সরস্বতীর আবাহনে
বাল্য-বিবাহ তখন সমাজের প্রথা। এমনই এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেন প্রভাবতী। প্রথাগত শিক্ষা লাভ তাঁর হয়নি ঠিকই, তা সত্ত্বেও পারিবারিক প্রভাবে ছোট থেকেই ছিল সাহিত্যচর্চার মন। মাতৃভাষা ছাড়াও ইংরেজি কাব্যের রসাস্বাদন করেন বাবার সান্নিধ্যে। পরবর্তী জীবনে পরিচিতি পান সাহিত্যিক হিসেবে। স্কুল শিক্ষক হিসেবেও ছিলেন সমান দক্ষ। এ হেন ‘সরস্বতী’র জন্ম তারিখ এ মাসেই। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা স্বরূপ এ মাসের ‘অতীতের তারা’য় থাকল সাহিত্যিক প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর সম্পর্কে কিছু কথা।

পরিবারিক তথ্য ও শিক্ষা
উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙা পুরসভার অর্ন্তগত খাঁটুরা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন প্রভাবতী বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯০৫ সালের ৫ মার্চ। পিতা ছিলেন আইনজীবী গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়, মা সুশীলাবালাদেবী, স্বামী বিভূতিভূষণ চৌধুরী, ভগিনী খ্যাতনামা লেখিকা ও চিত্রশিল্পী হাসিরাশিদেবী।

আইনের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যের প্রতিও গোপালবাবুর আকর্ষণ ছিল। সাহিত্যানুরাগিণী ছিলেন সুশীলাবালাদেবীও। প্রভাবতীর সেই অর্থে প্রথাগত শিক্ষালাভ হয়নি। কিন্তু ছোট থেকেই বাবা-মায়ের কাছ থেকে সাহিত্যচর্চার উৎসাহ পান তিনি। পিতার আনুগত্যে কৈশোরেই শেলি, কিটস্, বায়রন ইত্যাদি ইংরেজি কাব্যের রসাস্বাদন করেন তিনি।

মাত্র ৯ বছর বয়সে প্রভাবতীর বিবাহ হয় গাইপুর গ্রামের বিভূতিভূষণ চৌধুরীর সঙ্গে। কিন্তু অসুখি দাম্পত্য-জীবনের কারণে খুব অল্প সময় পরই তিনি পিতৃগৃহে ফিরে আসেন। বাবার কর্মসূত্রে দিনাজপুর, বহরমপুর, লামডিং-এ থাকার পর জীবনের শেষ চল্লিশ বছর কাটান কলকাতায়। বাবা গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যান লামডিঙে। কলকাতার পাতিপুকুরে নিজ বাসগৃহে প্রায় মাস তিনেক গলব্লাডারের অসুখে ভুগে প্রভাবতী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৭২ সালের ১৪ মে।

সাহিত্যচর্চা ও কর্মজীবন
বাবার বদলির চাকরি ও খুব অল্প বয়সে বিয়ের জন্য স্কুলে গিয়ে পড়া হয়নি প্রভাবতীর। কিন্তু বাবা-মায়ের সাহিত্যচর্চার প্রভাবে খুব ছোট বয়স থেকেই তাঁর লেখালেখি শুরু। শিক্ষাগ্রহণ-সংসারধর্ম কোনও কিছুই তাঁর সাহিত্য রচনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। মাত্র ১১ বছর বয়সেই তাঁর প্রথম কবিতা ‘গুরুবন্দনা’ প্রকাশ পায় তত্ত্বমঞ্জরী পত্রিকায়। আর, প্রথম গল্প ‘টমি’ প্রকাশ পায় অর্চনা পত্রিকায়। ১৯২২ সালে, মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি রচনা করেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অম্বা’। তিনি ‘প্রতীক্ষায়’ উপন্যাসটি লেখেন লামডিঙে থাকাকালীন।

তাঁর রচিত প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস ‘বিজিতা’ প্রকাশিত হয় জলধর সেন সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকায়, ১৯২৩ সালে। পরবর্তীকালে এই উপন্যাসটি বাংলা, হিন্দি ও মালয়লম ভাষায় যথাক্রমে ‘ভাঙাগড়া’, ‘ভাবী’ ও ‘কুলদেবম্’ নামে চলচ্চিত্রও হয়। তাঁর আরও একটি উপন্যাস ‘পথের শেষে’ দীর্ঘ দিন অভিনীত হয় নাট্যনিকেতনে, বর্তমানের বিশ্বরূপা থিয়েটারে। ‘বাংলার মেয়ে’ নামে সেই নাটক অভিনীত হয় ১৯৬৪ সালে।

ব্রাহ্ম গালর্স ট্রেনিং কলেজ থেকে টিচার্স ট্রেনিং সার্টিফিকেট লাভ করে বেশ কিছু দিন শিক্ষকতা করেন প্রভাবতীদেবী— প্রথমে উত্তর কলকাতার সাবিত্রী স্কুলে ও পরে কলকাতা পুরসভা পরিচালিত বিদ্যালয়ে। সাবিত্রীতে কর্মরত অবস্থায় তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য লাভ করেন। কবিগুরুও তাঁকে সাহিত্য রচনাতে যথেষ্ট উৎসাহিত করেন। ‘মাটির দেবতা’ উপন্যাসটি হয়ত সেই উত্সাহেরই ফসল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের উদ্যোগে অবসর গ্রহণ না করা পর্যন্ত পুরসভা স্কুলে শিক্ষকতা করেন তিনি।

খাঁটুরার বঙ্গ বালিকা বিদ্যালয় যখন বিলুপ্তির পথে তখন প্রভাবতী নিজের প্রতিভা ও কর্মদক্ষতায় তাকে খাঁটুরা বালিকা বিদ্যালয় নামে পুনরুজ্জীবিত করে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সমাজসেবা, দেশপ্রেম ও নারী প্রগতিতে তিনি বিশেষ ভাবে উৎসাহী ছিলেন। ওই অঞ্চলে সরোজ নলিনী নারী মঙ্গল সমিতির শাখা কেন্দ্রের সভানেত্রী ছিলেন। ‘বিপ্লবীর স্বপ্ন’ উপন্যাসটি প্রভাবতীর স্বদেশপ্রেমের সাক্ষ্য বহন করে।

জামশেদপুরের সর্বভারতীয় ‘বেঙ্গলি লিটারারি সোসাইটি’-র সহ কর্ণধারের পদ সামলেছেন প্রভাবতীদেবী, সঙ্গে ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর সাহিত্য প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজ তাঁকে ‘সরস্বতী’ উপাধি দেন। এ ছাড়াও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘লীলা পুরস্কার’ পান।

স্মৃতিচারণ
মহাশ্বেতা দেবী (সাহিত্যিক)
এক সময় অসম্ভব এনার্জি ছিল গল্পের বই পড়ার। ১৬-১৭ ঘণ্টা কোথা দিয়ে কেটে যেত বুঝতে পারতাম না। প্রভাবতী দেবী সরস্বতী পুরনো যুগের সাহিত্যিকদের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য লেখিকা ছিলেন। তবে আজ সেই ভাবে তেমন কোনও গল্পের নাম মনে পড়ে না যেটি মনে দাগ কেটেছিল। এখন আমার বয়স ৮৯। এই বয়সে মনে রাখাও খুব কঠিন কাজ। এক সময় হিন্দি ‘ভাবী’ সিনেমা দেখেছিলাম। কী আশ্চর্য ঘটনা! আজ জানলাম সেটি তাঁরই উপন্যাস ‘বিজিতা’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল। এ রকম কত গুণীজন যে ছড়িয়ে আছেন, আড়ালে রয়ে গেলেন... তাঁদের প্রকাশ্যে আনলে সমাজ উপকৃত হবে।


শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (সাহিত্যিক)
তাঁর লেখনী শুধু উপন্যাসেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ছোটদের জন্য তিনি গোয়েন্দা ধারাবাহিক রচনা করেছিলেন। ছেলেবেলায় সেই সব বই পড়েছি। প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর বলিষ্ঠ লেখনী সেই সময় খুব নাম করেছিল। ‘ভাঙাগড়া’ চলচ্চিত্রটি খুবই নাম করেছিল। ‘বিজিতা’ উপন্যাসটি তিনটি ভাষায় চলচ্চিত্র হয়েছিল। বাংলায় ‘ভাঙাগড়া’ চলচ্চিত্রটি দেখে মনে করতে পারছি তাঁর লেখনী। তবে জেনে ভাল লাগছে যে আরও দুটি ভাষায় ছায়াছবি হয়েছিল। সেই সময় ছোটদের জন্য ‘কৃষ্ণা রোমাঞ্চ সিরিজ’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল সার্কাস’ ছোটদের মধ্যেও আলোড়ন তুলেছিল। শুনেছি তাঁর গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।


পবিত্র সরকার (শিক্ষাবিদ)
প্রভাবতী দেবী সরস্বতী সেই সময়ের লেখিকা যখন ব্রাহ্মণ হলে তাঁর পদবি হত ‘দেবী’ অন্য কিছু নয়। অন্যরা ‘দাসী’, ‘ঘোষজায়া’ কিংবা অন্য কিছু। মহাশ্বেতা দেবী সেই ঐতিহ্য মেনে নিয়েছিলেন। আশাপূর্ণা দেবী হয় তো ব্যতিক্রম। যাই হোক, প্রভাবতী দেবী তাঁর সাহিত্যকীর্তির জন্য কোনও সংগঠনের কাছে ‘সরস্বতী’ উপাধি পেলেও আমার তাঁর উপন্যাস পড়ার কোনও স্মৃতি বেঁচে নেই, গল্পও মনে নেই, যদিও পূজাবার্ষিকীতে বেশ কিছু গল্প পড়েছি। তাঁর গল্পে আবেগের প্রাধান্য থাকত, চিরাচরিত গার্হস্থ্য সুনীতির আদর্শকে তিনি শিরোধার্য করেছিলেন। আত্মদানেই নারীর স্বাধীনতা, এ রকমই ছিল তাঁর বার্তা। শেষ দিকে যেটুকু মনে আছে, দেবসাহিত্য কুটির থেকে কৃষ্ণা সিরিজ বলে কৃষ্ণা নামের একটি মেয়ে ডিটেকটিভের সাহস ও দক্ষতা নিয়ে তিনি বেশ কিছু বই লিখেছিলেন। তাতে এখন আমার মনে হয়, মেয়েদের একটা শক্তির অবস্থান থেকে দেখার চেষ্টা করেছিলেন। আমি তাঁর দু-একটা বই পড়েছিলাম, কিন্তু এর বেশি আমার মনে নেই।


সুদক্ষিণা ঘোষ (শিক্ষক, কিশোর ভারতী ভগিনী নিবেদিতা কলেজ)
অসংখ্য উপন্যাসের রচয়িতা প্রভাবতীদেবী সরস্বতী ছেলেবেলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করেননি। কিন্তু বাড়ির ও পারিপার্শ্বিক আবহে তিলে তিলে নিজেকে গড়ে নিয়েছিলেন। সমকালের জনপ্রিয়তা অল্প বিস্তর পেয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু বাঙালি পাঠককে শিকল ভাঙার গান শোনানোর প্রস্তুতি নিয়ে আসেননি, কোনও চেষ্টাই করেননি পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার বিতংস ভেদ করার। নারী-ঔপন্যাসিকদের দ্বিধারায় ইনি এই ধারার একজন, যাঁরা লিঙ্গ-পরিচয়েই আঁকড়ে থেকেছেন, তার গভীরে আর কিছু খুঁজতে চাননি। পুরুষের গড়া সাহিত্যের বিকল্প কোনও স্রোতে অবগাহন করতে চাননি। সমাজ যে ভাবে মেয়েদের চেয়েছে— সেই ভাল মা, ভাল স্ত্রীর পরিচয়েই পরিতৃপ্ত থাকতে চেয়েছেন।

‘আমার কথা’ উপন্যাসে যেখানে বালবিধবাটির স্বামীকে চোখে দেখার স্মৃতিটুকু পর্যন্ত মনে নেই, সেখানে পুনর্বিবাহের জন্য দাদার চেষ্টাকে উপন্যাস জুড়ে নিন্দে করা হয়েছে। এখানে সতীত্বের জয়গানে মুখর হয়ে উঠেছে উপাখ্যান। কিন্তু এই পরিচয়ই শেষ নয়! সমাজতন্ত্রবাদ, সাম্যবাদের অগভীর উচ্চারণও অনেক ছড়িয়ে আছে প্রভাবতীর উপন্যাসে। ‘জাগৃহি’ উপন্যাসে নায়ক ঈশান তার ধর্ষিতা মায়ের কলঙ্কের কারণে ব্রাহ্মণের পংক্তিভোজনে প্রত্যাখ্যাত হলে পৈতে ফেলে বলে, যদি সত্যকার দেবতা কেউ থাকেন, আমি হাতজোড় করে তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছি... যদি আবার জন্ম দাও... আমায় হীন চণ্ডালের ঘরে... সেখানে সমাজ গড়ে তুলব... জগৎকে সেটাই জানাব।

মেয়েদের অবস্থার শোচনীয়তার কথাও ছড়িয়ে আছে প্রভাবতী দেবীর উপন্যাসে, কিন্তু তাও আছে প্রথাসিদ্ধ বলেই, তাঁর নিজের গভীরতার অনুভব বলে নয়।

(‘মেয়েদের উপন্যাসে মেয়েদের কথা’ থেকে সংগৃহীত)


সৃষ্ট সাহিত্য
গল্প-উপন্যাস মিলিয়ে তিনশোরও বেশি রচনা আছে তাঁর। সামাজিক বিষয় ছিল তাঁর লেখার মূলধন। হিন্দু ধর্মের আদর্শ ও মূল্যবোধও পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। সমকালীন বিভিন্ন পত্রিকা যেমন ভারতবর্ষ, কল্লোল, বাঁশরী, সারথী, উপাসনা, উদ্বোধন, সম্মিলন-তে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বহু লেখা। উপন্যাস-গল্প-ছোটদের রচনা ছাড়াও বেশ কিছু গান আছে তাঁর লেখা। উল্লেখযোগ্য কিছু রচনা—
• উপন্যাস
ব্রতচারিণী, মহিয়সী নারী, ব্যথিতা ধরিত্রী, ধূলার ধরণী, রাঙা বৌ, জাগৃহি, বিধবার কথা, তরুণের অভিযান, প্রতিষ্ঠা, ঘূর্ণিহাওয়া, সোনার সংসার, সন্ধ্যা, স্নেহের মূল্য, সংসার, পথের সাথী, বোধন, দানের মর্যাদা, দূরের আকাশ, বির্সজন, মাটির দেবতা, আয়ুষ্মতী, সহধর্মিনী, পান্থপাদপ, আসামের জঙ্গল, আটলান্টিকের তীরে, মুখর অতীত ইত্যাদি।

গল্পগ্রন্থ
শুভা, সাগর পারের চিঠি, হারানো স্মৃতি, পাঁকের ফুল, লক্ষ্মী প্রতিষ্ঠা, শেষের দিকে, আশ্রয়, সমাজদ্রোহী, অপরাধিনী ইত্যাদি।

• ছোটদের গল্প
• ‘কৃষ্ণা রোমাঞ্চ সিরিজ’ অন্তর্গত কারাগারে কৃষ্ণা, কৃষ্ণার অভিজ্ঞান, কৃষ্ণার পরিচয়, মায়াবী ও কৃষ্ণা, কষ্ণার জয়যাত্রা
• ইন্টারন্যাশনাল সার্কাস
• অন্যান্য— রহস্যময়ী শিখা, শিখার স্বপ্ন, শিখা ও রাজকন্যা ইত্যাদি
 
তথ্য ও সাক্ষাৎকার: পাপিয়া মিত্র
ঋণ: ইতিহাসের আলোকে গোবরডাঙা, ফুলকি,
Encyclopae-dia Of Indian Literature (Vol-1)

ছবি: পাপিয়া মিত্র ও নিজস্ব চিত্র
 
 

 
 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.