বাংলার লোকশিল্পের যে আদৌ কোনও গুরুত্ব আছে, ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি বিশ শতকের গোড়াতেও তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি। জাতীয়তাবাদী আবেগে যখন শান্তিপুর ডুবুডুবু নদে ভেসে যায়, তখন বাঙালি গৌড়ীয় শিল্প নিয়ে গভীর চিন্তিত ছিল। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রমাপ্রসাদ চন্দরা বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি থেকে গৌড়লেখমালা, গৌড়রাজমালা-র মতো বই প্রকাশ করছেন, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের জন্য পাল-সেন যুগের পাথর ও ধাতুর মূর্তি সংগ্রহ করে আনছেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উদ্যোগে এশিয়াটিক সোসাইটিতে পুঁথি সংগৃহীত হচ্ছে নানা রকম। কিন্তু এ দিকে বাংলার মন্দির-টেরাকোটা অবলুপ্তির পথে, কাঠের কাজের সূত্রধর শিল্পীরা হারিয়ে যাচ্ছেন, পটুয়ারা ‘শিল্পী’ হিসেবে স্বীকৃত নন, কালীঘাটের পট তত দিনে মুদ্রণ-সংস্কৃতির কাছে হার মেনেছে। এর বাইরে খেলনা পুতুল, চিত্রিত হাঁড়ি-সরা, নকশি কাঁথা শাড়ি, ব্রত আলপনা, আরও কত কী ছড়িয়ে ছিল বাংলার গ্রামে গ্রামে, কেউই তার খোঁজ রাখতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লোকসংস্কৃতির নমুনা সংগ্রহ করতে ছাত্রদের উৎসাহিত করেছিলেন, কিন্তু আরও অনেক কিছুর মতো এ ক্ষেত্রেও তিনি নিতান্তই ব্যতিক্রম। সিভিলিয়ান গুরুসদয় দত্ত (১৮৮২-১৮৪১) কেতাদুরস্ত সাহেবিয়ানায় কোনও ফাঁক না রাখলেও স্ত্রী সরোজনলিনীর উৎসাহে বাংলার এই অবহেলিত শিল্পকৃতির দিকে আকৃষ্ট হন। গুরুসদয়ের ব্যক্তিগত উদ্যোগেই ১৯২৯-’৩৯-এর মধ্যে বাংলার নানা প্রান্ত থেকে সংগৃহীত হয় লোকশিল্পের অজস্র নমুনা। এমন কী সেগুলি নিয়ে প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন, যা তার আগে কখনও হয়নি। সেই সব নমুনাই আজ প্রদর্শিত হচ্ছে ব্রতচারীগ্রাম, জোকা-য় (ডায়মন্ড হারবার রোড)। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালা বা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে বাংলার লোকশিল্পের সংগ্রহ থাকলেও এত বিপুল এবং বিচিত্র সম্ভার আর কোথাও দেখা যাবে না।
অবিভক্ত বাংলার সিলেট জেলায় জন্ম গুরুসদয় দত্তের। ‘ব্রতচারী আন্দোলন’-এর জনক গুরুসদয় প্রথম ভারতীয় হিসাবে আইসিএস পরীক্ষায় প্রথম হন। ১৯০৫ সালে ভারতে ফিরে এসে সিভিলিয়ান হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রশাসনিক কাজের সুবাদে বাংলার নানা জেলায় ঘুরতে হয়েছিল তাঁকে। ব্যক্তিগত ভাবে লোকশিল্প সংগ্রহ করা ছাড়াও আরও বড় আকারে এগুলি সংগ্রহ ও চর্চার জন্য তিনি ১৯৩১-এ প্রতিষ্ঠা করেন ‘পল্লীসম্পদ রক্ষা সমিতি’। ১৯৩৫-এ গঠিত হয় ‘বাংলার ব্রতচারী সমিতি’, সেই সঙ্গে অবলুপ্তি ঘটে আগের সংগঠনটির। ১৯৪০-এ তিনি কলকাতার কাছেই জোকায় ১০১ বিঘা জমি কেনেন। গুরুসদয়ের ইচ্ছে ছিল দেশীয় শিল্পের উন্নয়নের জন্য এখানে একটি বড় আকারের শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন। নিজের সংগ্রহ প্রদর্শনের জন্য ‘ব্রতচারী সংগ্রহশালা’ গড়ার পরিকল্পনা করলেন,স্থাপিত হল ভিত্তিপ্রস্তরও। ১০১ বিঘা জমি আর সংগৃহীত সব লোকশিল্পের উপাদান উইল করে দিলেন ‘বাংলার ব্রতচারী সমিতি’র নামে। কিন্তু স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই চলে গেলেন গুরুসদয়, ১৯৪১ সালের ২৫ জুন।
গুরুসদয়ের প্রয়াণের প্রায় ১৫ বছর পর, ১৯৫৬-য় ব্রতচারী সমিতি তাঁর বাড়ি থেকে ২,৩২৬টি সংগ্রহ নিয়ে আসে। ১৯৬১-তে আবার সংগ্রহশালার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, এ বার করলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। ১৯৬৩-র ৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ুন কবির সংগ্রহশালার দরজা খুলে দিলেন জনসাধারণের জন্য। নাম হল ‘গুরুসদয় সংগ্রহশালা’। ১৯৮৪ পর্যন্ত ‘বাংলার ব্রতচারী সমিতি’-ই সংগ্রহশালা চালিয়েছিল। তারপর থেকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে, কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রকের অধীন হস্তশিল্প বিভাগ এর আর্থিক দায়িত্ব নিয়েছে। সংগ্রহশালা পরিচালনার জন্য তৈরি হয়েছে ‘গুরুসদয় দত্ত ফোক আর্ট সোসাইটি’। এখন এখানে নথিভুক্ত সংগ্রহের সংখ্যা ৩,১৭৭।
পাথরের গণেশ মূর্তি,
ঢাকা থেকে উদ্ধার
পুঁথি
পাথরের দুর্গা মূর্তি,
বীরভূম থেকে উদ্ধার
টেরাকোটার নিদর্শন
১৯৩৫-’৩৬-এ তমলুক থেকে পাওয়া পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন ছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহের মধ্যে আছে দশম থেকে আঠারো শতকের মধ্যবর্তী ৪৫টি পাথরের মূর্তি। এর অধিকাংশই বীরভূম জেলা থেকে সংগৃহীত। পাল ও সেন যুগের পাথরের মূর্তি অন্যান্য সংগ্রহশালাতেও সুলভ, কিন্তু লোকশিল্পের নিদর্শনের মধ্যে ১৬টি চিত্রিত পুঁথির পাটা নিঃসন্দেহে মূল্যবান। বিষ্ণুপুরের আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবনের সংগ্রহ ছাড়া এত ভাল চিত্রিত পাটা আর বিশেষ কোথাও নেই। প্রায় ২০০ মন্দির-টেরাকোটার নিদর্শন আছে এখানে। কিছু ফরিদপুর এবং বাকি সব টেরাকোটা ফলক বীরভূম থেকেই সংগ্রহ করেন গুরুসদয়। বস্তুত অন্যান্য নিদর্শনের মতোই মন্দির-টেরাকোটা সংগ্রহশালায় রক্ষা করার কথা এর আগে বিশেষ ভাবা হয়নি, যদিও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সংগ্রহে ১৯২২-এর আগে সংগৃহীত বেশ কিছু চমৎকার টেরাকোটা ফলকের নিদর্শন আছে। বিশেষত যেখানে ঔপনিবেশিক শিল্পচর্চার ধারা অনুসরণ করে বাঙালি শিল্প-আলোচকরাও মন্দির-টেরাকোটাকে বিশ শতকের মাঝামাঝির আগে তেমন গুরুত্ব দেননি, ব্যতিক্রম অবশ্যই মুকুল দে-র মতো দু’একজন শিল্পবেত্তা।
কাঠের কাজের খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ২০০ নিদর্শন এখানে সংগৃহীত হয়েছে, তা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ভারতীয় সংগ্রহশালার প্রাক্তন অধিকর্তা শ্যামলকান্তি চক্রবর্তীর একটি সুমুদ্রিত ক্যাটালগও। আঠারো-উনিশ শতকের কাঠের ভাস্কর্যে দরজার ফ্রেম, কড়ি-বরগা, রথের প্যানেল, নানা মূর্তি রয়েছে, যা এখানে রক্ষিত হওয়ায় ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে। আজকের বাংলায় একমাত্র সুখড়িয়ার মুস্তৌফীদের চণ্ডীমণ্ডপের মতো দু-একটি নমুনা ছাড়া কাঠের কাজের সেরা নিদর্শনগুলি সবই হারিয়ে গিয়েছে। বেহালায় রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহশালায় রাখা আছে কালিদাস দত্ত ও অন্যদের সংগৃহীত কিছু চমৎকার দারু-ভাস্কর্যের নমুনা।
গুরুসদয় সংগ্রহশালার আর একটি বড় সম্পদ নকশি কাঁথা, যার সংখ্যা এখানে ২১০। খুলনা, যশোহর, রাজশাহি, ঢাকা ইত্যাদি পূর্ববঙ্গের নানা জেলা থেকে এগুলি গুরুসদয় সংগ্রহ করেছিলেন। ব্যবহারিক উপযোগিতার দিক থেকে এগুলি নানা ভাগে বিভক্ত: সুজনি, লেপ, বেতন, আরশিলতা, রুমাল, ওয়াড় ইত্যাদি। এর মধ্যে মানদাসুন্দরীর সুজনি কাঁথায় উনিশ শতকের সমাজজীবনের নানা মোটিফ দর্শনীয়। এই সব কাঁথা নিয়ে সারা পৃথিবীর গবেষকরা কাজ করেছেন, প্রকাশিত হয়েছে নানা বই। সংগ্রহশালা থেকেও এর উপর বই প্রকাশ করা হয়েছে।
কাঁথার মতোই আর এক মূল্যবান সংগ্রহ জড়ানো পট, চৌকো পট ও কালীঘাট পট, সব মিলিয়ে যার সংখ্যা ৭০০-রও বেশি। মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান ও কুমিল্লা জেলার ২৭০টি জড়ানো পট-এ রামায়ণ, কৃষ্ণলীলা, চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চৈতন্য ও জগন্নাথলীলা, হরিশচন্দ্র-শৈব্যা, সাবিত্রী-সত্যবান, সিপাহি বিদ্রোহ, শক্তি পট, আদিবাসী পট সবই দেখা যায়। কালীঘাট পটের প্রাথমিক রেখাচিত্রগুলি শিল্প-ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে খুবই মূল্যবান। পটের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয় চালচিত্রের কথা— উনিশ ও বিশ শতকের ৬টি চালচিত্র দেখা যাবে এখানে। দুর্লভ পুরনো লক্ষ্মীসরাও আছে ১৫টি, অধিকাংশই ফরিদপুরের।
মানদাসুন্দরীর সুজনি কাঁথা
বেতন কাঁথা
বাংলার দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত আর একটি বিষয় গুরুসদয় খুঁটিয়ে দেখেছিলেন বলেই হয়তো রক্ষা করেছেন, তা হল আমসত্ত্ব ও মিষ্টির ছাঁচ, সংখ্যায় ৭৭টি। আমসত্ত্বের ছাঁচ পাথরের তৈরি, মিষ্টির ছাঁচ পোড়ামাটির।
বাংলার পুতুলের খুব ভাল সংগ্রহ আছে এখানে, সংখ্যায় প্রায় ৫০০। কাঠ-শোলা-কাঁচামাটি, পোড়ামাটি, গালা কত না উপাদান। টেপা পুতুল, বউ পুতুল, ষষ্ঠী পুতুল, পাখি-মা পুতুল, মমি পুতুল কত বৈচিত্র। বস্তুত পুতুল এমনই জিনিস যা গ্রামের মেলায় বিক্রি হত, আর ভেঙে গেলেই ফেলে দেওয়া হত, আবার মেলায় কেনা যাবে বলে। কোনও সংগ্রহশালায় উনিশ বা বিশ শতকের গোড়ার পুতুল এ ভাবে রাখা হয়নি, তাই বাংলার লোকসংস্কৃতির এমন আশ্চর্য উপাদান একমাত্র এখানেই সুলভ। এ সব পুতুলের শিল্পীরা বহু দিন আগেই হারিয়ে গিয়েছেন, এদের শিল্পকর্ম দেখতে হলে এখন এই সংগ্রহশালাই ভরসা। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে দৈনন্দিন জীবনের শিল্পকর্ম সংগ্রহ পরিকল্পনায় দেখা গিয়েছিল, বাংলার পুতুল তৈরির প্রায় সব কেন্দ্রই এখন নিশ্চিহ্ন। কিছু কিছু এমন ভাবে পরিবর্তিত যে পুরনো ধাঁচ আর বোঝার জো নেই। এমনকী অতীতের পুতুল নিয়ে লেখালেখিও এত কম, এত কম লোক এ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন যে বিবরণী রেখে যাওয়ার প্রয়োজনও অনুভব করেছেন খুব কম জনই। কাজেই যে টুকু দেখা যাচ্ছে সেটাই অমূল্য।
এ ছাড়াও এখানে কাঠের আসবাবপত্র, পোড়ামাটির নানা পাত্র, মুখোশ, লোকবাদ্য, ধাতুশিল্প ইত্যাদি নমুনাও আছে।
সংগ্রহশালার নানা পরিকল্পনা আছে, নিয়মিত আলোচনা ও নানা কর্মশালাও আয়োজিত হয়। সব মিলিয়ে কলকাতার এক বিশিষ্ট সংস্কৃতিকেন্দ্র গুরুসদয় সংগ্রহশালা।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.