মনীষালয়
ডিরোজিওর বাড়ি
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। উনিশ শতকের নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত এই মনীষী জন্মেছিলেন কলকাতাতে এবং তাঁর মৃত্যুও এই শহরেই। ডিরোজিওর জন্মস্থান তথা বসতবাড়িটির কোনও অস্তিত্ব নেই বলে তাঁর জীবনীকারদের অনেকে জানালেও, বাস্তবে কিন্তু আজও সেই বাড়ি বহাল তবিয়তে রয়েছে এই শহরের বুকে। ১৮ এপ্রিল ১৮০৯-এ তাঁর জন্ম। মৃত্যু ২৬ ডিসেম্বর, ১৮৩১। সংক্ষিপ্ত অথচ কর্মময় জীবন। যে বাড়িতে ডিরোজিও তাঁর জীবন কাটান, সামান্য পরিবর্তিত হলেও, ইটের তৈরি সেই বিশেষ ধরনের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বাড়িটি এখনও দ্রষ্টব্য।
ডিরোজিওর বাসভবনটি প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিত হয়েছিল ডিরোজিওর দুই জীবনীকার টমাস এডোয়ার্ড এবং ই ডবলিউ ম্যাজের বিবরণ থেকে। পরবর্তী কালে কলকাতার অন্যতম ইতিহাসকার ই এ কটন লেখেন, ‘‘লোয়ার সার্কুলার রোডের পূর্ব দিকে ও এন্টালিমুখী রাস্তার দক্ষিণে ১৫৫ নম্বর বাড়িটি বিখ্যাত ইউরেশিয়ান কবি ও শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর জন্মস্থান, যেখানে তিনি ১৮৩১ সালে মাত্র ২৩ বয়সে মারা গেছেন।’’

ডিরোজিওর জন্মদাত্রী মা সোফিয়া মারা যান ১৮১৫তে। হেনরির বয়স তখন মাত্র ছ’বছর। বাবা ফ্রান্সিস ডিরোজিও মারা যান ১৮৩০-এ। হেনরির দাদা ফ্রাঙ্ক এবং বোন সোফিয়া— (মা ও মেয়ের একই নাম) দু’জনেই মারা যান ১৮২৭-এ, হেনরির মৃত্যুর বছর চারেক আগে। তাই হেনরির মৃত্যুর পর দেনার দায়ে সে বাড়ি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন তাঁর বিমাতা অ্যানা মারিয়া রিভার্স, ভাই গিলবার্ট অ্যাস মোর বা ক্লড এবং বোন অ্যামেলিয়া। তার পর বেশ কয়েক বার হাতবদল হয় বাড়িটির।

কলকাতার অন্য এক ইতিহাসবিদ
রাধারমণ মিত্র নিলাম হয়ে যাওয়া সেই বাড়ির পরবর্তী মালিকদের একটি তালিকা তৈরি করতে গিয়ে ওই ক্রেতাকুলের এক জন নগেন্দ্রনাথ বসুমল্লিক সম্পর্কে জানান, ‘‘...১৯০৭ সালে ১৫৫ নং লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়িটি কিনে নিয়ে সেটা ভেঙে ফেলে তার জায়গায় মার্টিন কোম্পানিকে দিয়ে প্রায় ২ লক্ষ টাকা খরচ করে একটি বড় বাগান সমেত অট্টালিকা তৈরি করিয়ে সেখানে গিয়ে বাস করেন। অট্টালিকার নাম দেন ‘মিনার।’ অন্য এক সূত্র থেকে জানা যায়, নগেন্দ্রনাথ নাকি ওই বাড়িতে এমন একটি কাঠের সিঁড়ি তৈরি করিয়েছিলেন, যেটির প্রত্যেক ধাপে পা দিলে পিয়ানোর এক একটি সুর বেজে উঠতো। বিলাসী নগেন্দ্রনাথ অবশ্য সে বাড়ি নিজের অধিকারে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেননি।’’

রাধারমণ মিত্র বাড়িটির পুনর্নির্মাণ সম্পর্কে ঠিক তথ্য দিলেও, সেটি যে একেবারে ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন, তা ঠিক নয়। ‘ডিরোজিও স্মরণ সমিতি’ এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে সিদ্ধান্তে আসে যে, ১৫৫ নং, লোয়ার সার্কুলার রোডের (বর্তমান আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড) ডিরোজিওর বাড়িটি ভাঙা হয়নি কখনওই, কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। সমিতির সদস্য শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় পুরসভার বিল্ডিং-বিভাগ ও অন্যত্র অনুসন্ধান চালিয়ে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রমাণ করেছেন যে, নগেন্দ্রনাথ বসুমল্লিক বাড়িটির কিছুটা পরিবর্তন ঘটালেও মূল বাড়িটি এখনও প্রায় অক্ষুণ্ণই আছে। মৃত্যুর ১৫০ বছর স্মরণে ১৯৮১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বাড়ির সামনের ফুটপাথে একটি স্মৃতিফলক লাগানো হয়। প্রত্যেক বছর ওই দিন একটি অনুষ্ঠানও করা হয়। সমিতির পক্ষ থেকে ১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো বাড়িটি অধিগ্রহণের দাবি সম্বলিত আবেদনপত্রে যাঁরা স্বাক্ষর করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, বরুণ দে, সমীর রক্ষিত, নিমাইসাধন বসু প্রমুখ ২৮জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। ডিরোজিওর ওই বাড়িটিতে বর্তমানে রয়েছে একটি ডায়গোনস্টিক সেন্টার। পুরসভা বাড়িটিকে ‘হেরিটেজ সম্পদ’ হিসাবে ঘোষণাও করেছে।


তথ্য ঋণ: ডিরোজিওর বাড়ি: নথিপত্রের আলোকে, শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, ডিরোজিও স্মরণ সমিতি।

তথ্য ও ছবি: গৌতম বসুমল্লিক

 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


প্রথম পাতাঅতীতের তাঁরাতারাদের চোখেআমার শহরফিরে দেখাশিরোনামে শেষ তিরিশ

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.