১৪ অগ্রহায়ণ ১৪১৮ বৃহস্পতিবার ১ ডিসেম্বর ২০১১


 
লাল মাটির দেশে
কামারপাড়া
বোলপুরের কাছাকাছি ভুবনডাঙা গ্রামের নিসর্গ প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ দেবেন্দ্রনাথ কিনে ফেলেছিলেন জায়গাটি। পরে রবীন্দ্রনাথও তার প্রেমে পড়ে যান,প্রতিষ্ঠা করেন ‘শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্য আশ্রম’। উদ্দেশ্য প্রকৃতির সঙ্গে মানব মনের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা। শতবর্ষ পরে শান্তিনিকেতন আজ আর গ্রাম নেই, ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গল মাত্র। কিন্তু তারই কিছুটা দূরে কামারপাড়া গ্রামে গেলে এখনও দেখতে পাওয়া যায় নিটোল গ্রামের ছবি।

সময় তখন বেলা বারোটা কুড়ি। বোলপুর শান্তিনিকেতন স্টেশনে এসে থামল শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস। জনতার ঢলের সঙ্গে পা বাড়ালাম স্টেশন চত্বরের বাইরে রিকশাস্ট্যান্ডের দিকে। শীতকাল বলেই বোধ হয়, অন্যান্য সময়ের থেকে ভীড়টা এখন একটু বেশিই। অটোওয়ালা, রিকশাওয়ালা, হোটেলের দালাল— সবার চিৎকার-চেঁচামেচি আর ধাক্কাধাক্কি এড়িয়ে কোনওক্রমে এসে পৌঁছলাম ‘কার পার্কিং জোনে’। আগে থেকে জানানো ছিল, তাই সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে গাড়ি।

গাড়িতে উঠে শুরু হল আমাদের যাত্রা, তবে শান্তিনিকেতনের দিকে নয়, আমরা যাব বোলপুর থেকে দশ কিলোমিটার দূরে কামারপাড়া গ্রামে। অদ্বৈত লজের পাশ দিয়ে কবি জয়দেব রোড ধরে আঁকাবাঁকা পথে ছুটতে লাগল আমাদের দুধ সাদা অ্যামবাসাডর। কিছু ক্ষণ পর রাস্তা এসে পড়ল ফাঁকা মাঠের মধ্যে। এত ক্ষণ ছিলাম শহরের ভেতর। দু’পাশে বাড়ি, ঘর, হোটেল, দোকানের পরিচিত দৃশ্য। আর এ বার দু’ধারে দিগন্ত বিস্তৃত ধু ধু মাঠ। হঠাৎ বদলে যাওয়া দৃশ্যপট।

মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জয়দেবের নামাঙ্কিত এই রাস্তা শেষ হয়েছে অজয় নদের তীরে কবির ভিটে কেঁদুলি পর্যন্ত গিয়ে। রাস্তাটা এখন বেশ ফাঁকা। তবে পৌষ সংক্রান্তিতে জয়দেবের মেলা হয় কেঁদুলিতে, তখন প্রচুর বাস, ট্রেকার ইত্যাদি চলাচল করে এখান দিয়ে। আমরা অবশ্য কেঁদুলি পর্যন্তও যাব না। তার অনেক আগেই কামারপাড়া বাজার পর্যন্ত গিয়ে বাঁ দিকে গ্রামের রাস্তায় ঢুকে গেল আমাদের গাড়ি।
বড় রাস্তা থেকে হাঁটাপথে ৭-৮ মিনিট, গাড়িতে আরও কম। বীরভূমের লালমাটির রাস্তা ধরে আমরা পৌঁছালাম ‘অনেক আকাশ’-এ। কলকাতার বাসিন্দা উদয়শঙ্কর হাজরা বছর বারো আগে বীরভূমের এই কামারপাড়া গ্রামে খানিকটা জমি কিনে ছুটি কাটাবার ‘জায়গা’ হিসাবে একটা ‘বাড়ি’ করবার মনস্থ করেছিলেন। গ্রামের দিকে সস্তায় জমি কিনে বাড়ি করা কোনও নতুন ঘটনা নয়, বহু লোকেই তা করে। আবার তা যদি শান্তিনিকেতনের মতো পর্যটন কেন্দ্রের কাছে হয়, তা হলে তো কথাই নেই! কিন্তু উদয়বাবু ভাবছিলেন অন্য কথা। কামারপাড়া গ্রামটি শান্তিনিকেতনের কাছে হলেও শহুরে হাওয়া তার গায়ে তখনও খুব একটা লাগেনি। পাকা বাড়ির সংখ্যা খুবই কম। গ্রামজোড়া মাটির বাড়ির পাশে আরও একটি মাটির বাড়ি তৈরি করানোর কথা মাথায় এল তাঁর। কিন্তু নামে মাটির বাড়ি হলেও তৈরি করা বা তার কারিগর পাওয়াটা খুব একটা সহজ নয়। লোক অবশ্য পাওয়া গেল। বাসুদেব বর নামে স্থানীয় এক কাঠ মিস্ত্রি হদিশ দিলেন মাটির বাড়ি তৈরির মালমশলা আর দক্ষ কারিগরের। তৈরি হল উদয় হাজরার সাধের মাটির বাড়ি ‘অনেক আকাশ’।

পরে উদয়বাবু আরও দু’খানি মাটির বাড়ি তৈরি করিয়েছেন এরই পাশে। মাটির দেওয়াল আর খড়ের চালার দোতলা মাঠকোঠা বাড়ি। দেওয়াল মাটির হলেও বাড়িগুলি বিশাল জমির উপর একতলা এবং টিনের চালা যুক্ত। গেট খুলে প্রথমেই চোখে পড়বে নানা রকম ছোট ছোট গাছ। ডাইনে খাবার ঘর, একতলা খড়ের চালা। তার পর আরও একটা দরজা পেরিয়ে মূল বাড়ি।

আমরা এসে উঠলাম ‘অনেক আকাশ’-এ। চটপট স্নান খাওয়া সেরে গাড়ি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম শান্তিনিকেতনের উদ্দেশে। কামারপাড়া থেকে বিশ্বভারতী চত্বরের দূরত্বও প্রায় দশ কিলোমিটারের মতো। প্রথমেই গেলাম উত্তরায়ণে। প্রদর্শশালা দেখার পর উত্তরায়ণের অন্যান্য বাড়িগুলি আবার এক বার দেখা হল। এর আগে শান্তিনিকেতন অনেক বারই এসেছি। প্রত্যেক বারই আসি উত্তরায়ণে। কিন্তু সে দেখা কখনওই পুরনো হয় না। প্রতি বারই যেন নতুন করে দেখি ‘কোনার্ক’, ‘উদিচী’, ‘পুনশ্চ’, ‘শ্যামলী’র বাড়িগুলি।
খোয়াই কোপাই
উত্তরায়ণ পর্ব শেষ করে চললাম কোপাই নদীর দিকে। ক্ষীণকায় এই নদী বর্ষাকালে স্রোতস্বিনী হয় বটে, তবে এখন প্রায় জলহীন। নদীর ধারে এক বাউল সশিষ্য (অনুরাগীও হতে পারে) বসে সংগীতচর্চায় নিমগ্ন। আমরা আবার গাড়িতে উঠে বসলাম।

গাড়ি ছুটল ফিরতি পথে। হঠাত্ই আমাদের সারথি বাসুদেববাবু (ইনিই ‘অনেক আকাশ’ বাড়ির ঠিকাদার। ঠিকাদারির পাশাপাশি গাড়িও চালান) মূল রাস্তা চেড়ে একটা ছোট মেঠো পথে গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন। জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, ‘‘চলুন, আপনাদের আরও একটা মাটির বাড়ি দেখাই।’’ গাড়ি এসে থামল দারুণ সুন্দর এক বাড়ির সামনে। গৃহস্বামী বাসুদেবের পরিচিত। ‘অনেক আকাশ’-এর মতো এই বাড়িটিও বাসুদেববাবুরই ‘তৈরি’। কলকাতার ব্যবসায়ী দম্পতি বিশ্বজিৎ ও কলিকা দত্তর বাড়ি এটি। আমাদের বাসস্থান ‘অনেক আকাশ’-এর মতোই মাটির দোতলা মাঠকোঠা বাড়ি এটি। তবে চালা খড়ের নয় টিনের। সদরের থাম থেকে পুরো বাড়ির দেওয়াল সুন্দর ভাবে চিত্রিত। সামনের বাগানে রয়েছে একটি তুলসীমঞ্চ। হঠাৎ মাটির বাড়ি করবার শখ হল কেন? কলিকাদেবী জানালেন, ‘‘ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের মাটির বাড়ি ‘শ্যামলী’র কথা শুনেছিলাম। পরে শান্তিনিকেতনে এসে ‘শ্যামলী’ দেখে অভিভূত হয়ে যাই। তখন থেকেই মনে সাধ ছিল, যদি কখনও এখানে বাড়ি করবার সুযোগ হয় তবে মাটির বাড়িই করব। যখন এখানে আমাদের জমি কেনা হল তখন ছোটবেলার ইচ্ছাপূরণের তাগিদেই এই মাটির বাড়ি তৈরি করা।’’
ইচ্ছে থাকলেও বেশি ক্ষণ আর থাকা গেল না সেখানে। আরও এক জায়গায় যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। রোদ্দুর থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়াই ভাল। এ বার আমাদের গাড়ি ছুটল খোয়াইয়ের দিকে। ক্ষীণকায় পরিত্যক্ত এক নদীখাত বরাবর সৃষ্ট প্রকৃতির এই আশ্চর্য ‘ভাস্কর্য’ যাঁরা শান্তিনিকেতন গেছেন তাঁরা অবশ্যই দেখেছেন। এখানে স্থাপিত হয়েছে ‘প্রকৃতি ভবন’। সামনের মাঠে রয়েছে তারই বিজ্ঞপ্তি—
‘‘প্রকৃতি ভবন/ প্রকৃতির ভাস্কর্যের সংগ্রহশালা প্রকৃতির হাতে গড়া নগণ্য জিনিষের ভিতর অনন্যের সন্ধানই হল প্রকৃতি ভবনের দর্শন এই দর্শনের দৃষ্টি দিয়েই প্রকৃতি ভাস্কর্যের খোঁজ। প্রকৃতি ভবনের প্রদর্শনী দেখে বলেছেন: শ্রী সত্যজিত্ রায়, ‘‘একটা সম্পূর্ণ নতুন জিনিস, দারুন ভালো লাগলো’’
শ্রী মৃণাল সেন, ‘‘Natures Music caught in perfect Rythem’’
এই রাঙা মাটির পথ ধরে আর কিছুটা এগোলেই ডান দিকে পাবেন প্রকৃতি ভবন এখানে গড়ে উঠেছে একটি উন্মুক্ত প্রকৃতির ভাস্কর্যের উদ্যান এবং সংগ্রহশালা। সবার আমন্ত্রণ, প্রবেশ অবাধ।’’

সন্ধে হয়ে আসছে তাই এ যাত্রায় খোয়াই দর্শন আমাদের আর সম্পূর্ণ হল না। ডুবন্ত সূর্যের কয়েকটা ছবি তুলে যাত্রা করলাম ফিরতি পথে। গাড়ি ফিরে চলল কামারপাড়ার দিকে। মেলার মাঠ ছেড়ে, ভুবনডাঙা পেরিয়ে আমরা মোড় নিলাম ডান দিকে। জামবনি পর্যন্ত রাস্তায় আলো রয়েছে। তার পর থেকে একেবারে অন্ধকার। শুধুমাত্র বড় গাড়ির হেডলাইটের আলো, সাইকেল বা পথচারীদের তাও নেই। কিন্তু ওই অন্ধকারের মধ্যেই বহু মানুষের আনাগোনা লক্ষ করা গেল পুরো রাস্তাটা ধরে। অবশেষে পৌঁছালাম ‘অনেক আকাশ’-এ।

কামারপাড়া গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে তাই আমাদের ঘরগুলো অন্ধকার নয়। কিন্তু আলো ছাড়া আর কিছুই নেই। ঘরে টেলিভিশন নেই, আমরা কেউ সঙ্গে করে একটা রেডিও-ও নিয়ে আসিনি। অগত্যা গল্পই সম্বল। আমাদের সঙ্গী অমিত আসবার সময়ে তাঁর বেহালাটা এনেছিল। সময় কাটাতে সে বেহালা খুলে আরম্ভ করল বাজনা, সেই সঙ্গে আমাদের বেসুরো গলায় রবীন্দ্রনাথের গান। এখন কোনও গানই আমরা পুরো গাইতে পারি না। কোনওটা অর্ধেক, কোনওটা আবার তারও কম! তবু সময়তো কাটছে, মন্দ কী!

খানিক পরে ঘরে এলেন আমাদের ‘কেয়ারটেকার’ লালদাস বৈরাগ্য। চা-মুড়ি-তেলেভাজা খাওয়ার সঙ্গে চলতে লাগল গল্প। কথায় কথায় জানা গেল, লাল একসময়ে যাত্রাদলে গানবাজনা করতেন। এখন সময়াভাবে যাত্রা করেন না বটে তবে গানবাজনার চর্চাটা তাঁর এখনও আছে। আমরা চেপে ধরলাম গান শোনানোর জন্য। বিকেলে মেলার রাস্তা থেকে অমিত একটা বাঁশি কিনে এনেছিল। সেটা দেওয়া হল লালকে। দীর্ঘ দিনের অনভ্যাস সত্বেও লালা খানিকটা বাঁশি বাজালেন। তার পর আরম্ভ হল গান। লালদাস বৈরাগ্যরা উত্তরাধিকার সূত্রে বৈষ্ণব। বাড়িতে এখনও নামগান হয়। সেই সব গানই তিনি গাইতে লাগলেন একের পর এক। আমাদের শহুরে মানসিকতা আর সাংস্কৃতিক চেতনায় সাধারণ ভাবে সে সব গান হয়তো খুব উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। কিন্তু চারিদিকে ধু ধু অন্ধকার আর ওই মাটির বাড়ির মধ্যে লালদাস যেন আমাদের এক অনির্বচনীয় আনন্দ দান করলেন সে দিন।

পরের দিন খুব সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেলেও বিছানা ছাড়লাম একটু দেরি করেই। প্রথমেই এক প্রস্ত চা, তার পর, গরম লুচি, তরকারি খেয়ে বেরোলাম এলাকাটা ঘুরে দেখতে। কামারপাড়ার পাশের গ্রাম দ্বারন্দার খ্যাতি ‘বন লক্ষী’ রিসর্টের জন্য। কিন্তু চাষপ্রধান এই গ্রামটি রাতারাতি শিরোনামে চলে এসেছে নাটকের জন্য। গ্রামেরই ছেলে পার্থ বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবন থেকে নাটক নিয়ে স্নাতক হয়েছেন। তিনি নিজের গ্রামের খেতমজুর ও স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে ‘ব্লসম থিয়েটার’ নামে একটা নাটকের দলই খুলে ফেলেছেন।

একদা দক্ষিণবঙ্গের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ‘ধর্মঠাকুর’ বা ‘ধরমঠাকুর’-এর পুজোর প্রচলন ছিল। একান্তই লৌকিক এই দেবতা পরবর্তীকালে আর্য সংস্কৃতির চাপে খানিকটা কোণঠাসা হয়ে পড়লেও এখনও গ্রামাঞ্চলের অনেক জায়গাতেই এই লৌকিক দেবতার পুজোর প্রচলন রয়েছে। এই লৌকিক দেবতা ‘ধর্মঠাকুর’ ও আর এক লৌকিক দেবী ‘মনসা’র গান ব্যবহার এক সময়ে লোকনাট্য প্রযোজনা করেছে ওই ‘ব্লসম থিয়েটার’। ‘রাজার ছেলে’ নামে ওই নাটক প্রদর্শন করে দর্শকদের বাহবা পেয়েছে এই দল। আমরা আলাপ করলাম পার্থ আর তার কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে। সন্ধের মুখে ফিরে এলাম কামারপাড়ায়। এ বার গোছগাছের পালা। কাল সকালেই তো আবার আমাদের যাত্রা ফিরতি পথে।
ছবি: লেখক



রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ