ডিজিটাল দোলের আঙিনায়

মাদের দোল ছিল কিছুটা অন্যরকম— শহুরে দোল যেমন হয়।

আগের দিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখতাম ফাঁকা মাঠে শুকনো গাছপালা কেটে ন্যাড়াপোড়ার আয়োজন। সূর্য ডোবার আগেই প্রস্তুত পাড়ার কচিকাঁচারা। তারপর ঝুপ করে সন্ধে নামলেই সবাই লাইন করে বারান্দায়। আর চারপাশ থেকে ঐক্য সুরে দোলযাত্রার ট্যাগলাইন—
আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল,
পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠবে বল হরিবোল!

এ যেন ন্যাড়াপোড়ার রিয়্যালিটি শো!

পরদিন সত্যনারায়ণের পায়ে ঢিপ করে পেন্নাম করে আবির, পিচকারি, বালতি ভরে রঙের গোলা আর বারান্দা দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে রং ভর্তি বেলুন মারা— কাউকে না পাও তো ধোপ দুরস্ত ফতুয়া পরা বাজার অভিমুখী বাবা-দাদাকেই রং দাও কিম্বা বেচারা কাজের মাসিকে একেবারে চুবিয়ে দাও রঙে। এর সঙ্গে অবিরত মুখ চালানো— ঠাকুর ঘর থেকে ঠাম্মার পুজো করা ফুট কড়াই, মুড়কির চুড়ো ক্রমশ নিম্নগামী হতে থাকে, হাতে রঙিন মঠ। তখন কেউ ফতোয়া জারিও করেনি মঠের রঙের ওপর। লাল মঠে এলিজারিন, হলুদে মেটানিল... এটা খেও না, সেটা করো না!

ক্রমে যখন স্কুল পেরিয়ে কলেজ-গেট তখন দোল বেশ সিরিয়াস, অনার্সের চাপে। তবে দোল ছিল প্রকৃত দোলের মতো— অন্য রকমের মাদকতা আর একটা বিশেষ ছুটির দিন পাওয়া। তখন না ছিল ইন্টারনেট, না মোবাইল ফোন, বা হাজারো কেবল চ্যানেল। অগত্যা দূরদর্শনের দোলের বৈঠকি! তবে মায়ের হাতে স্পেশাল রান্না ছিল সেদিনের মুখ্য আকর্ষণ। দুপুরে পোলাও-মাংস কিম্বা রাতে লুচি-আলুর দম ছিল দোলের ‘স্পেশালিটি কুইজিন’।

কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটির এক লাফে ট্রানজিশান, কো-এড বাতাবরণ। রঙিন চশমা চোখে আর সদ্য ফুটিফুটি যৌবনে পা রাখার আনন্দ। হেদোর মোড়ের ফুচকা ততদিনে পার্শিবাগানে পাড়ি দিয়েছে। বিধান সরণির চাচার রোল তখন রাজাবাজারে উত্তীর্ণ। সেবার প্রচুর ফাগ খেলা হল এক পাল ছেলেমেয়ে মিলে। সেই প্রথম ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে দোল খেলে লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে মিনিবাসে বাড়ি ফেরা। তবুও আনন্দ আকাশে বাতাসে। মা যেন খুশিই হলেন। একরত্তি মেয়েটা কেমন বড়ো হয়ে গেল! এই তো জগতের নিয়ম। প্রকৃতির গাছে পাতা ঝরে নতুন পাতা আসবে। আম গাছে মুকুল আসবে। বাদাম গাছের পাতা ঝরে গিয়ে লাল ফুল সর্বস্ব গাছ হবে এই তো বসন্তের নিয়ম!

তখন প্রাপ্তবয়স্ক হবার পাসপোর্ট যেন পাওয়া হয়েই যেত সরস্বতী পুজোতে। তার পরেই দোল। অত এব সেই পাসপোর্ট হাতে পেয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসা পেয়ে যাওয়া। তাই সব কিছুতেই মায়ের সায়। লালগোলাপ দিয়ে ভালোবাসার কোর্টশিপ চালু হতে না হতেই বিরহিনী যক্ষের মত দোল রঙিন হত নীল খামে পারফিউম মাখানো চিঠির ভাঁজে লিপস্টিকের চুমু পাঠিয়ে সাগরপারে। তখনও হিমেল বসন্তে ই-মেল নেই। দোলের দিনে এক টুকরো চিরকুটের নীরব প্রতীক্ষা। অপ্রত্যাশিত ভালোবাসার সেই নীল খাম পেলাম দোলে। তারপর একে একে গায়েহলুদ, সপ্তপদী আর দোলের গালের লাল রং উঠল সিঁথিতে।

এখন ফাগুনের ফুল ঝরতে না ঝরতেই চকোলেট-ডে, প্রোপোজ ডে, হাগ-ডে, কিসিং-ডে, ভ্যালেন্টাইনস-ডে পেরিয়ে দোল ডে। দোলের আবিরগুঁড়ো অহোরাত্র উড়তেই থাকে ফেসবুক জানলায়, দেওয়ালে, বারান্দায়। দোলের রং গড়িয়ে পড়তে লাগল অরকুট অলিন্দ দিয়ে। সেই রং গিয়ে পড়ল ফেসবুক উঠোনে।

এখন দোলের রঙের ওপরেও ‘টেকশো’! রূপ সচেতন বঙ্গ তনয়ারা ‘স্কিন-ফ্রেন্ডলি’ রং চায়— ইকো-ফ্রেন্ডলি আবির, ভেষজ গুলাল! দোলের উপহারের তালিকায় আইপড কিম্বা পেনড্রাইভের কাটতি বেশি। দোলের কবিতার খাতা লুকিয়ে থাকত বালিশের নীচে। আর এখন সেই কবিতা ঝরে ঝরে পড়ছে ফেসবুকের বারান্দায়, কার্নিশ থেকে সর্বত্র। তবে দোল আছে দোলেতেই। একটু অন্য আঙ্গিকে। তখন ছিল তরতাজা সত্যি গোলাপ, এখন তা ডিজিটাল। ছিল বসন্ত কেবিনে দুজনে মুখোমুখি দুটো ডিমের ডেভিল বা ফাউল কাটলেট। প্রেম এখন বার্গার-মকটেলে আছড়ে পড়ছে অবিরত। দোলের দিনেও সেই ‘হ্যাং আউট’— শুধু বসন্ত কেবিন এখন নীল ফেসবুকের কফিহাউস কিম্বা ডিজিটাল ঠান্ডাই শরবতি মেসেজ আদানপ্রদানে।

আমরা দোলবাজি করি অন্য ভাবে। কিছুটা ফেসবুকি দলবাজিতে অথবা ব্লগবাজির ঠেকে। তবে দোলের সেই আনন্দ আর খুঁজে পাই না। ফুটকড়াই মুড়কি-মঠ হারিয়ে গেছে। হারিয়েছে দোলের আটপৌরে আভিজাত্য। দোলবাজি এখন স্মার্ট হয়েছে। দোলা লাগছে ফেসবুক-বনে কিন্তু দোলের রং লাগে না মনে। দোলের ব্র্যান্ড ডাইলুশান হল!

মকটেল থেকে চকোলেট, কফি থেকে কেক, সোনা থেকে জাঙ্ক— সর্বত্র হিয়ার মাঝে লুকোনো ‘হ্যাপি হোলি’— হোলি ধামাকা, হোলি বাম্পার, হোলি হ্যায়। শপিং মল, মেট্রোরেল, সুইমিং পুল, তন্ত্রে-মন্ত্রে হোলি হ্যায়।

সেই কবে কবি বলেছিলেন ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’। তারা পলাশ চিনুক না চিনুক, দোলের দিন আগতপ্রায়। দোলের রং লাগতে না লাগতেই ফেসবুকে স্টেটাস আপডেট করতে হবে...

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রিতে এমএসসি। অধ্যাপক স্বামীর কর্মসূত্রে বর্তমানে খড়গপুরে বাস। পুত্র ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠরত। সাহিত্যচর্চায় আমরণ ঝোঁক। প্রথম গল্প প্রকাশিত দেশ পত্রিকায় ২০১১তে। এ ছাড়া আনন্দবাজার পত্রিকায় ভ্রমণকাহিনিও প্রকাশিত একাধিক বার। গদ্যচর্চার পাশাপাশি কবিতার সঙ্গে ওঠাবসা চলতেই থাকে। সঙ্গীতচর্চা, বেড়ানো এবং রান্না— অবসর যাপনের আরও তিনটি ঠেক।

নিজস্ব চিত্র
 
 

 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.