ইতিহাসের অতি মূল্যবান উপকরণ
শাজাহানের রাজত্বকালের ‘জাহানকোষা’
পশ্চিমবঙ্গের দু’টি বিখ্যাত কামানের নাম সর্বজনবিদিত— বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের দলমাদল এবং মুর্শিদাবাদের জাহানকোষা। প্রথমটি প্রচারের আলোয় অনেকটা বেশি আলোকিত হলেও জাহানকোষার মাহাত্ম্যও কম নয়। ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকায় এটি নির্মিত হয়েছিল। সেই সময় ঢাকার নাম ছিল জাহাঙ্গীর নগর। মুঘল সম্রাট শাজাহানের রাজত্বকালে (১৬২৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দ) বাংলার সুবাদার ছিলেন ইসলাম খাঁ। তাঁর অধীনস্থ দারোগা শের মহম্মদের অধীনে হরবল্লভ দাসের তত্ত্বাবধানে জনার্দন কর্মকার এই বিশাল জাহানকোষা নির্মাণ করেছিলেন।
১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুখসুমাবাদে (বর্তমান মুর্শিদাবাদ) স্থানান্তরিত করার সময় সম্ভবত এই কামানটি নিয়ে আসেন। অপর দিকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দেই রাজা বীর হাম্বিরের রাজত্বকালে জগন্নাথ কর্মকার বানিয়েছিলেন দলমাদল কামান। জাহানকোষার অর্থ হল বিশ্বধ্বংসী বা মতান্তরে বিশ্বজয়ী। দলমাদল শব্দের অর্থ নিয়ে বহু মতান্তর থাকলেও অধিকাংশের মত, এর অর্থ হল শত্রুধ্বংসী। জাহানকোষার দৈর্ঘ্য সাড়ে সতেরো ফুট, যেখানে দলমাদলের দৈর্ঘ্য সাড়ে বারো ফুট। কিন্তু দলমাদলের পরিধি সামান্য বেশি হওয়ায় এর ওজন বেশি— ২৯৬ মন, যেখানে জাহানকোষার ওজন ২১২ মন। দলমাদল মূলত লৌহ নির্মিত হলেও জাহানকোষায় লোহা-সহ আরও সাতটি ধাতু ব্যবহৃত হয়েছিল। জাহানকোষার দু’দিকে তিনটি করে মোট ছ’টি বলয়, সামনে ও পিছনের অংশে সুন্দর অলঙ্করণ চোখে পড়ে। কামানের গায়ে ফার্সি ভাষায় লিখিত মোট ন’টি পিতলের ফলকে কামান নির্মাণের কাহিনি, রাজন্যবর্গের প্রশস্তি বর্ণিত হয়েছে। এতে এক বার গোলা নিক্ষেপ করতে আঠাশ সের বারুদ ব্যবহৃত হত। বর্তমানে কামানটির অবস্থান মুর্শিদাবাদ শহরের গোবরানালার নিকটবর্তী তোপখানা গ্রামে। যে লোহার চাকাযুক্ত গাড়িতে কামানটি স্থাপিত ছিল তা বহু বছর আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এক সময় কামানটিকে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে স্থানান্তরের পরিকল্পনা হয়। বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ কর্তৃক এ কামান সুরক্ষিত। ঐতিহাসিক এই কামানকে কেন্দ্র করে এলাকায় পর্যটন শিল্পের প্রসারে সরকার নজর দিক, জেলাবাসীরূপে এই আমাদের একান্ত প্রার্থনা।
সায়ন্তন মজুমদার। বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ

রেভারেন্ড জেমস উইলিয়মসন-এর সমাধি
শ্রীরামপুর মিশন ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বীরভূম জেলায় ব্যাপটিস্ট মিশনের কাজ শুরু করে। বীরভূম জেলায় ব্যাপটিস্ট মিশনের প্রধান দফতর ছিল সিউড়িতে। রেভারেন্ড জেমস উইলিয়মসন ছিলেন প্রথম দিকের মিশনারি। তিনি ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে শল্যচিকিৎসক হিসাবে ভারতবর্ষে আসেন। কলকাতায় আসার কিছু কাল পর উইলিয়ম কেরি এবং মার্শম্যান শ্রীরামপুর মিশন থেকে তাঁকে সিউড়িতে পাঠান। তিনি ছিলেন সিউড়ি জেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন। সঙ্গে ছিল মিশনের কাজ।
W. Adam-এর ‘Report on Vernacular Education in 1837’ থেকে আমরা জানতে পারি যে, সেই সময় এই জেলায় দু’টি ইংরেজি স্কুল ছিল। একটি স্কুল উইলিয়মসন চালাতেন সিউড়ি শহরে। আর একটি স্কুল ছিল রায়পুরের বিখ্যাত সিংহ পরিবারের পারিবারিক স্কুল। দু’টির মধ্যে উইলিয়মসনের স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম। তিনি ও তাঁর স্ত্রী সিউড়ি এবং পাশ্ববর্তী অঞ্চলে শিক্ষাদানের মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও প্রসারের উদ্যোগী হন। তিনি যে ইংরেজি স্কুলটি চালাতেন, সেখানে প্রতি দিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষাদান করতেন।
এর আগে মিসেস উইলিয়মসন একটি বালিকা বিদ্যালয় চালাতেন। কিন্তু ১৮৩৪ সালের অক্টোবর মাসে এক ছাত্রী খিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হলে এবং আরও দু’জন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে ইচ্ছাপ্রকাশ করলে স্কুলটি কার্যত ভেঙে যায়। ওই সময়েই মিশনারি দ্বারা পরিচালিত বালকদের বাংলা স্কুলটিও একই কারণে ভেঙে যায়। দু’টি স্কুলের অল্পসংখ্যক ছাত্র এবং ছাত্রী নিয়ে একটি স্কুল করা হয়।
উইলিয়মসন এবং তাঁর সহধর্মিণী ছিলেন বীরভূম জেলায় আধুনিক শিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষা এবং ইংরেজি শিক্ষার পথিকৃৎ। শোনা যায়, তিনি উচ্চ মানসিকতার মানুষ ছিলেন। প্রায় সারা জীবন তিনি সিউড়িতে অতিবাহিত করেন, ৭৪ বছর ৬ মাস বয়সে এখানেই তাঁর জীবনাবসান হয়। তাঁর নামে সিউড়ি শহরে এখনও একটা রাস্তা আছে। সিউড়ি বড়বাগান অঞ্চলে ইংরেজদের সমাধিক্ষেত্রে অত্যন্ত অবহেলার মধ্যে জীর্ণ অবস্থায় এখনও টিকে আছে তাঁর সমাধিটি। এটি ইতিহাসের অতি মূল্যবান উপকরণ। এটির পাশেই আর একটি সমাধি রয়েছে। আকৃতি ও আয়তন হুবহু এক। কিন্তু তার ফলকটি উধাও। খুব সম্ভবত এটি উইলিয়মসনের সহধর্মিণীর সমাধি।
সিউড়ি শহরে খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘুদের মধ্যেও সংখ্যালঘু। সংখ্যা অত্যন্ত কম। গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কম হলে রাজনীতিবিদরা তাঁদের গ্রাহ্যের মধ্যে আনেন না। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পরিচালনাধীন প্রাচীন এই সমাধিক্ষেত্রটি থেকে ইতিহাসের মূল্যবান উপাদানগুলি দ্রুত লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এগুলিকে অবিলম্বে সংরক্ষণ করার জন্য আবেদন জানাই।
সুকুমার সিংহ। লালকুঠিপাড়া, সিউড়ি, বীরভূম

ধ্বংসের প্রহর গুনছে সাহিত্যিক শৈলজানন্দের জন্মভিটে
মোরব্বার শহর নামে এক ডাকে চেনেন না এমন মানুষ নেই। জেলা সদর বলে অতি পরিচিত জায়গাটির নাম সিউড়ি। বীরভূমের এই সিউড়ি সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের জন্মভিটে। অনাদরে পড়ে স্রষ্টার স্মৃতিবিজড়িত নিজস্ব ভবনটি এখন ভগ্নপ্রায়। নিজের চোখে দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। ক্ষণিকের জন্য হলেও ‘কয়লাকুঠি’ উপন্যাসখ্যাত সাহিত্যিকের গ্রামে গিয়ে সরেজমিন পরিদর্শনের পর আমার মূল্যায়ন: ‘নিজভূমে পরবাসী শৈলজা’। রূপসপুর গ্রামে ঢোকার মুখে রয়েছে তাঁর এক সবুজ রঙের আবক্ষ মূর্তি এবং চোখে চশমার ফ্রেম। প্রায় দেড় বিঘার কাছাকাছি জন্মভিটে সংলগ্ন জমি পড়ে রয়েছে। সঙ্গে একটা ছোট্ট পুকুর।
এমন ছবির মতো গ্রামে তাঁর স্মৃতি রক্ষা করতে প্রশাসনিক স্তরে তেমন কোনও উদ্যোগ নজরে পড়ল না। তাঁর বউদি অসুস্থতার মধ্যেও এই ভিটে আগলে রেখেছেন। একমাত্র ছেলে ও বউমা এবং নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে এই গ্রামে বসবাস করছেন তিনি। ভগ্নপ্রায় বাড়ির গায়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসাবে গড়েছেন একতলা পাকা বাড়ি। সরু মোরাম রাস্তা পাশ দিয়ে গেছে বারাবোনা গ্রামে। অথচ পাকা রাস্তা গড়ার কথা ছিল জন্মভিটে পর্যন্ত। হেরিটেজ তকমাও জোটেনি।
এই জেলার পশ্চিম প্রান্তে দুবরাজপুর ব্লক থেকে চণ্ডীপুরের গৌর বাগদি সরণি সেতু পেরিয়ে সারিবাগান মোড় ছুঁয়ে সড়কপথে গোপালপুর যেতে হয়। মোটরসাইকেলে কমপক্ষে এক ঘণ্টা। লোকাল বাসে আরও বেশি সময় লাগে। বাস থেকে তিন মাথার মোড়ে নেমে সোজা উত্তরে লাল মোরাম রাস্তা ধরে সাড়ে তিন মাইল দূরত্ব। রূপসপুর গ্রামে ঢোকার মুখে ডান হাতে এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা রয়েছে। লাল মোরামের রাস্তা পাকা করে গড়ে তোলার জন্য এক দশক আগের পূর্ব প্রতিশ্রুতি রয়েই গেছে। ওই সাহিত্যিকের স্মৃতি বলতে সবেধন নীলমণি শৈলজানন্দ স্মৃতি পাঠাগার। সাহিত্যিকের বংশধর রতন মুখোপাধ্যায় জানালেন, বাবা নিখিলানন্দের হাতে গড়া পাঠাগারের কাহিনি।
দাদুর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আবেদন-নিবেদনে সীমাবদ্ধ রয়ে যেতে হয়েছে। এ-নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে কোনও রকম সাহায্য পাওয়া যায়নি। বহু কাঠখড় পোড়ানো সত্ত্বেও স্মৃতি অমলিন রয়ে গেছে তাঁর। সশরীরে হাজির হয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্য মন্ত্রিসভার বর্ষীয়ান এক সদস্য। গ্রামবাসীদের আজও তা বেশ মনে পড়ে। মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর সঙ্গে সে দিন নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় হাজির ছিলেন। তাঁদের বলে যাওয়া কথা আঁকড়ে রয়েছেন ভক্তরা।
শুভদ্যুতি দত্ত। রামনাথপুর, হুগলি
 
শীতের আমেজ...

  • উলুবেড়িয়ায় শীতের ভোরে রসের সন্ধান।

  • শীতের ওমের অপেক্ষায়, রামপুরহাটে।

  • বিক্রির পথে। দুবরাজপুরের লোবায়।

  • বালিঘাইতে মাঠে চলছে শীতের সব্জি চাষ।

  • কুয়াশাঘন ভোরে বকদের উড়ান।

  • রস-কেলি... কৃষ্ণনগরের ছবি।

  • শিলিগুড়িতে বিকোচ্ছে শীতের পোশাক।

  • আসছে বড়দিন। পসরা শিলিগুড়িতে।

  • শীতের সকালে আহার সংগ্রহ করতে ব্যস্ত কপোতের দল।

  • রসের খোঁজে।

—নিজস্ব চিত্র

পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে ইতিমধ্যেই পস্তাচ্ছি আমরা। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফল হাতেনাতে পেয়েও টনক নড়ে ক’জনের?
ব্যাতিক্রম অবশ্য আছে। আর সেই ব্যাতিক্রমী মানুষদের প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ করি আমরা। তাঁদের দলবদ্ধ অথবা ব্যক্তিগত
উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে পাঠক সমক্ষে নিয়ে আসার পরিকল্পনার শরিক হতে চাইলে আমাদের জানান নীচের ঠিকানায়

সংবাদের হাওয়াবদল
হাওয়াবদল
আনন্দবাজার পত্রিকা, ইন্টারনেট সংস্করণ
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট
কলকাতা ৭০০০০১

ই-মেল করুন haoabadal@abp.in অথবা haoabadal@gmail.com
 
রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদলআপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ