বড়দিনের সিডনি একই রকম রঙিন বর্ষবরণেও |
স্বাগতা সরকার |
নতুন বছরকে বরণ করতে আলোকোজ্জ্বল সিডনিকে কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখেছিলাম টিভি চ্যানেলগুলোর দৌলতে। বিশ্বের প্রায় সব মেট্রো শহরগুলির আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ছবি দেখতে দেখতে ইচ্ছে জেগেছিল, সিডনিতে থেকেই যদি এই বর্ষবরণের উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারতাম! সে তো আগের বছরের কথা। কিন্তু মনের আশা মিটিয়ে পরের বছরেই যে আমরা সিডনির নাগরিকদের সঙ্গে নতুন বছরকে আহ্বান জানাতে পারব, তা তখন কে জানত!
গত বছরখানেক ধরে আমরা সিডনিতে রয়েছি। স্বামীর কর্মসূত্রেই এ দেশে আসা। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বিচার করলে, বিশ্বের মধ্যে অপেক্ষাকৃত নতুন এই দেশ এবং তার বন্দর শহর। ১৭৮৮-র জানুয়ারি, ১১টি জাহাজ ভরে ক্যাপ্টেন আর্থার ফিলিপের নেতৃত্বে ‘বটানি বে’তে এসে পৌঁছাল হাজারখানেক ‘সেটলার’। তাদের মধ্যে ৭৭৮ জন আবার ‘অপরাধী’। ব্রিটেন থেকে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৭৮৭-র ১৩ মে। নেহাতই সাদামাটা সেই যাত্রা শেষ পর্যন্ত বেশ বর্ণময় হয়ে উঠেছিল। ‘বটানি বে’তে নামার প্রায় দিন তিনেক পর এই ‘নৌ-যাত্রী’রা অপেক্ষাকৃত ভাল একটি জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যায় তাদের ‘গৃহস্থালী’। জায়গাটির নাম পোর্ট জ্যাকসন। সেখানেই ‘সিডনি’ নামের এক ছোট উপসাগরের পাড়েই গড়ে ওঠে নতুন ‘বসতি’, দিনটি ছিল ২৬ জানুয়ারি, ১৭৮৮। এই দিনটিই পরে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দিবস ‘অস্ট্রেলিয়া ডে’ হিসেবে পালিত হয়। সে বছরের ফেব্রুয়ারিতেই ফিলিপকে সিডনির গভর্নর ঘোষণা করা হয়। তখন এ দেশে বসবাস ছিল সভ্যতার আলো থেকে বহু দূরে থাকা বিক্ষিপ্ত কিছু আদিবাসী মানুষের। সিডনির উত্তরণের সেই শুরু। |
|
‘সিডনি হারবার ব্রিজ’ ও ‘অপেরা হাউস’। |
শহরের প্রাণকেন্দ্র সিবিডি বা ‘সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট’এ থাকার সুবাদে এখনকার সিডনির নাগরিক-বাণিজ্যিক-পর্যটনকেন্দ্রিক জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে, এই ক’দিনে। অদ্ভুত বৈচিত্র্যে ভরা এই শহর ও তার মানুষজন। পৃথিবীর নানা জায়গার মানুষের ভিড়ে সিডনি আজ যথার্থই ‘কসমোপলিটন’। ‘সিডনিসাইডার’ ও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ‘সিটি অফ সিডনি’ (স্থানীয় পুরসভা) সারা বছরই কিছু না কিছু উৎসবের আয়োজন করে থাকে। আমাদের বর্তমান আস্তানার ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই সব রঙিন উৎসবের আগাম আভাস পেয়ে যাই, সামনের রাস্তায় পাল্টাতে থাকা ‘ব্যানার’গুলো দেখে। আর ‘ব্যানার’ দেখে উৎসাহ বোধ করলে, সেখানে দেওয়া ওই সংক্রান্ত ওয়েবসাইটের ঠিকানা থেকে বিস্তারিত জেনে নেওয়াও সম্ভব।
এখানে উৎসব মানচিত্রে সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশটির নাম বড়দিন। আর একটু বিস্তারিত বললে, ইংরেজি বছর শেষ ও শুরুর সময়টাই এখানে উল্লেখযোগ্য ভাবে আয়োজনমুখর। ডিসেম্বর আর জানুয়ারি, এই দু’মাস এখানে জমিয়ে উপভোগ করার সময়, আর বেড়ানোর আদর্শ সময়ও কিন্তু এটাই। পুজোর মরসুম শেষ হতে মন জুড়ে থাকে শুধুই বড়দিনের অপেক্ষা। সামনেই ‘গরমের অবকাশ’। শহরের সুদৃশ্য মলগুলিতে উপহার কেনার ভিড়। সব মিলিয়ে চার দিকে কেমন ছুটির মেজাজ।
ডিসেম্বরের গোড়া থেকেই জায়গায় জায়গায় শুরু হয়ে যায় ক্রিসমাস পালনের ‘ধুম’। বিভিন্ন অফিস-দোকানগুলো তখন ‘ক্রিসমাস ট্রি’ ও অন্যান্য সাজে অনেক বেশি উজ্জ্বল ও রঙিন। ছোটদের জন্যও থাকে দেদার মজার আয়োজন। শপিংমলগুলোতে সান্টার মায়াবী রাজ্যে উপস্থিত থাকে স্বয়ং সান্টা। স্বপ্নের জগৎ থেকে নেমে আসা উপহারের ডালি নিয়ে সে আমাদেরই অপেক্ষায়। আর ঠিক এই সময় থেকেই শুরু হয়ে যায় সরকারি ভাবে ‘সিটি অফ সিডনি’র ক্রিসমাস উৎসব। উদ্বোধনের অনুষ্ঠানের জন্য বাছা হয়, আড্ডার কেন্দ্রস্থল ‘মার্টিন প্লেস’ আর সবুজের আতিশয্যে ভরা ‘হাইড পার্ক’কে। সে দিন শহরের ‘লর্ড মেয়র’-এর উপস্থিতিতে দু’টি জায়গাতেই বিশালাকার দু’টি ‘ক্রিসমাস ট্রি’ আনুষ্ঠানিক ভাবে উন্মোচিত হয়। সঙ্গে ছিল ছোটদের বিনোদনের জন্য একগুচ্ছ অনুষ্ঠান, ‘ক্রিসমাস ক্যারোল’ ও সব শেষে শহরের বহুতলগুলির ছাদ থেকে আকাশের গায়ে ছড়িয়ে দেওয়া আতসবাজির আলোকোজ্জ্বল কারুকাজ। বাবা-মায়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া কচিকাঁচাদের মুখে তখন হাজার ঝাড়বাতির আলো। এ বার সিডনি সিবিডি-র ‘ডার্লিং হারবার’ ও ‘ককোল বে’র পালা। এই দু’টি জায়গাই ‘অপেরা হাউস’, ‘হারবার ব্রিজ’, ‘সিডনি টাওয়ার’-এর মতোই আকর্ষনীয়।
|
|
|
শপিং মলে সান্টা। |
ক্রিসমাস ক্যারোল। |
|
সে দিন যদিও অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা সন্ধে আটটা-সাড়ে আটটা নাগাদ, তবুও ‘সিডনি সাইডার’ ও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড়টা জমতে শুরু করল বিকেল থেকেই। অনেকেই পিকনিক বাস্কেট-সহ গুছিয়ে বসে পড়লেন। চার দিকে বড়দিনের গন্ধ যেন ম...ম করছে। কোথাও সান্টার টুপি, কোথাও ‘রেইনডিয়ার’-এর ‘অ্যান্টেলার’, আবার কোথাও সান্টার পুরো ‘স্যুট’টাই বিকোচ্ছে। আর আছে হাওয়া ভরা সান্টাদের অভিবাদন। ‘ককোল বে’র সামনে অর্ধগোলাকার জায়গা জোড়া সিঁড়িগুলিতে তখন অগণিত মানুষের মাথা। অস্ট্রেলিয়ায় এই সময়টায় গরম কাল হলেও বাতাসে বসন্তের ছোঁয়া। হঠাৎই ঘোষণায় শোনা গেল, “আমাদের সকলের প্রিয় সান্টা এখন হারবার বে-তে আসছে।” জলের ধারের আলোগুলো নিভে গেল। আবহে তখন ‘ক্রিসমাস ক্যারোল’। দর্শককে হতচকিত করে দু’প্রান্তের গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে স্পিড বোটে চেপে হঠাৎ হাজির দু’জন সান্টা। পুরো এলাকাটা উল্লাসে ফেটে পড়ল। চোখের পলক ফেলার আগেই স্পিড বোটে ‘উড়ে’ উপস্থিত আরও অনেক সান্টা। তারা আমাদের দেখাচ্ছে নানা রকম কেরামতি। অভূতপূর্ব অনুভূতি।
|
|
‘ককোল-বে’ তে ক্রিসমাসের
আগে আতসবাজির প্রদর্শনী। |
এর পর সেই বহু প্রতিক্ষীত আতসবাজির সমারোহ দেখার পালা। সান্টাদের স্পিড বোট থেকেই তার সূত্রপাত। তার পরেই এক বার ‘ককোল বে’র মাঝখানের বার্জগুলো থেকে, পর মুহূর্তেই স্পিড বোটগুলো থেকে যথাক্রমে উৎক্ষেপিত আলোকের সেই ঝর্নাধারায় মুগ্ধ আমরা যেন কোনও এক ‘জাদুনগরী’র বাসিন্দায় পরিণত হয়েছি। বিস্ময়ের বোধহয় আরও বাকি ছিল। শেষ আলোর বিন্দুটি আমাদের পিঠ ছুঁয়ে উপর দিকে উঠে যেতেই হঠাৎ ঝলমলিয়ে তার উপস্থিতির জানান দিল এত ক্ষণ উপেক্ষিত বিশালাকৃতির ‘ক্রিসমাস ট্রি’। আবার ‘নগরবাসী’র সমবেত উচ্ছাসে মুখরিত ‘ডার্লিং হারবার’।
এ বার ‘ককোল-বে’র আধখানা চাঁদের মতো অঞ্চল জুড়ে ‘ক্রিসমাস প্যারেড’-এর তোড়জোড়। একে একে সেখানে হাজির ছোটদের ব্যান্ড আর উৎসাহী সান্টাদের বড় একটা দল। আমরা সবাই তখন ‘উত্তর মেরু’র সান্টাদের সঙ্গে করমর্দনে ব্যস্ত। ‘ক্রিসমাস ট্রি’র নীচে জমায়েত ছোটদের ব্যান্ডগুলোর একত্রিত অনুষ্ঠান দিয়েই বিশেষ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি যখন ঘোষিত হল, তখন মনের ভেতর অদ্ভুত এক উত্তেজনার পেন্ডুলাম দুলেই চলেছে। এ পাশ থেকে ও পাশ, আবার ও পাশ থেকে এ পাশ। আনন্দের দুলুনি যেন থামতেই চায় না। পর দিন সাতসকালে সান্টাদের চার কিলোমিটার দৌড় দেখার প্রতীক্ষা নিয়েই ভিড় ঠেলে আমরা এ বার বাড়িমুখো। |
|
সান্টাদের ম্যারাথন দৌড়। |
পর দিন রবিবার। সকালে পৌঁছাতে মিনিট দশেক দেরি-ই হল। গিয়ে তো চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। ছোট-বড় কয়েক হাজার লাল পিঁপড়ের লম্বা সারি। মনে একটু আশা তখনও ঘোরাফেরা করছে। যদিও পর মুহূর্তেই সেটা আফশোষে পরিণত হল, কেন না দেরির ফলে আমাদের লাল পিঁপড়ে মানে সান্টা হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। তবে টিম ‘সিডনি সাইডার’-এর ‘স্পিরিট’ দেখে আমরা তত ক্ষণে অভিভূত। স্বনামধন্য দলগুলির সুরেলা ও ছন্দোবদ্ধ উপস্থাপনায় সকলেই আমরা মুগ্ধ।
|
ক্রিসমাসের আলোয়
সেন্ট মেরিস ক্যাথিড্রাল। |
|
বিপণীর জানলায়
জানলায় পুতুলের মেলা। |
‘ককোল-বে’তে ডিসেম্বর মাস জুড়ে সপ্তাহ শেষের দিনগুলিতে অর্থাৎ বৃহস্পতিবার থেকে রবিবার ছিল ‘ক্রিসমাস ক্যারোল’। তাই পরের শনিবার আমরা আলো-ধ্বনির বর্ণময় উপস্থাপন দেখতে পৌঁছে গেলাম ঐতিহাসিক সেন্ট মেরিস ক্যাথিড্রালে। যাওয়ার পথে বিশাল বিপণী ‘ডেভিড জোল’। একশো বছরেরও পুরনো অভিজাত এই বিপণীটির জানলায় জানলায় সে দিন পুতুলের মেলা। তবে তা মোটেই বিক্রির জন্য নয়, খ্রিস্টের জন্মোৎসব উপলক্ষে বিশেষ এই প্রদর্শনী। এ সব দেখে কোনও রকমে মন সামলালাম। নিজের সংগ্রহে যদি এমন সুন্দর পুতুল থাকত!
হাইড পার্ক পেরিয়ে আমরা তত ক্ষণে আবার ক্যাথিড্রালের পথে। মানুষের ভিড়ে রাত সাড়ে ন’টাকেও যেন সন্ধের শুরু বলে মনে করাচ্ছে। হাতে হাতে বিলি হচ্ছে ‘এনার্জি অস্ট্রেলিয়া’র দেওয়া আঙুলের মাপের টর্চ। প্রজেক্টরের মাধ্যমে ক্যাথিড্রালের উপরে আলো-ছায়ার খেলায় তৈরি হয়েছে তত ক্ষণে অপূর্ব এক দৃশ্যপট। এ কোনও প্রচলিত আলোক সজ্জা নয়। অথচ কেমন কেমন ভাবে ক্যাথিড্রালের গায়ে বলা হতে থাকে ‘চার ঋতুর আসা যাওয়া’র গল্প। সঙ্গে ঋতু ভিত্তিক আবহসঙ্গীত। দশ মিনিটের ব্যবধানে চলতে থাকে এই ‘মায়ার খেলা’র প্রদর্শন।
এ সব দেখতে দেখতে ‘বড়দিন’ এসে গেল। সিবিডি-র রাস্তায় এখন অফিস যাওয়ার ভিড় নেই বললেই চলে। যাদের একান্তই আসতে হয়েছে তাদেরও রয়েছে সকাল সকাল বাড়ি ফেরবার তাড়া। উদ্দেশ্য সেই একটাই, পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হয়ে উৎসবে অংশ নেওয়া। ধর্মে যাঁদের ‘মতি’ আছে, তাঁরা মধ্যরাতে গির্জায় পৌঁছে যান ‘মিডনাইট মাস’-এর বিশেষ প্রার্থনা সভায়। ‘ক্রিসমাস ইভ’, এই দিনে কিছু পর্যটক ছাড়া শহর প্রায় জনশূন্য। বেলা যত বাড়তে থাকে গির্জার ভিড়ও কমতে থাকে। বড়দিনের পর দিন ‘বক্সিং ডে’। সে উপলক্ষে দোকানে দোকানে দিনভর বিশেষ ‘সেল’। এটাও যেন এক ধরনের উৎসব। ছোট-বড় বিপণীগুলিতে ‘সেল’ উপলক্ষে মানুষের ভিড়, আর সেই ভিড় সামলানোর জন্য রাস্তায় পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মীদের উপস্থিতিকে ‘বিপুল তরঙ্গ’ বলা যেতে পারে।
‘ক্রিসমাস ডে’র রাত কাটতে না-কাটতেই সিবিডির রাস্তায় রাস্তায় ‘সিটি অফ সিডনি’র ‘হ্যাপি ক্রিসমাস’ ‘ব্যানার’ পাল্টে গেল। সব জায়গায় নতুন আহ্বান, ‘নিউ ইয়ার্স ইভ’। সিডনিবাসীকে বছরের সেই প্রথম দিনের, প্রথম মুহূর্তের ‘সাক্ষী’ হওয়ার এমন সাদর আমন্ত্রণ মনে আবার খুশির ঝলকানি আনে। নানা জায়গাতেই বিলি করা হচ্ছে এই সংক্রান্ত তথ্যে ভরা ‘প্যামফ্লেট’। ওই মাহেন্দ্র ক্ষণে বিশেষ আলোর রোশনাই দেখার হাতছানি নিয়ে ক’দিন কীভাবে যেন কেটে গেল! মনে মনে এ ক’দিনে ‘সিডনি হারবার ব্রিজ’এ সেই বিশেষ প্রদর্শনী দেখার প্রস্তুতি নিয়েছি। ‘সিডনি হারবার ব্রিজ’ ছাড়াও বে-অঞ্চলের সাত-আট জায়গায় সমান্তরাল ভাবে এই প্রদর্শনী হয়। শুনেছিলাম, নববর্ষ বরণের সময়ে আশপাশের এলাকা ও শহরতলী থেকে প্রচুর মানুষ এখানে আসেন। মানচিত্র দেখে আমরা ‘রয়্যাল বটানিক গার্ডেন’-এর ‘মিসেস ম্যাকুয়ারিস চেয়ার’ সংলগ্ন জায়গাটাকেই বেছে নিলাম, প্রদর্শনী দেখার জন্য। |
|
‘রয়্যাল বটানিক গার্ডেন’। |
নির্দিষ্ট দিনে ‘পিকনিক বক্স’ সঙ্গে নিয়ে যখন ‘মিসেস ম্যাকুয়ারিস চেয়ার’-এ পৌঁছালাম, বাইরে তখন দীর্ঘ লাইন। সাপের মতো এঁকেবেঁকে লাইন ধরে ভেতরে ঢোকার সময় খেয়াল করলাম, সকাল পেরিয়ে কখন যেন দুপুরও গড়িয়ে গেছে খানিকটা। ‘নন অ্যালকোহলিক জোন’-এ কোনও রকমে বসার জন্য একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে ‘সেই সময়ের’ প্রতীক্ষায় বসে রইলাম।
উপস্থিত জনতা তখন মহাসমারোহে পান-ভোজনে ব্যস্ত। চার দিকে পুলিশ আর নিরাপত্তারক্ষীদের কড়া প্রহরা। বিকেলে ‘এয়ার শো’ দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হল। অস্ট্রেলিয়ার আদি বাসিন্দারা তার পর বিশেষ মন্ত্রোচ্চারণ, ধোঁয়া-ধুনো-সহ নাচ, এ সবের মাধ্যমে তাদের মতো করেই এক প্রস্থ বিদায় ও বরণের আবহ তৈরি করলেন। সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে উদয় হল অসংখ্য বাদুড়। পরে বুঝলাম এদের বাসস্থান আসলে এই ‘রয়্যাল বটানিক গার্ডেন’ ও সংলগ্ন অঞ্চল।
অনুষ্ঠান সূচিতে আছে, রাত ৯টায় ‘ফ্যামিলি পাওয়ার ওয়াকর্স ডিসপ্লে’। তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া শেষ করে আমরাও তৈরি। ঘড়ির কাঁটা ৯টা ছুঁতে না-ছুঁতেই ঝলসে উঠল ‘হারবার ব্রিজ’। চারদিকে হর্ষধ্বনী। অতি পরিচিত ‘সেতু’টিকে আজ এক্কেবারে অন্য রকম লাগছে, অগুণতি রঙের ধাঁধাঁয়। দশ মিনিটের সেই প্রদর্শনীর শেষে সবাই আবার আড্ডায় মশগুল। আর মাত্র তিন ঘন্টার অপেক্ষা! তার মধ্যে ৫৫টি সুসজ্জিত জলযানে ১৫ কিলোমিটার জুড়ে ‘হারবার অফ লাইট প্যারেড’। এই অপূর্ব শোভাযাত্রা দেখে অনেকটা সময় কেটে গেল যেন কোথা থেকে, বুঝতেই পারলাম না। যদিও ৯টার পর থেকে প্রতি ঘন্টার ‘কাউন্ট ডাউন’ শুরু হয়ে গেছে। রাত ১১টার পর থেকে সেটা প্রতি পনেরো মিনিটে নেমে এসেছে। |
|
নতুন বছরের শুভ কামনা ও অভিবাদন জানাতে আলোর রোশনাই। |
বা...রো...টা। বহু প্রতিক্ষীত সময় এ বার যেন আছড়ে পড়ল। প্রথমে ব্রিজের উপর থেকে, তার পর সাতটি বহুতল বাড়ির ছাদ ও সাতটি বার্জ থেকে উদ্ভাসিত লাল-নীল-হলুদ-সবুজের বন্যায় সিডনির আকাশ জ্বলজ্বলে। ২০১১ কে স্বাগত জানাতে উল্লাসে, আনন্দে, উচ্ছাসে মাতোয়ারা সমবেত মানুষ। এ সবের মাঝেই ছিল আবহসঙ্গীতের আয়োজন। তবে সেটি শুনতে ‘টিউন ইন’ করতে হল একটি বিশেষ এফএম চ্যানেলে। ১২ মিনিট ধরে চলল সেই বর্ণময় ‘চলচ্চিত্র’। কখনও তা নীল নক্ষত্র, কখনও রক্তিম হৃদয়, আবার কখনও পুরো হারবার সেতুটিই হয়ে উঠল আস্ত একটা জলপ্রপাত। বিরল এই মুহূর্তগুলির সাক্ষী রইল উপস্থিত নাগরিকগণ, আর একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সরাসরি সম্প্রচারের দৌলতে সারা বিশ্ববাসী।
এক সময় স্তিমিত হয়ে এল আলোর রোশনাই। নতুন বছরের শুভ কামনা ও অভিবাদন জানাতে সক্কলে ব্যস্ত তখনও। সেতুর পাশের একটি ‘ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে’তে ফুটে উঠছে ‘সিটি অফ সিডনি’র তরফ থেকে বিভিন্ন ভাষায় নব বর্ষের সাদর সম্ভাষণ। আনন্দের তখনও বাকি ছিল বোধহয়! কেন না হঠাৎই আমাকে চমকে দিয়ে সেই ‘ডিসপ্লে’তে ভেসে উঠল যে হিন্দি ভাষায় ‘শুভেচ্ছা’।
শেষ গানের রেশ মনে-প্রাণে নিয়ে পা বাড়ালাম এ বার নতুন বছরের ‘পথে’। সামনেই, ‘সিডনি ফেস্টিভ্যাল’ যে!
|
|
এক কথায়: আলোর বন্যায় ভেসে উত্সবকে অন্তর দিয়ে স্পর্শ
করার এমন পরিবেশ ও মানুষ সিডনি ছাড়া অন্য কোথাও মেলে না! |
|
|
|
স্বামীর কর্মসূত্রে দেশবিদেশের বিভিন্ন শহর ঘুরে আপাতত সিডনিতেই থিতু। লেখালিখির বিশেষ অভ্যেস নেই, এই লেখাটিকেই প্রথম চেষ্টা বলা যেতে পারে। অবসর সময় কাটে চার বছরের মেয়ের সঙ্গে খেলে, গান শুনে আর বই পড়ে। |
|
|
ছবি: লেখক
|
|
|
|
|
রোজের আনন্দবাজার • এ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ |
|