সন্ধে হলেই পাগল করা ফুচকার নেশা প্রমিতা মল্লিক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী
পঞ্চাশ-ষাট দশকের কলকাতা। আমার ছুটি কাটানোর কলকাতা। আমি তো শান্তিনিকেতনের মেয়ে। তাই কলকাতাতে ছুটি কাটানোর মজাই ছিল আলাদা। দেখতাম ভোরবেলা রাস্তা ধোওয়া চলছে। পিচের রাস্তাগুলো চকচক করে উঠত। হালকা রোদের আলোয় তা আরও সুন্দর লাগত। হাঁ করে সে দিকেই চেয়ে থাকতাম। অবাক চোখে দেখতাম ময়দানও। স্বপ্নের মতো লাগত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সবুজ ঘেরা উদ্যান।
কলকাতাতে ছুটি কাটাতে এসে কি আর বসে থাকা যায়? চরকির মতো ঘুরতাম। বাবা-মায়ের সঙ্গে নিউ মার্কেটে চলে যেতাম। স্কাইরুমে মিক্সড গ্রিল বা কোনও দিন চিনে খাবার খাওয়া। আমার আরও একটা জিনিস খুব ভাল লাগত— কোয়ালিটিজ-এ ঢুকলেই একটা মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যেত। সেটা যে কী ভাল লাগত এখন মনে পড়লেই হাসি পায়।
তখন দু’একটা দোকানে দারুণ কেক পাওয়া যেত। সে রকম কেক যেন এখন আর পাই না। তখন তো কলকাতা এত ভিড় বা ঘিঞ্জি ছিল না। যখন যেখানে মনে হত হেঁটেই চলে যেতাম। ভালও লাগত হাঁটতে। আর হাঁটার পথে ফুচকার দোকান পেয়ে যেতাম অবশ্যম্ভাবী। এ শহরের ফুচকার কোনও তুলনা হয় না। বাড়ির কেউ জানত না বাস-ট্রামের ভাড়া বাঁচিয়ে প্রতিদিন বিকেলে ফুচকা খাওয়ার কথা।
আমার এখনও মনে আছে, তখন ধর্মতলার মেট্রো সিনেমাতে প্রতি রবিবার সকালের শো-তে ছোটদের জন্য হলিউডের ছবি দেখানো হত। দেখতে দারুণ লাগত। তখন কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে গানের প্রতিযোগিতা হত। আমি ঠিক হাজির হয়ে যেতাম। কত যে পুরস্কার নিয়ে বাড়িতে ঢুকতাম তার ইয়ত্তা নেই।
উনসত্তরের শেষ দিকে পাকাপাকি ভাবে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় চলে আসি। তখন তো এই শহরে উত্তাল রাজনীতি। রোজ খুন-খারাপি লেগেই থাকত। এখানে-ওখানে পড়ে থাকত মৃতদেহ। অলি-গলি থেকে ছুটে বেরোচ্ছে পুলিশের গাড়ি। এর মধ্যেও থেমে থাকিনি। এখন আর বলতে লজ্জা নেই, প্রথম কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখার কথা। সত্যি, তখন কী সাহসিনী ছিলাম আমি। কেউ টেরই পায়নি আমার হাবভাব দেখে।
চল্লিশ বছর কাটিয়ে দিলাম এই শহরে। একটা কথা ভেবে আমি এখনও গর্ববোধ করি। এই শহর থেকে আমি অনেক অযাচিত সাহায্য পেয়েছি। এ এক অদ্ভুত পাওয়া। এই শহরে এসে অনেক ‘মানবিকতার’ প্রমাণও পেয়েছি, যা আমার এখনও ভাল লাগে। আরও ভাল লাগে অন্য যে কোনও শহরের চেয়ে এখানে অনেক কম খরচে জীবনধারণ করা যায়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এখানে অটুট। বিদেশেও গিয়ে যখন এ সব নিয়ে কলকাতার প্রশংসা শুনি, তখন নিজেকে বড় ধন্য মনে হয়। তাই তো, কলকাতাকে যত আঁকড়ে ধরেছি ততই আমার জীবনের ও প্রতিভার বিকাশে অনেক প্রেরণার উৎস খুঁজে পেয়েছি।
তবে ইদানীং কেন জানি না, কিছু কিছু ব্যাপারে বড় দুঃখ পাই। বলতে পারেন কলকাতা থেকে কেন সেই রক কালচার উঠে গেল! ‘রকে’-ই তো পুরো পাড়ার ছবিটা ফুটে উঠত। একজন আরেক জনের খবর নিত। আর এখন? কেউ কারও খবর রাখে না। কেমন যেন সবাই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। দিনের শেষে একটু আড্ডা থাকবে না, তাই হয় নাকি? কিন্তু সময়ের সঙ্গে যে সব কিছুই মেনে নিতে হয়। দ্বিতীয় দুঃখের কথাটাও না বলে পারছি না। শান্তিনিকেতন থেকে চলে আসার পরেও কলকাতাতে কত গাছপালা, কত পাখি দেখেছি।
এখন? আকাশ, শিমুল সব যেন হারিয়ে যাচ্ছে। চেনা গাছ, চেনা পাখির ডাক খুঁজতে শহরের বাইরে যেতে হচ্ছে। এই দুঃখের সঙ্গে আরও একটি দুঃখ যেন নিঃশব্দে মন থেকে বেরিয়ে এল। মাত্র কয়েক দশক আগেও এই শহরে এক জন অন্য জনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। এখন সে সব তো নেই, বরং ভদ্র ব্যবহারটুকুও যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।
এত কিছুর পরেও অবশ্য আমি গর্বিত, আমার এই শহরের সেরা ফুচকার জন্য। যা পৃথিবীর কোথাও মিলবে না। সন্ধে হলেই মনটা নেচে ওঠে কখন যে খাব আমার সবচেয়ে প্রিয় ফুচকা— টক বেশি, ঝাল কম!
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.