববৃহত্ এবং সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শপিং মলে। |
|
শপিং মল থেকে ডলমাবাশে প্যালেস। এই প্রাসাদের ব্যাপকতা যদি এর অহংকারের মুকুটে একটি পালক হয়, তবে এর অভ্যন্তরীন কারুকার্য সে মুকুটের কোহিনুর। সামনের মারমারা সমুদ্র থেকে প্রতিফলিত নীল রং প্রাসাদের গায়ে পড়ে এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ। বেশ মন খারাপ হয়ে গেল শিল্পকে ফ্রেমবন্দি না করতে পারার জন্য!
ইস্তানবুল যে পৃথিবীর অন্যতম সেরা সুন্দর শহর, তা অনেক নামিদামী জনেরা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে অবশ্যই শহরের একমাত্র নোবেলজয়ী লেখক অরহান পামুক— যিনি লিখেছিলেন তুরস্কের ১০ লক্ষ আর্মেনিয়ান ও ৩০ হাজার কুর্দকে হত্যার কাহিনি।
ইস্তানবুল ছাড়ার আগে মন ভারাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। আকাশ আর বসফরাসের নীলে মননকে নীলাম্বরী করে তুলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। আতিথেয়তা মনে হয় এই ইতিহাসসমৃদ্ধ শহরবাসীর মজ্জাগত। বিমানে নির্ধারিত জায়গায় বসে মনে পড়ছিল আমির খসরুর লেখা শব্দ ক’টি— অগর ফিরদৌস বরু-এ জমিন অস্ত, হামিঁ অস্ত, হামিঁ অস্ত, হামিঁ অস্ত— যদি পৃথিবীতে স্বর্গ কোথাও থাকে, তা এখানেই, এখানেই, এখানেই!
|
এক কথায়: ইস্তানবুল ছাড়ার আগে মন চাইছিল
বসফরাসের নীলে মননকে নীলাম্বরী করে তুলতে। |
|
|
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙায় জন্ম, বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা। গোবরডাঙা হিন্দু কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী বর্তমানে কলকাতার বাসিন্দা এবং বারুইপুরের একটি স্কুলের শিক্ষিকা। ফোটোগ্রাফি ও ঘোরাঘুরি ভীষণই পছন্দের। তাই মাঝেমাঝেই বেরিয়ে পড়া সুন্দরের আহ্বানে। |
|
|
|
|
|
|