|
|
|
|
|
|
পুজো থেকে বিয়ে, পাশেই আছে |
সুবিমল চক্রবর্তী
(নিউ ইয়র্ক থেকে) |
আমার ভাল-মন্দের কলকাতা— শৈশব থেকে কৈশোর পেরোনো সময়ে কাছ থেকে দেখা কলকাতা— সেই প্রিয় শহরকে ঘিরে পুরনো দিনগুলোর অনুভূতির কথাই লিখছি কলকাতার মতোই আর এক পুরনো শহর নিউ ইয়র্কে বসে।
প্রায় চল্লিশ বছর দেশ ছেড়েছি, কিন্তু যখনই পা দিই সেই প্রিয় শহরে,উৎসুখ মন আর চোখ দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি নতুন কলকাতার মাঝে আমার সেই পুরনো তিলোত্তমাকে খুঁজে পেতে।
আমার শৈশবের চেতলা-কালীঘাট তো অনেক পাল্টে গেছে। পাড়ার মাঠে বসত সঙ্গীত সম্মেলনের আসর (গায়িকা নির্মলা মিশ্রের বাবার স্মরণে)। রবিশঙ্কর, আলি আকবর, বিসমিল্লা, নাজাকৎ-সালামৎ-এর মতো বিখ্যাত সঙ্গীত প্রতিভারা আসতেন সেই আসরে। রাত যেন কখন ভোর হয়ে যেত তাঁদের মন মাতানো সঙ্গীত পরিবেশনে। মামার বাড়ি ছিল কালীঘাটের সদানন্দ রায় রোডে। সে পাড়ার সবুজ সংঘের জলসাও ছিল সমান আকর্ষণীয়। তখনকার সব বড় বড় গায়ক এবং কৌতুক অভিনেতাদের সমাগম হত সেই জলসায়। আরও কত জলসা শুনতে যেতাম বালিগঞ্জ আর শহরতলীর বিভিন্ন জায়গায়। পুজোর পরে ওই সব অনুষ্ঠানগুলো মন মাতিয়ে রাখত কত দিন! এক বার তো ( ডিসেম্বর ১৬, ১৯৬৩ সাল) আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ‘আনন্দমেলা’য় লিখেই ফেললাম এক ছড়া ‘জলসা’ নামে:
গুবরে পোকা গান গাইবে,
ভেঁপু বাদক ভোমরা,
পোকা সংঘের জলসা হবে
শুনবে নাকি তোমরা?...
মামারবাড়িতে একচালার সিঁদুর রঙা দুর্গা পুজো হত। সঙ্গে হত পাঁঠাবলি। চেতলার বাড়িতে, আরও অনেক বছর পরে, গৃহদেবতা কাত্যায়নীকে নিয়ে আসা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে (রাজা রাজবল্লভ দান করেছিলেন এক পূর্বপুরুষকে)। অষ্টমীর দিন তাঁর পুজো হত— এখনও হয়। প্রতিবেশী এবং আত্মীয় স্বজনেরা আসেন অঞ্জলি দিতে।
কেওড়াতলার পাশে আদিগঙ্গায় বান এলে ভেসে যেত কাঠের সেতুটা। জল ঢুকত আমাদের চেতলা স্কুলে। এভারেস্ট বিজয় করে তেনজিং নোরগে তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন স্কুলে। সে দিনও বানে ভেসেছিল স্কুল। বাংলা ক্লাসে কবি দীনেশ দাস উন্মনা মনে কবিতা আওড়াতেন,
বৃষ্টি পড়ে মাঠের ওপরে,
পোকা, কেঁচো, গুগলি শামুক, উঁচু করে মুখ...
বাইরে তখন ঝরঝরে বৃষ্টি।
রাসবিহারী মোড় থেকে ট্রাম ধরে ময়দানে গিয়ে চুনী-বলরাম-পি কে-থঙ্গরাজের খেলা দেখার পাগলামি তাড়া করে আজও। তার পর অনাদির মোগলাই খেয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরা। শীতের রাতে ট্রাম ধরে ইডেন পৌঁছে লাইনে দাঁড়ানো— ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা দেখা। এক বার ওই লাইনেই পদপিষ্ট হয়ে বন্ধু মনীশ নন্দী মারা গিয়েছিল! আজও বোধহয় ওর স্মরণে ফলকটা রয়েছে ইডেনের গায়ে।
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে হাই স্কুল ও কলেজে পড়াকালীন শরৎ আসা মানেই সাময়িক পত্রিকা প্রকাশনার সময়। আমার অগ্রজ শ্যামলকান্তি চক্রবর্তী (লেখক, পুরাতত্ত্ববিদ এবং ভারতীয় জাদুঘরের প্রাক্তন অধ্যক্ষ) সম্পাদনা করতেন, প্রথমে হাতে লেখা পত্রিকা ‘আগামী’ এবং পরে ছাপানো পত্রিকা ‘কথাকলি’। দাদার ‘ন্যাজ’ ধরে নামী/অনামী লেখকদের লেখা জোগাড় করতে যাওয়া ছিল বিশাল সম্মানের কাজ। আনন্দবাজার পত্রিকা আর দেশ পত্রিকার অফিসে ঢুঁ মেরেছি কত বার! সন্তোষকুমার ঘোষ, সুবোধ ঘোষ, সাগরময় ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, রমাপদ চৌধুরী, গৌরকিশোর ঘোষ (ব্রজদা), বিমল ঘোষ (মৌমাছি), যজ্ঞেশ্বর রায়, গৌরাঙ্গ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকদের সামনে প্রায় সারা দিন কাটিয়েছি একটা লেখার জন্য। আর পেয়েওছি। পত্রিকা অফিসটা ছিল তখনকার লেখকদের আঁতুড়ঘর। এ ছাড়াও গেছি রাজশেখর বসু, মনোজ বসু, আশাপূর্ণা দেবী, বিমল মিত্র, আনন্দগোপাল সেনগুপ্ত, শিবরাম চক্রবর্তী বা চণ্ডী লাহিড়ীর কাছে (শেষের দু’জনের সঙ্গ পেয়েছি ‘ভারতজ্যোতি’ সাময়িক পত্রিকার চেতলা অফিসে)। আনন্দবাজার পত্রিকার অফিস থেকে ফেরার পথে দাদা পাতিরামের বুকস্টলে গছিয়ে দিত কয়েকটা ‘কথাকলি’, বিক্রির জন্য।
একটা ছোট্ট ঘটনা— বেশ কয়েক দিন ধরেই যাচ্ছি হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রিটে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাড়ি। এক দিন ওঁর স্ত্রী একটু ধমকের সুরেই ওঁকে বললেন, “রোজ রোজ ছেলেগুলো আসছে একটা কিছু লিখে দাও না!’’ কাজ হল। মিনিট পনেরো বাদে কবি বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। হাতে একটা কাগজে চার লাইনের কবিতা: “সমুদ্র সূর্যেরে ছোঁবে
তাই বুঝি তরঙ্গ সে তোলে
জীবন তরঙ্গ যেন
ধীরে ধীরে হৃদয়কমল খোলে।”
আজও ‘কথাকলি’তে প্রকাশিত (২৮ এপ্রিল ১৯৬১ সাল) সেই কবিতার পাতাটা সযত্নে রেখে দিয়েছি।
শেষ করি পুজো দিয়েই। বাড়ির কাত্যায়নীর একটা ছোট ধাতুর প্রতিরূপ লং আইল্যান্ডের সায়াসেটের বাড়িতে নিয়ে এসেছি। ক’বছর যাবৎ অষ্টমী পুজোর আয়োজন করি এখানেই। দেশ থেকে দাদা শুদ্ধ উচ্চারণে মন্ত্র পাঠ করেন ফোনের ও-পাশ থেকে। এ পাশে দুই ভাই ও তাদের পরিবার, আমার পরিবার আর কিছু পরিচিতজনকে নিয়ে আমরা ফুল-দুর্বা দিয়ে অঞ্জলি দিই। কয়েক বছর আগে মেয়ের বিয়েতে একটু হিন্দু আচার পালন হয়েছিল। দেশ থেকে দাদার পৌরোহিত্যে দূরভাষের মাধ্যমে মন্ত্র উচ্চারণে তা সুসম্পন্ন হয়েছিল। বিদেশি জামাতা তো অবাক হয়েছিলই, সেই সঙ্গে আমার বিদেশিনী স্ত্রী মন্তব্য করেছিল, ‘‘বিয়েটাও আউটসোর্সিং করে দিলে, তা হলে আমেরিকায় আর রইলটা কি!’’
|
কলকাতার চেতলায় বেড়ে ওঠা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিসিই। ষাটের দশকে এ দেশের সরকারি সংস্থায় কাজ করলেও ১৯৭৪-এ মার্কিন মুলুকে পাড়ি। বর্তমানে নিউ ইয়র্কের সরকারি দফতরের একটি বিভাগের আঞ্চলিক অধিকর্তা। ভাল লাগার বিষয, বিভিন্ন জায়গার লোকায়ত জীবন নিযে চর্চা। |
|
|
|
|
|
|