১৬ শ্রাবণ ১৪১৮ সোমবার ১ অগস্ট ২০১১



 
নাগ পঞ্চমীতে সাপের মেলা
সাপের দেবী মনসাকে নিয়ে যত গান আছে, আর কোনও দেবীকে বা তার বাহনকে নিয়ে বোধ হয় তা নেই। সাপের আছে বিষ, কাজেই সাপে ভয় আছে, সাপ নিয়ে কিংবদন্তীও রয়েছে অসংখ্য। যদিও সব সাপের বিষ নেই। সব সাপ করে নাকো ফোঁসফাঁস। আর সাপ নিয়ে ‘মনসা মেলা’ বাংলার গ্রামে গঞ্জে তো অঢেল। নাগপঞ্চমী শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণ পঞ্চমী অর্থাৎ পূর্ণিমার পরে যে কৃষ্ণপক্ষ তার পঞ্চম দিন। নাগপঞ্চমীতে মনসাপুজোর রেওয়াজ আছে গোটা ভারতে। অনন্ত নাগ, বাসুকি নাগ, শঙ্খ নাগ, পদ্ম নাগ এমন সব কত কত লায়েক সর্পদেবদেবীর পুজো করা হয় এ দিন। ঘরের মূল প্রবেশ পথের দু’পাশে মনসা ডাল (সিজও বলে) ভেঙে এনে রাখা হয়। ক্যাকটাস জাতীয় গাছ। এর সঙ্গে কিন্তু সাপের কোনও সম্পর্ক নেই। গ্রীষ্মের প্রখরতা যত বাড়ে, সাপের বিষও তত বাড়ে। অম্বুবাচীর দিন থেকে সাপের বিষ কমে। অম্বুবাচীতে বৃষ্টি হবেই, এমন এক লোক-প্রত্যাশা থাকে গ্রামীন জীবনে। বর্ষায় সাপ বেশি বের হয় বলেই এ সময় এই নাগ পুজো। অনন্তদেবের ‘স্মৃতি কৌস্তভ’ গ্রন্থে দাক্ষিণাত্যে অগ্রহায়ণের শুক্লা পঞ্চমীতে নাগ পুজো প্রসিদ্ধ। আবার রাঢ়বঙ্গের বেশ কিছু অঞ্চলে ভাদ্র মাসে গ্রামকে গ্রাম যে অরন্ধন করে (আগের দিনের রান্না পরের দিন খায়, ওই দিন উনুন জ্বলে না) তাকেও মনসা পুজো অরন্ধন বলে। সাপ আর লোকাচার মনসামঙ্গল থেকেই প্রচলিত। তবে অনেকাংশে সহজ করে নেওয়া হয়েছে।

ঘটে বসো গো মা, পদুমা (পদ্মের ওপরে) কুমারি
তোমারই স্মরণ লয়ে আনতে যাব বারি।
ছোট বড় গুণিন মাগো বন্দিলাম চরণ
তার আগে বন্দি মাগো তোমার এ চরণ॥


মানে, গুরু বন্দনা, দেবী বন্দনা করে মনসা ঘটে জল ভরা হয়। আশপাশের কোনও পবিত্র জলাশয়কে বেছে নেওয়া হয় এই কাজের জন্য। জলাশয়ের দু’পাড়ে দু’দল সাপুড়ে ঢাক বাজায়। এক পক্ষের সাপুড়েরা ঘট মাথায় নিয়ে জলে ডুব দিয়ে পাড়ে ওঠার আগে অন্য পক্ষ প্রশ্ন করবে ‘সাকি।’

বিষ্ণুপুর
মল্লরাজার দেশ বিষ্ণুপুর। দিনের বেলায় পোড়া মন্দির দেখে, দুপুরে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে, বিকেলে অবশ্য গন্তব্য মল্লরাজদরবার। মেলা শুরু হয় বিকেল থেকে। তার আগে, ইচ্ছে হলে এই শহরের ভিতরে যে বিভিন্ন পাড়ার নির্দিষ্ট স্থল থেকে সাপুড়েরা আসেন, সেখানেও যেতে পারেন উৎসবের প্রস্তুতিপর্ব দেখতে।

কমে গেছে সাপ এবং সাপুড়ে, তাতে অবিশ্যি মেলার জৌলুস কমেনি। কমেনি জমায়েতও। সাপের গান এবং ‘সাকি’, প্রশ্নোত্তর পর্বও হয়। এক দশক আগেও দেখা যেত অসংখ্য ‘চৌড়ল’। গরুর গাড়ির উপর মাটির বাঘ। তার পিঠে পট্টবস্ত্র পরে সাপুড়ে বা গুণিন। হাতে থাকে ফনা তোলা একটি জ্যান্ত সাপ।

সারবন্দি হয়ে চলছে গাড়ি, চৌড়ল, সাপ ও গুণিন। পেছন পেছন দর্শক। গন্তব্য ওই রাজ-দরবারের মাঠ। রাজা এসে দেখা দিতেন, দেখতেন প্রজা ও গুণিনদের। বাহবা দিতেন এবং নগদ মূল্যে খুশিও করতেন। প্রথাটা এখনও রয়েছে। তৎকালীন রাজপরিবারের বর্তমান বংশধর সলিলবাবু, পেশায় স্কুল শিক্ষক।

রাজ-দরবারের মাঠে ঢোকার আগে বিশাল সিংহদুয়ার। ১৬৫৬-এ স্থাপিত কালাচাঁদ মন্দিরের উপরের তবকে ঝামাপাথরে খোদাই করা সাপ সত্যিই নয়নাভিরাম!

চাকদহ
শিয়ালদহ থেকে চাকদহ, খুব বেশি হলে দেড়ঘন্টা। স্টেশনের পাশে প্রফুল্ল ও বাসুদেব সাহার ‘জয় মা তারা হোটেল’এ পেট ভরে ডাল-ভাত-ঝুরো আলু ভাজা-মাছ-সব্জি-চাটনি খেয়ে রওনা দিন খেদাইতলার উদ্দেশে। বাস পেলে ভাল, না পেলে ভ্যান রিক্সা আছে।

খেদাইতলা গ্রামের ছোট্ট মনসা মন্দির। এক দশকের পুরনো। বড় মনসাপুকুরের শান বাঁধানো ঘাট। বাঁধানো হয়েছে মাত্র আধ দশক হল। শ্রাবণ সংক্রান্তির সকাল থেকেই এখানে শুরু হয় মেলা। সাপুড়েরা ভোর ভোর চলে আসে। মানুষ স্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিয়ে সাপুড়েদের সাপের পেঁড়িতে পয়সা দেয়। পেঁড়ি হল বাঁশের ছিলা দিয়ে তৈরি ছোট বড় বাক্স, যাতে সাপ রাখা হয়। ভক্তরা অনেকে এ দিন ছোট ছোট মনসাদেবীর মূর্তি নিয়ে আসে। মেলার দক্ষিণ দিকে সাপুড়েরা গান করে। দেখা যায় সাপ হাতে নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে। এরা সাপুড়ে সম্প্রদায়ের শেষ (বোধহয়) প্রজন্ম।

খুব সেজেছে এই আট-সকালে বিশ্বাসপাড়ার মনসা। পরনে ছাপা রঙিন শাড়ি। হাতে চওড়া চুড়ি। খোপার চারিদিকে মোড় মেরেছে ফিতে। ওর পেঁড়িতে কালনাগিনী। সাপের পেঁড়িতে দক্ষিণা দিলাম। শুধালাম, কালনাগিনী কোথায় পেলে? অনেক দিন পরে দেখছি। ও বলল, “আপনি সাপ চেনেন?” বললাম সামান্য। তবে কালনাগিনী একবার যে দেখেছে সে ভুলবে না। এত রূপবতী সাপ! সারা গায়ে পাতাবাহারের মতন অসংখ্য রঙিন ছিটে। মনসার পাশে দাঁড়ানো কিশোর বলল, “খুউব বিষ কালনাগিনীর। লক্ষীন্দরকে কেটেছিল।” তা তো ঠিকই।

কথিত আছে কালনাগিনীর বিষ ‘দেব-উপহার’। লক্ষীন্দরের জন্য তার প্রয়োগ ছিল নির্দ্ধারিত। তীব্র বিষ। লক্ষীন্দরকে দংশনের পরে বেহুলার অভিশাপে তার বিষ প্রয়োগের ক্ষমতা শেষ হয়। এর সঙ্গে আছে আরও একটি লোক-কল্পনা তা এই সাপের লেজটি নিয়ে। সাপ বুড়ো হলে তার লেজ ভোঁতা হয়ে যায়। কিন্তু কালনাগিনীর জন্ম থেকে ভোঁতা লেজ। কারণ? দংশনের পরে লক্ষীন্দরের চিৎকারে বেহুলা জেগে উঠে বুঝতে পারে বিধিলিপির সত্যতা। জাঁতি ছুঁড়ে মারায় কালনাগিনীর লেজ খসে পড়ে।

বাংলাদেশের অনেকানেক মানুষের বসত এখানে। যেমন সত্তর ছুই ছুই পূর্ণেন্দু বিশ্বাস। খুলনার কাকদী গ্রামের মানুষা। বললেন, “আমার ফেলে আসা বসতের ছাগলদা নদীর তীরে মনসা মেলা বসত। লাখ লোক আসত। সেখানে মনসা মেলার স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল।” বাহান্ন বছরের পঞ্চেশ্বর মজুমদার যুক্ত মেলা কমিটির সঙ্গে। ইনি বরিশাল জেলার গাজিয়া গ্রামের মানুষ। দেশ ভাগে সব ছেড়ে এখানে।

চাকদহর মেলা সেরে দুপুর নাগাদ পৌঁছে যাওয়া যায় বেথুয়াডহরির ব্রহ্মণীতলার সাপের মেলায়। গ্রামের নামও ব্রহ্মণীতলা। বেথুয়াডহরি রেল স্টেশন থেকে সামান্য পথ। খুব প্রাচীন মেলা, তবে এখন সাপ-সাপুড়ে প্রায় নেই।

পলাশি যুদ্ধের কিছু আগে পশ্চিম রাজপুতনা থেকে বারওয়ার জেলার রামরাম সিংহ-সহ বহু মানুষ নদিয়া জেলার নাকাশিপাড়ায় বসত গড়ে। এই বংশেরই ডোমনবাবু ব্রহ্মণী পুজো শুরু করেন। এখন সবাই কৃষ্ণনগরে থাকলেও, পুজোর দিন নিশ্চিত আসেন এখানে।
মেলাস্থলের শরিকী সংগ্রাম, বেদখল হয়ে যাওয়া জায়গার কারণে মেলার স্থান সঙ্কুচিত হয়েছে। কিন্তু তার গ্রামীণ সুগন্ধ আছে এখনও। মেলার চরিত্রে নাগরদোলা থেকে নাড়ু, কাঠি ভাজা থেকে কাঠের আসবাব, কৃষিযন্ত্র থেকে কাটারি, হাতা-খুন্তি-কড়াই-রান্না ঘরের সরঞ্জাম আর মেলার জিলিপি পাঁপড়, সঙ্গে অবিশ্যি মেলার ধুলো পাওয়া যাবে না। অশ্বত্থ গাছের শান বাঁধানো গোলাকার স্থানটি ঘিরেই মেলার ভিড়। মেলায় আসে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই।

বিষ্ণুপুরের ছবি: শুভ্র মিত্র
চাকদহর ছবি: অশোককুমার কুন্ডু



রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ