২৯ শ্রাবণ ১৪১৮ সোমবার ১৫ অগস্ট ২০১১



 
মার্জার-প্রহরী আর কাঁচা মাছের সৈকতে
শুধু রাজনীতি নিয়ে থেকো না। মাছের জগৎটাও একটু ঘুরে দেখো!
বিধানসভা ভোট উপলক্ষে কেরল-যাত্রার আগে পরামর্শ দিয়েছিলেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরুণ প্রজন্মের এক বন্ধু। বলাই বাহুল্য, তিনি নিজে অত্যন্ত ভোজন-রসিক।

মাথায় ছিল, আগের বার কোভালামের ভাজা চিংড়িতে অভিভূত হয়েছিলাম। সেই কাহিনি পাঠকের দরবারে পেশ করাও হয়ে গিয়েছে। এ বার ঠিক করলাম, মাছের জগৎকে কিঞ্চিৎ বিস্তৃত করে দেখতে হবে! তার জন্য মোক্ষম জায়গা যে ফোর্ট কোচির সৈকত হতে পারে, তা অবশ্য ধারণা ছিল না!
মৎস্যজগতে ঢোকার পরামর্শ দেওয়ার জন্য সিপিএমের সেই দিল্লির বন্ধুকে ধন্যবাদ দিতেই হবে, তেমনই ফোর্ট কোচির মাছ-সংসারের অভিজ্ঞতার জন্য রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ এ বিজয়রাঘবনকে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হচ্ছে। দক্ষিণী ছবির জগৎ এমনিতেই খুব চাঙ্গা। কেরল জুড়ে একটা মালয়ালম ছবির পোস্টার সেই সময় ছেয়ে ফেলেছিল, ‘উরুমি দ্য বয় হু ওয়ান্টেড টু কিল ভাস্কো ডা গামা’। পতুর্গিজ ভূ-পর্যটক ভাস্কো ডা-গামা যে কোঝিকোডে নৌ-বহর নিয়ে নেমেছিলেন, এই ইতিহাস সকলেরই জানা। জানা ছিল না যে, স্থানীয় রাজার সঙ্গে টানাপোড়েনের জেরে ডা-গামা ফিরে যাওয়ার সময় ১২ জন স্থানীয় মৎস্যজীবীকে জোর করে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেই বিবাদের কথাই উরুমি নামক তরুণকে নাকি দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করত। এই গল্পটা বলেছিলেন বিজয়রাঘবন আর একই সঙ্গে জানিয়েছিলেন, কেরল সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক পিনারাই বিজয়ন তখন কোঝিকোডে। মৌলবাদীদের সঙ্গে সিপিএমের ‘সমঝোতা’র অভিযোগ নিয়ে বাজার তখন সরগরম। বিজয়রাঘবন পরামর্শ দিলেন, ডা-গামার স্মৃতিবিজড়িত শহরে ঘুরে এলে ওই সংক্রান্ত ভাল কিছু খবর মিলতে পারে, বিজয়নের বাণী পাওয়া যেতে পারে আর সঙ্গে অবশ্যই মাছের সুস্বাদু ডিশ-সংবলিত রেস্তোরাঁর সন্ধান মিলতে পারে!

এই যোগসূত্রেই কোঝিকোডে যাওয়া এবং ‘কারিমীন’ ডিশের সঙ্গে পরিচয়। কাজের ফাঁকে দুপুরের খাওয়া সারতে রেস্তোরাঁয় থেমেছিলাম। রেস্তোরাঁরই সুপারিশ ছিল ‘কারিমীন’। সঙ্গে সাগ্রহ সমর্থন গাড়ির চালকের। চেখে দেখলাম, দিব্যি! স্বভাবসিদ্ধ অনুসন্ধিৎসায় একটু খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, মাছটির ভাল নাম ‘পার্ল স্পট ফিশ’। গায়ে মুক্তোর দানার মতো দাগ থেকেই ওই নাম। মালয়ালিরা ডাকেন ‘কারিমীন’ নামে। এবং ওই মাছ থেকেই কেরলে অন্তত ৫০ রকমের ডিশ হয়! রেস্তোরাঁ থেকেই জানা গেল, জল থেকে উঠে থালায় স্থান পাওয়ার ব্যাপারে কেরলে ‘কারিমীন’ই এক নম্বরে।

বেরিয়ে আসার সময় হঠাৎই মনে হল, জ্যান্ত মাছগুলো এক বার চাক্ষুষ দেখতে পেলে কেমন হত? রেঁধে দিলে ‘কারিমীন’ই হোক আর মীন-কারি, বহিরাগতের কাছে সবই তো এক! রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষই বাতলে দিলেন, ফোর্ট কোচি সংলগ্ন সৈকতে গেলে কাঁচা মাছের কিছু অনবদ্য সম্ভারের দেখা মিলতে পারে। ঠিক করলাম কোচি ফিরে হানা দেব ওই সৈকতে। পরের দিন আলপ্পুরার হরিপ্পাডে সনিয়া গাঁধীর সভা এবং আলপ্পুরা শহরের কাছে ফিরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ভি এস অচ্যুতানন্দনের দেশের ভিটে-দর্শন সেরে বিকালে কোচি ফেরত এবং তৎক্ষণাৎ ফোর্ট কোচি যাওয়ার সিদ্ধান্ত। ভেবে দেখলাম, সন্ধ্যার পরে কোচি শহরের হোটেলে ফিরে কপি পাঠানোর সুযোগ পাওয়া যাবে। কিন্তু অন্ধকার নেমে গেলে মৎস্যদেবতা যদি অন্তর্হিত হন!

কোচি শহর আসলে এর্নাকুলাম। যেখানে রেল স্টেশন। শহরের অন্যতম প্রধান রাস্তা ডি এইচ রোড থেকেই ফোর্ট কোচির অটো মেলে। মূল শহরের ভূখণ্ড থেকে জায়গাটা অবশ্য বেশ দূর। সমুদ্রের ধারে এক সময়ে দুর্গ ছিল। এখন দুর্গের ভগ্নাবশেষ আছে। তার গা বেয়েই সমুদ্র এবং সৈকত। পৌঁছে দেখলাম, এটা সাবেক সৈকত নয়। রীতিমতো পাড় বাঁধানো রাস্তা আছে সমুদ্রের ধার বেয়ে। তার বাঁ দিকে ফোর্ট কোচি, ডান দিকে সমুদ্র। অল্প দূরত্বেই যে হেতু কোচি বন্দর এবং শিপইয়ার্ড, মাস্তুলওয়ালা বড় বড় জাহাজ অহরহ এগিয়ে চলেছে সেই দিকে। এখানে সৈকতের বালুকায় নেমে হাঁটার কিছু নেই। ওই বাঁধানো ওয়াক-ওয়ে’র উপরেই বসার বেঞ্চ করা আছে। আর রাস্তায় উঠেই ডান দিকে কাঁচা মাছের ভিড়।
মাছে ঢোকার আগে আর একটা তথ্য জানিয়ে রাখা যাক। ফোর্ট কোচির ওই সৈকতে দেখার মতো আর একটা জিনিস আছে। চাইনিজ ফিশিং নেট। সমুদ্রের ধারে পাটাতনের সঙ্গে লাগানো ওই অদ্ভুত দর্শন নেট জলযানের সহায়তা ছাড়াই জলের অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সকালের দিকে গেলে তাতে হাতে-কলমে মাছ ধরার প্রকৌশল দেখার সুযোগ মিলতে পারে।

সৈকতের উপরে স্রেফ সামিয়ানা টাঙিয়ে মাছের দোকান। বস্তুত, বিপণিতে কোনও বিশেষত্বই নেই। যে কোনও বাজারে মাছের স্টল ওই রকমই হয়। বিশেষত্ব তার পণ্যে। চেনা চেনা চেহারার এক ধরনের কৃষ্ণবর্ণ মাছ মিলবে। নাম? ব্ল্যাক পমফ্রেট। মালয়ালম ভাষায় যাকে ‘আভোলি’ বলে। সিলভার পমফ্রেটও পাওয়া যায় তবে কম। স্থানীয়েরা তাকে ‘বেলুথা আভোলি’ বলেন। কালো পমফ্রেট ভাজা ওখানকার রেস্তোরাঁতেও চেনা পদ। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি চোখে পড়ার মতো কিম্ভূতকিমার্কার কিছু মাছ ফোর্ট কোচিতে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল! একেবারে হাঙরের মতো দেখতে এক ধরনের দশাসই মাছ! আবার ওই রকমেরই চেহারা, সঙ্গে সূচালো মুখের আর এক ধরনের মাছ! দেখেই প্রশ্ন জাগছিল, এ রকম দৈত্যাকার মাছ মানুষে খায়? দোকানিরা জানালেন, খায়! রেঁধে দিলে নাকি তারিফ করতে হয়!
বিরাট চেহারার প্রথম মাছটার নাম ‘ব্ল্যাক টিপ শার্ক’। তারই আর একটা প্রজাতি ‘স্পেডনোজ্ শার্ক’। দু’টোকেই স্থানীয় ভাষায় ‘স্রাভু’ বলে। ভয়-ধরানো চেহারার আর একটি মাছ মেলে ‘ব্ল্যাক টিপ সি ক্যাটফিশ’। মালয়ালমে ‘এট্টা’। এ ছাড়াও, ‘সিয়ার ফিশ’ নামে এক ধরনের মাছ ওখানে বিখ্যাত। তার আবার ‘কিং ফিশ’ এবং ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কিং ম্যাকেরেল’ বলে প্রজাতির রকমফের আছে। তবে মালয়ালিরা সবগুলোকেই ‘নৈমীন’ বলে ডাকেন। ডিশ হিসাবে ‘নৈমীন’ যথেষ্ট জনপ্রিয়। আর নানা আকারের চিংড়ি তো আছেই।

ওই সৈকতেই বিক্রি হতে দেখেছিলাম ‘গোল্ড স্ট্রাইপ সার্ডিনেলা’ আর ‘ইন্ডিয়ান অয়েল সার্ডিন’। দু’টোরই স্থানীয় নাম ‘চালা’। তবে দ্বিতীয়টার শরীরে তেল পাওয়া যায় বেশি। স্থানীয় ভাষায় ‘বেলুরি’ মাছটাও আকারে-আকৃতিতে কাছাকাছি। পোশাকি নাম ‘হোয়াইট সার্ডিন’। ‘ফ্রিঞ্জস্কেল সার্ডিনেল’ বলে মাছটির আঁশ আবার একটু ভিন্ন গোত্রের। নামেই অবশ্য তার ইঙ্গিত আছে। মালয়ালমে যার নাম ‘কারি-চালা’। তবে এ সবের চেয়েও ঢের বিখ্যাত মাছ ‘আয়ালা’। উত্তর কেরলের পালাক্কাড থেকে ফেরার পথে আলাত্তুরে গাড়ি থামিয়ে রেস্তোরাঁয় ‘আয়ালা ফ্রাই’ খেয়েছিলাম। বাঙালির তেলাপিয়ার চেয়ে ছোট আবার পুঁটির চেয়ে বেশ কিছুটা বড় এই রকম একটা আকার কল্পনা করে নিলে যেমন হবে, অনেকটা তেমন দেখতে। এক্কেবারে কড়া করে ভেজে কালো কুচকুচে করে পরিবেশন করা হয়েছিল। সেই জন্যই হয়তো স্বাদে একটু তেতো। কিন্তু মালয়ালিদের অত্যন্ত প্রিয়। মাছটার ভাল নাম ‘ইন্ডিয়ান ম্যাকেরেল’। কেরলের বিখ্যাত ‘ব্যাক ওয়াটারে’ও এই সব মাছের ঢের দেখা মেলে।
রেস্তোরাঁয় গিয়ে মেনুকার্ড দেখে মাছের যে কোনও ডিশ তো যে কোনও সময়েই বেছে নেওয়া যায়। কিন্তু কাঁচা মাছ তার আদি চেহারায় এ ভাবে দেখার অভিজ্ঞতা অনন্য বৈকি! রেস্তোরাঁগুলোও সৈকতের ওই দোকান থেকে পাইকারি হারে কেনে। খুচরো বিক্রিও হয়। সময়ের ফেরে স্বাভাবিক ভাবেই দামে হেরফের লেগে থাকে। তাই এই দর্শন-কাহিনিতে অহেতুক পকেটের তথ্যে গেলাম না! তবে একটা মজাদার ছোট্ট তথ্য দিয়ে কাহিনিটা শেষ করা যেতে পারে। কয়েকটা দোকানে কাঁচা মাছের সাজানো সম্ভারের পাশেই দিব্যি বসে থাকতে দেখলাম মার্জার-প্রহরীকে! সামনে মাছ সাজানো অথচ বিড়াল বাহাদুর তাতে মুখ দিচ্ছেন না! দোকানি জানালেন, যখন তাদের খেতে দেওয়া হয়, তখনই তারা নাকি খায়! নো চৌর্যবৃত্তি!

বিড়াল বলে মাছ খাব না, আঁশ ছোব না, ফোর্ট কোচি যাব! পুরনো আপ্তবাক্যটায় ‘কাশী’ কেটে ফোর্ট কোচি বসিয়ে নেওয়াই বোধহয় বাস্তবসম্মত হবে!

ছবি: লেখক

এই লেখকের আরও ভ্রমণকথা


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ